রবিবাসরীয় সাহিত্যের দিন প্রতিদিন - সাহিত্যিক সন্দীপ চক্রবর্তীর অন্য ধারার গল্প গাঁথার ধারাবাহিক - " তুহু মম "

  রবিবাসরীয়   ধারাবাহিক 

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের নবীন লেখক সন্দীপ চক্রবর্তী । সন্দীপ লেখেন, নিজের অনুভুতি দিয়ে। সেখানে পাওয়া যাবে নিজেকে খুঁজে। বর্তমানে সন্দীপ একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের অন্যতম ।সন্দীপের  প্রতিটি অক্ষরের মাঝে লুকিয়ে থাকে সমাজের চালচিত্র। প্রতিদিন থাকছে  এই সমাজের কথকতা। একেবারে নতুন এক আঙ্গিক। একেবারে অন্য রকম আখ্যান গাথা  

                 তুঁহু মম / ৪১ ( অন্তিম পর্ব)        


 


সন্দীপ চক্রবর্তী


কলম্বো
শ্রীলঙ্কা
অর্জুনদা,
না, তোমার সঙ্গে একমত হতে পারলুম না। ভার্চুয়াল পৃথিবী কি কখনও ফুরোয়? অন্তত এই দু হাজার কুড়ি সালে কথাটা অসম্ভব। আজকাল ফেসবুক ইনস্ট্রাগ্রামের সৌজন্যে মানুষের ব্যক্তিগত পরিসর ছোট হতে হতে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। মাটির পৃথিবীতে মানুষের তৈরি যে সমাজ, আমরা যত তার থেকে দূরে সরে যাচ্ছি ততই সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে সামাজিক হবার ধুম বাড়ছে। আর হবে নাই-বা কেন? এক্ষুনি যদি ফেসবুকে লিখি, আজ আমার মন খারাপ--অমনি হৈ হৈ করে কয়েকশো মানুষ সমবেদনা জানাবার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বে। এমন হাতেগরম নগদ বিদায় তো আর রিয়্যাল লাইফে সম্ভব নয়। সুতরাং, ভার্চুয়াল পৃথিবী শেষ হয়ে যাচ্ছে না। তার পথও ফুরিয়ে যাচ্ছে না। বলতে পারো, আমাদের ইমেল চালাচালি এবার বন্ধ হবে। এখন থেকে আর অনলাইনে প্রেম করতে হবে না। আমাদের সম্পর্কের মধ্যে সোশ্যাল ডিসট্যানসিং ঢুকে পড়বে না। মন কেমন করলেই তোমার কাছে চলে যেতে পারব৷ এসব কী কম কথা!
আমি খুব আনন্দে আছি অর্জুনদা। প্রেম যখন পূর্ণতার আভাস পায় তখন সে এমনই আনন্দ হয়ে যায়। আমার মন এই চির ভাসমানতা থেকে যতই একটা ডাঙার দিকে এগোচ্ছে ততই তার পাত্র কানায় কানায় ভরে উঠছে। এক জীবনে মানুষ এমন অফুরান রূপ রস আর রঙের ডালির সন্ধান পায় আমি জানতুম না। তোমার ভার্চুয়াল পৃথিবীর আকাশ যে এমন জীবন্ত হয়ে, কাছের হয়ে একদিন আমার বারান্দার খুব কাছে চলে আসবে, তাও জানতুম না। আমি কি এতই দামি? আমার প্রেম কি এতই মহত? জানি না, ভালো লাগলেও বিশ্বাস করতে কেমন যেন ভয় ভয় করে। কী বর্ণনা দেব এই আকাশের! আমি তো আর তোমার মতো কবি নই। কলকাতায় কি এরকম ঘন নীল আকাশ কখনও দেখেছি? না, মনে পড়ে না। বালিগঞ্জের অভিজাত স্যালোনে কাটা আমার বাহারি চুল এলোমেলো করে দেওয়া এমন উতল হাওয়াই-বা কলকাতায় কোথায়? আর আলোর কথা কী আর বলব! রোদ্দুর যে এমন কবোষ্ণ হয় আমি জানতুম না। যেন আমি তোমার বুকের মধ্যে নিজেকে সঁপে দিয়েছি, এমনই নরম আর লাজুক উষ্ণতা তার। এই উদার উন্মুক্ত আকাশের কাছে দাঁড়িয়ে আমার মনে একটি কথাই বারবার উঁকি দিচ্ছে। এই রূপনগরের প্রকৃতি কি এমনই নিষ্করুণ, নাকি, কুমু পাগলি ভালোবেসেছে বলে তার প্রতি একটু বেশিরকম দরাজ? যা দেখছি, যা শুনছি, যা অনুভব করছি তা কি শুধু আমিই করছি, নাকি, এখানকার প্রতিটি মানুষ আজ আমার মতো আনন্দে পাগল হয়ে গেছে? আমার মতো ওদেরও ঘরে ফেরার টান প্রবল হয়ে উঠেছে? তোমার একটা লেখা খুব মনে পড়ছে--
খামের ওপর আমার নাম
ভেতরে তুমি রানির মতো একা
বারান্দায় বৃষ্টিপাতে ঘন
সমুদ্রের বিলীয়মান রেখা।
তুমি বলতে ঠিক যে কাকে বোঝায়
ভেবে দেখা হয়নি আমার আজও
সংজ্ঞা জেনে হবেই-বা কী?
বাজো তুমি, অহর্নিশ বাজো
এবং আমায় বাজাও
রাখো তোমার মনের অন্তঃপুরে
বনের রাখাল বুঝুক ক্ষণে ক্ষণে
মোহনবাঁশি কে বেঁধেছে সুরে
হ্যাঁ অর্জুনদা, আমার জীবনের মোহনবাঁশি তুমি সুরে বেঁধে দিয়েছ। শুধু বাঁধোনি, বাজিয়ে চলেছ প্রতি মুহূর্তে। তাই আজ আমি আনন্দে আত্মহারা। আমি দেশে ফিরব। তোমার কাছে ফিরব। এতদিন দূর থেকে তোমায় পেয়েছি। আমার আশ মেটেনি। সমুদ্রের ছবি দেখে যদি সারা গায়ে তলিয়ে যাবার শিহরন জাগত তা হলে তো কিছু বলার ছিল না। তোমায় আমি খুব কাছ থেকে দেখতে চাই। শেভ করার সময় গাল ভর্তি শেভিং ক্রিমের ফেনায় তোমাকে কেমন লাগে দেখতে চাই। কোথায় যেন পড়েছিলাম পুরুষমানুষের যৌন আবেদন সব থেকে বেশি ফুটে ওঠে শেভ করার সময়। স্নানের পর একটিমাত্র টাওয়েল জড়িয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসার সময় তোমাকে কেমন লাগে দেখতে চাই। চিলি শসে টইটম্বুর ফিশ ফিঙ্গার খেয়ে যখন হুশ হাশ করে নাকের জলে চোখের জলে হও, তখন কেমন লাগে দেখতে চাই। যখন ফুলবাবুটি সেজে বেরোও তখন রাস্তাঘাটে মেয়েরা তোমার দিকে কেমন করে দেখে, দেখতে চাই। রাতে, বিছানায় তোমার দস্যিপনার প্রতিটি ফেজ চেটেপুটে খেতে চাই। তোমাকে আদরে-সোহাগে উন্মাদ করে দিতে চাই। নাইটল্যাম্পের মৃদু নীল আলোয় চার দেওয়ালের মধ্যে আমি সব দেওয়াল ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে চাই।
আর দেখতে চাই রুরুর কথা বলার সময় তোমার চোখে কেমন করে ছায়া নামে। আমিও অন্যমনস্ক হতে চাই রুরুর জন্য। তোমাকে একলা রেখে পাশের ঘরে গিয়ে কাঁদতে চাই ওর জন্য। রুরুই তো আমার সাঁকো। ওই সাঁকো পেরিয়েই তো আমি তোমার কাছে আসতে পেরেছি। যদি কোনওদিন সাঁকো ডাঙা হতে চায় তা হলে হয়তো আমাকে আবার সমুদ্র হয়ে যেতে হবে। সে হব। আমি তো তোমায় বন্দি করতে আসিনি, বন্ধু করতে এসেছি। তুমি যেখানে জায়গা দেবে সেটাই আমার দেশ হয়ে যাবে৷ কিন্তু সে যাক। আমার চাওয়ার বহর তো দেখলে, এবার বলো, এসব দেবে তো আমায়? না দিলে কিন্তু মোক্ষদা পিসির মতো ঝগড়া করব। তখন আবার আমায় দোষ দিয়ো না।
আমার কাছে প্রেম এরকমই অর্জুনদা। দুই বন্ধুর হৃদয়ের বন্ধন। আর বিয়ে তার সামাজিক শিলমোহর। বন্ধুত্বই তো সব সম্পর্কের গোড়া, তাই না? ওটি না থাকলে যতই তুমি ডালপালা ছড়াও, ফুলেফলে ভারভারিক্কি হয়ে ওঠো--সময়ের হিমেল স্রোত ঠেলতে ঠেলতে সম্পর্কগুলো কেমন যেন জুড়িয়ে যায়। জলে ভেজা টাকার মতো মূল্য হারিয়ে এককোণে পড়ে থাকে। ফ্যান চালিয়ে শুকনো করলে তবে রক্ষে! কিন্তু তাও তো সবাই পারে না। কারোর ফ্যান চলে না, কারোর আবার জানলা খুললেও হাওয়া জোটে না। টাকা ভিজতে ভিজতে ছিঁড়ে যায়। শেষে মা গঙ্গার নাম করে ফেলে দিতে হয় দুনিয়ার চোখকান বাঁচিয়ে। আমরা কিন্তু কোনওদিন ডাস্টবিন খুঁজব না অর্জুনদা। আমি তোমার বন্ধু হব। তুমিও তাই হয়ো। তুমি স্বামী বলে আমি যেমন কোনওদিন তোমার দাসী হব না, ঠিক তেমনি তুমিও ভালোবাসার বাহুল্যে কোনওদিন আমাকে মাথায় তুলো না। আমাকে তোমার হৃদয়ে স্থান দিয়ো। আমরা স্বামী-স্ত্রী সমাজের কাছে, আইনের কাছে--কিন্তু নিজেদের কাছে আমরা বন্ধু। ঠাট্টা-তামাশায় সেজে উঠবে আমাদের সংসার, ছেলেমানুষিতে ভরে উঠবে আমাদের ঘরদুয়ার, আমাদের হাসি হবে প্রাণবন্ত আর কান্নাও হবে আগলহীন। তবে না আমরা একুশ শতকের দম্পতি। আশীর্বাদ করো আমায়, যেন অকপট হতে পারি। ভালোবাসার দিনে যেমন বলতে পেরেছি, ভালোবাসি--ঠিক তেমনি ভালোবাসতে না পারার দিনেও যেন বলতে পারি, ভালোবাসি না। কোনও পিছুটান বা পিছুডাকের মোহে যেন জীবনের সত্যকে অসম্মান না করি।
আজ বড্ড কাব্যি করছি, তাই না? কী করব, আনন্দে ভরে আছি যে। ভরিয়ে রেখেছ তুমি। সে আনন্দ এমনই অপার যে একটা আস্ত কবিতাই লিখে ফেলেছি। খুব কাঁচা। তোমার মতো একেবারেই নয়। কিন্তু তোমার কথা ভেবে লিখেছি যখন, তোমাকে তো পড়তেই হবে। তবে
কথা দিচ্ছি, এই প্রথম আর এই শেষ। আর কখনও কবির গৃহিণী হবার সু্যোগ নেব না।
আমার চৌকাঠে উড়ে আসে
মেহেদি মানুষের ধুলোবালি
হাওয়ায় পাতা ঝরে আনমনে
আকাশে বাঁকা চাঁদ একফালি
আমার মুখরতা জলছবি
পথের ধুলোভরা আয়নাতে
আমি তো যেতে যেতে রাঙামাটি
আকাশ ঝুঁকে পড়ে জানলাতে।
রক্তঘাম মুছে ফিরে চলি
উঠোনে তোমাদের মাঝখানে
আমার ঈশ্বর ভোরবেলা
খরায় বৃষ্টির জল আনে।
ভালো থেকো
কুমুদিনী
পুনশ্চঃ
আমাদের অনলাইন প্রেম শেষ। এবার সব অফলাইনে। আর মোটে বাহাত্তর ঘন্টা অর্জুনদা। তারপর শ্রীলঙ্কার প্লেন আমাকে নিয়ে উড়ে যাবে চেন্নাইয়ে। তারপর উটি। উফ! কথাটা মনে পড়লেই আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। আমরা আবার নতুন করে শুরু করব। কী মজা বলো তো!
(শেষ)

মন্তব্যসমূহ