রবিবাসরীয় ছোট গল্প
এই তো জীবন
-
ডঃ
সুমিত্রা খাঁ
বীণাদি বলে
ওঠে – কি হয়েছে কি ? খুলে বল । কেঁদে কিচ্ছু হবে না । জীবন মানেই তো সংগ্রাম ।
মিতা বলে –
বীণাদি এবার কেয়া আমায় আগেই বলেছিল – আপনার আর আপনার ছেলের খাবার ব্যবস্থা আপনিই করবেন । আমি এক সময় আমার আর আমার ছেলের ব্যবস্থা
করে নেবো । বুকে যেন শেল বিঁধল ।
সেই শুভদিন
এলো । মিতা আনন্দে আপ্লুত। ছেলে , নাতি মিতাকে প্রণাম করে ঘরে ঢুকল । এই শুভক্ষণের
অপেক্ষায় থাকা মিতা ওদের খাবারের ব্যবস্থা করে রেখেছিল। অতি সামান্যই ব্যবস্থা । লুচি
ও সাদা আলু ,ফুলকপির তরকারি । , আর ছিল নিজে হাতে গড়া নারকেলের নাড়ু। কেয়া মিতাকে পাশ
কাটিয়ে ওপরে উঠে যায়। মিতা ছেলে আর নাতির খাওয়ায় তৃপ্তি দেখে আনন্দে আত্মহারা হয় ।
ধন্য হয় তার স্নেহমাখা হাতের রান্না ।
পরদিন ভোর থেকেই
মিতার রুটিন মাফিক কাজ শুরু হয় । নিজে হাতে গড়া বাগানের সব্জীর কি কি পদ করা যায় ,
সেটা নিয়ে ভাবনা। ভাবছে ছেলের পছন্দের মাছ , পছন্দমত মাছের পিসও করে আনা হয়েছে সেই
মত ।
কেয়ার কথায়
এবার প্রথম তীর মিতার বুকে বিঁধলো । কলকাতায় প্রচুর মাছ খেয়েছি , মাছ আর খাবো না ।
ছেলের আর আমার ব্যবস্থা করে নেব । নির্বাক মিতা তার কাজ সেরে রান্না ঘর থেকে বেড়িয়ে
আসে । খানিক পরেই দেখে – কেয়া তার ছেলের এবং স্বামীর চিন্তায় মশগুল ।
মিতা দেখে এই
রুটিন চলতেই থাকে । কথায় কথায় ছেলের কথা কানে ভেসে আসে – কখন যে তুমি কি বলো , তা তুমি
নিজেই জানোনা । অন্যের ও মনে যে কিছু লাগতে পারে সে কথাও ভাবোনা ।
মিতা বাকরুদ্ধ হয়ে যায় ।মিতার বুকে আবার একটা তীর
বিঁধল। এক কথায় মিতাকে বিপ্লব অনেক কিছুই বোঝাবার চেষ্টা করেছিল – বাস্তব সংসারে মিতা
একটি অপদার্থ মহিলা । কেবল তো বক বক করে যাও , তোমার সোজা কথা উল্টে যায়। সত্যকে মিথ্যা
করতে বেশি সময় লাগে না । এবার থেকে সব কথার কিছু ছাড় দেবে, একদিন সে কথা শুনে মিতা
হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল । আজ সে কথা মর্মে মর্মে সে উপলব্ধি করছে । ভাতের থালার সামনে দু’চোখে
জলের ধারা বইতে থাকে । কাঁদতে কাঁদতে খাওয়া শুরু করে । আর সে ভাবে – বিপ্লব যাই বলেছিল
, তাই সত্য ।
এসব কথা শুনে
বীণাদি বলে ওঠে – তুই কিছু বলতে পারলি না ?
মিতা বলে –
না । কথায় কথা বাড়বে । চুপচাপ রয়ে গেলাম । পাছে কেউ জানতে পারে । একদিন কেয়া বলেছিল
– মা- মাই হয় । শাশুড়ি তো শাশুড়িই হয় । মিতা কেয়ার কথায় অবাক হয়েছিল । তার স্বপ্নই,
ছেলে – বৌ তার মেয়েই হবে । বড় আদরের মেয়ে । তা শুনে বিপ্লবও একদিন হেসেছিল । বিপ্লবেরও
স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল ।
একদিন কলাই ডাল ,পোস্ত রেঁধেছে মিতা। তার ছেলের প্রিয় খাবার । ঐ দিন ও দেখলো কেয়া রান্না ঘরে ঢুকে কাজ সারে । মিতা মনকে শক্ত করে । দাঁতে দাঁত চেপে বিপ্লবের কথা ভেবে কোন পাত্তাই দেয় নি। ভাবে কি ঘটে দেখা যাক।
খেতে
বসে ঘটে আর এক কাণ্ড । ছেলে বলে ওদের ভাত করো নি ? মিতার পরিষ্কার কথা – না । না বললে
জানবো কি করে ? ফিস ফাস শুরু । দোষ নাকি মিতার । তাঁরা বলেছিল মিতা নাকি শোনেনি। সেই
মিতাকে আবার ভাত বসাতে হোলো তাঁদের জন্য।
পরিবর্তন
মানুষকে কোথায় নিয়ে যায় । এ বাড়িটা এখন একটা অতিথিশালা । আভিজাত্য বজায় রাখার জন্য
নিজেদের মন মতো খাওয়া দাওয়া । কেনাকাটা , আনন্দ করাই যেন এখানে আসার উদ্দেশ্য । বোকা
মিতার কাজ শুধু একা হাতেই মনের বাসনা পূর্ণ করা ।
বীণাদি
বলে – মায়ের কাছে সব জানাও , সেইই পথ দেখাবে । তার পায়ে সব দুঃখ সঁপে দাও । জীবন মানেই
তো সংগ্রাম । দেখবে একদিন ঠিক ভুল বুঝবে। জীবনে অনেক কিছু ভালবাসলেও ,কিছু কিছু ছেড়ে
দিতে হয় । এই তো জীবন ।
মিতা
কাঁদতে কাঁদতে বলে –
জীবন
শিখিয়েছে –
সত্য
হারিয়ে গেছে –
মিথ্যার
জয় হয়েই চলেছে ।
জীবন
শিখিয়েছে –
একের
সত্য অন্যের কাছে ,
সত্য
নাও হতে পারে ।
নাটকের সাথে সত্য হয়ে মিথ্যা!
আর মিথ্যাচারিতা
হয়ে ওঠে সত্য ।
তবে চন্দ্র
, সূর্যের ওঠা – নামা কি মিথ্যা ?
সমুদ্রের ঢেউ
এর উচ্ছ্বাস ও কি মিথ্যা ?
( লেখিকা শান্তিনিকেতনের
প্রবীণা আশ্রমিক )
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন