রবিবাসরীয় সাহিত্যের দিন প্রতিদিন - সাহিত্যিক সন্দীপ চক্রবর্তীর অন্য ধারার গল্প গাঁথার ধারাবাহিক - " তুহু মম "
রবিবাসরীয় ধারাবাহিক
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের নবীন লেখক সন্দীপ চক্রবর্তী । সন্দীপ লেখেন, নিজের অনুভুতি দিয়ে। সেখানে পাওয়া যাবে নিজেকে খুঁজে। বর্তমানে সন্দীপ একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের অন্যতম ।সন্দীপের প্রতিটি অক্ষরের মাঝে লুকিয়ে থাকে সমাজের চালচিত্র। প্রতিদিন থাকছে এই সমাজের কথকতা। একেবারে নতুন এক আঙ্গিক। একেবারে অন্য রকম আখ্যান গাথা
সন্দীপ চক্রবর্তী
রাখিগঢ়ি
হরিয়ানা
কুমুদিনী,
কাল থেকে এখানে খুব বৃষ্টি। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ঝাপসা হয়ে যাওয়া সাইটের দিকে তাকিয়ে থাকতে অন্যসময় মন্দ লাগে না কিন্তু আজ সকাল থেকে আমি উৎকর্ণ হয়ে অপেক্ষা করছি মোবাইলের একটা বিশেষ শব্দ শোনার জন্য। ইনবক্সে কোনও মেসেজ ঢুকলেই আমার মোবাইল নূপুরের নিক্কনের মতো মিষ্টি শব্দ করে জানিয়ে দেয়, কেউ এসেছে। আমিও ঝাঁপিয়ে পড়ে দেখি, কে এলো! বেশিরভাগ মেসেজই 'পণ্ড করিয়া যাহারা অতিশয় আনন্দ পান' অর্থাৎ সেইসব তথাকথিত পণ্ডিত ব্যক্তিদের। সত্যি, সারা পৃথিবীতেই প্রকৃত শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা যত কমছে, ভানসর্বস্ব ইন্টেলেকচুয়ালদের ভিড় ততই বাড়ছে। কলকাতার অবস্থা সব থেকে খারাপ। বাঙালি চিরকালই কপিক্যাট প্রজাতি। দুধেভাতে থাকার জন্য ভোল পাল্টাতে বাঙালির জুড়ি নেই। একদা যে শহর সাহিত্যে, শিল্পে, সিনেমায়, নাটকে সারা ভারতবর্ষকে পথ দেখিয়েছিল, আজকাল সেখানকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েরা রবীন্দ্রনাথের গানকে ভেংচি কেটে খোলা পিঠে খিস্তিখেউড় লিখে ঘুরে বেড়ায়। ড.পৃথ্বীশ বাগচীর কথা কি তোমায় আমি বলেছি? প্রেসিডেন্সিতে আমার মাস্টারমশাই ছিলেন। অ্যাপ্লায়েড আর্কিওলজিতে স্যারের মতো ওরকম ইন ডেপথ নলেজ আমি আর কারোর মধ্যে দেখিনি। স্যার আমাদের বলতেন, কলকাতা ইজ আ ডেড সিটি। ব্রিটিশও চলে গেছে কলকাতাও শেষ হয়ে গেছে। তখন আমি কলকাতার নেশায় মাতাল হয়ে আছি। স্যারের কথাগুলো এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দিতাম। কিন্তু এখন মনে হয় স্যার ঠিকই বলেছিলেন। কলকাতা ইজ আ ডেড সিটি। এই শহরটাকে বাঁচাতে হলে স্বামীজী আর রবীন্দ্রনাথকে আবার জন্ম নিতে হবে। নয়তো কলকাতা বাঁচবে না, বাঙালিও না।
যাক, সে কথা। যা বলছিলাম তাই বলি। সারা সকাল বসে রইলাম কিন্তু মোবাইলের নূপুর বাজল না। অপেক্ষা কার মেইলের জন্য, বুঝতেই পারছ। সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেল। লক ডাউনে বাড়িতে রান্না-বান্নার ঝামেলা নেই। কাজের লোক তার নিজের বাড়িতে। ক্যান্টিন থেকে লোক এসে লাঞ্চ আর ডিনার দিয়ে যায়। ব্রেকফাস্ট বা সন্ধ্যেবেলার জলযোগ আমি ক্যান্টিনে গিয়ে সেরে আসি। চা-কফির ক্ষেত্রেও একই ব্যবস্থা। দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর ঝিমোচ্ছি, এমন সময় মোবাইলের দেবতার দয়া হল। তিনি টুং করে বাজলেন। আমিও হামলে পড়লাম। কিন্তু কোথায় তুমি, এ তো রুরু! দু'দিন আগে যে রুরুকে মেইল করেছি সেটা ভুলেই গিয়েছিলাম। অনেকদিন ওর সঙ্গে কোনও ইন্টারঅ্যাকশন নেই। তার থেকেও বড়ো কথা ওর কাছে আমার আর কোনও প্রত্যাশা নেই। যেখানেই থাকুক বা যার সঙ্গেই থাকুক, ও ভালো থাকলেই আমি খুশি। যাই হোক, সিরিয়াসলি পড়ে ফেললাম ওর মেইল। সংক্ষেপে বলে রাখি আমার কথাগুলো ও বেশ স্পোর্টিংলি নিয়েছে বলেই মনে হল। অর্থাৎ রুরু মনস্থির করতে পেরেছে। ওর মেইল অ্যাটাচ করে দিলাম। পরে কোনও সময় পড়ে নিয়ো। দুপুরের পর বিকেল হল। তারপর সন্ধ্যে। সাড়ে ছ'টা নাগাদ পুরি-সবজি আর চা দিয়ে গেল ক্যান্টিন থেকে। সাতটার সময় আবার টুং! এবার তুমি। আর কোনও ভুল নেই।
তুমি ঠিকই লিখেছ কুমুদিনী। রুরুর প্রতি সেদিন হয়তো আমি অজান্তেই একটু নিষ্ঠুর হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু নিষ্ঠুর না হলে কি রুরু আমার কথাগুলো বুঝত? আমার মনে হয় রোম্যান্স শেষ হয়ে গেলে রোমান্টিক হবার ভান না করাই ভালো। আমি জানি তীক্ষ্ণ একটা অপরাধবোধ রুরুকে ক্ষতবিক্ষত করছে। হয়তো ও ভাবছে ওর জন্যেই আমাদের ঘর ভেঙেছে। সম্পর্ক ভেঙেছে। যদিও এরকম একপেশে ভাবনা অমূলক। দোষ আমারও ছিল। কিন্তু আমার কোনও অপরাধবোধ সেদিনও ছিল না, আজও নেই। কারণ আমি যখনই নিজের ভুল বুঝতে পেরেছি তখনই তা সংশোধন করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু রুরু কোনওদিনই নিজের ভুলকে ভুল বলে মানতে চায়নি। ভুলকে জাস্টিফাই করাটা তো কোনও কাজের কথা নয় কুমুদিনী। বাঘের গায়ে নামাবলি জড়িয়ে দিলেই যদি তার স্বভাব বদলে ফেলা যেত তা হলে তো আর কিছু বলার ছিল না। আমি যদি অপরাধবোধে ভুগতাম তা হলে অবশ্যই রুরুকে সব বলে ওর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিতাম। কিন্তু রুরু তো ঈশ্বরের কাছেই কোনওদিন মাথা নত করেনি, আমার কাছে কীকরে করবে? আমার কাছে ভালোবাসা একটা পবিত্র অনুভূতি। আমি সারা জীবন এই মাধুর্যের কাছে সমর্পিত থাকতে পারি। কিন্তু রুরু তা পারে না। ওর কাছে ভালোবাসা মানে ভালোবাসার ম্যানিফেস্টেশন। ওর জীবনে একদা এই ম্যানিফেস্টেশনের নাম ছিল অর্জুন। মাঝে হল অমল। এখন বিনোদ। এরপর কে, জানি না। আমরা যখন ম্যানিফেস্টেশনে বেশি গুরুত্ব দেব তখন তার আধার এভাবেই বারবার পালটে যাবে। এক থেকে বহু হবে। আমাদের এত দেবদেবী এই কারণেই। আর যখন অনুভূতিকে গুরুত্ব দেব তখন অসীম অনন্ত এক রূপ একাধারে লীন হয়ে যাবে।
তুমি বলতেই পারো, সাধারণ একটা ব্যাপারের সঙ্গে কেন আমি গভীর তত্ত্বকথা জুড়ে দিচ্ছি? কারণ আমি এভাবেই ভাবি আজকাল। তোমার কথাই ধরো। তুমি কি আমার কাছে শুধুই কুমুদিনী মিত্র? একজন মনোবিদ? একজন খুব ভালো রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী? সুন্দরী একজন মহিলা? না, তা নয়। এসব তোমার বাহ্যিক পরিচয়। জন্মের পর মানুষের তৈরি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তোমাকে এইসব আইডেন্টিটি দিয়েছে। আমার কাছে এসবের কানাকড়িও মূল্য নেই। মূল্য আছে শুধুমাত্র মূল্যবোধের। কীরকম জানো? আমার কাছে তুমি হলে সেই মাধ্যম যার গভীরে ডুব দিলে আমার ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। মনে হয় পৃথিবীটা খুব সুন্দর। মনে হয় তুমি পাশে থাকলে আমি এই পৃথিবীকে--এই জীবনকে আরও অনেক কিছু দিতে পারি। প্রতিটি মানুষের মুখ ঈশ্বরের মতো সুন্দর হয়ে ওঠে। মনে হয় ছোট ছোট হাসিকান্নার অজস্র মুহূর্ত শুধুমাত্র আমাদের বুকের ছায়ায় জন্মাবে বলে হাজার হাজার বছর ধরে অপেক্ষা করছে। আমরা ওদের জন্ম দেব। ওরাও আমাদের জন্ম দেবে। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করো, আমি যেন তোমাকে অনুভবে এমনি করে পাই। তবেই বাকি পাওয়াগুলো সত্যি হবে।
অনেক মনের কথা বলা হল। এবার কাজের কথা। তুমি লিখেছ শ্রীলংকান গভর্নমেন্ট কিছুদিনের মধ্যেই আনলকিংয়ের প্রোসেস শুরু করবে। এটা ভালো খবর।
এখানেও আনলকিং খুব শীগগির শুরু হবে বলে শুনছি। ফ্লাইট চালু হলে তুমি যদি রাখিগঢ়িতে আসো ভালোই হয়। আমরা তা হলে একসঙ্গে কলকাতায় ফিরতে পারি। তা ছাড়া, তুমি এখানে ক'দিন থাকলে ভালোমন্দ খাওয়াও হবে। কতদিন ভুনি খিচুড়ি খাইনি। ভেবো না যেন শুধু খাওয়ার কথা ভাবছি। যেটা বেশি করে ভাবছি সেটা বলতে সংকোচ হচ্ছিল। যাই হোক বলেই ফেলি। তুমি এলে কয়েকটা দিন তোমাকে নিয়ে ভিড়ের মাঝে গা-ঢাকা দিতে চাই।
আমার সঙ্গে পালিয়ে যেতে তোমার আপত্তি নেই তো?
ভালো থেকো
অর্জুনদা
কলকাতা
অর্জুন,
তোমার মেল পাবার পর দু'দিন কারোর সঙ্গে কথা বলিনি। খুব রেগে গেলে আমি কীরকম বিহেভ করি তুমি তো জানো। মনে হচ্ছিল সব ভেঙেচুরে শেষ করে দিই। বিনোদ বাড়িতেই ছিল। হি ট্রায়েড আ লট টু আনডারস্ট্যান্ড হোয়াট হ্যাপেনড টু মি। আই রিয়েলি ফিল পিটি ফর হিম। বেচারা! হাউ কুড হি নো আ টাইগ্রেস ক্যান বি ফায়ার্ড আপ জাস্ট ফর বিইং ইগনোর্ড বাই সামওয়ান শি লাভড? তুমি বলবে, কই আমি তো ইগনোর করিনি। ট্রু, করোনি। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল। কেন মনে হয়েছিল, জানি না। মে বি, দ্যাট মিডল ক্লাস অ্যান্ড সেন্টিমেন্টাল রুরু কেম ব্যাক সাডেনলি ইন মাই মাইন্ড অ্যান্ড টুক মি ডাউন টু দোজ ডেজ, উই হ্যাড স্পেন্ট টুগেদার। তার নেশাও তো কম নয়, কী বলো! আমার হঠাৎ রাগের আরও একটা কারণ থাকতে পারে। ওই যে তুমি বলেছ, গল্পটা শেষ হয়ে গেছে। ইউ আর রং। যে গল্প আমি শুরু করেছি সেটা একমাত্র আমিই শেষ করতে পারি। হাউ ডেয়ার ইউ ফিনিশ ইট অর্জুন? তোমার কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েও এতদিন গল্পটা আমি শেষ করতে পারিনি। আই হ্যাভ অলওয়েজ থট টু অ্যাড সাম মোর লাইনস টু দা স্টোরি। কেন জানো? বিকজ আই ওয়ান্টেড টু কিপ দা ক্লাইম্যাক্স ফার অ্যাওয়ে ফ্রম আস। আই ওয়ান্টেড দা বার্ড উইল কিপ ফ্লাইং ফার ফ্রম দা ম্যাডিং ক্রাউড। বাট নাউ দা টাইম ইজ আপ। এ গল্পে সত্যিই আর কিছু নেই। আমি বিনোদকে বিয়ে করছি আর তুমি কুমুদিনীকে। পাখিটার ওড়ার মতো আকাশ কোথায়?
আই মাস্ট থ্যাঙ্ক ইউ ফর দা ইনস্পায়ারিং সাজেশনস৷ সত্যিই বিনোদের মধ্যে তোমাকে খোঁজা আমার বোকামি। ও কী করে তোমার মতো হবে? আসলে কী যে আমি চাই নিজেও জানি না। জানতে চাইও না। কারণ কী চাই জানলে শুধু সেটুকুই পেতে চাইব। তারপর আর কিছু চাওয়ার মতো থাকবে না। জীবনের সব সম্পর্কই আমার কাছে সরাইখানার মতো। নিজের বাড়ি কোনওটাই নয়। ইউ ওয়ার দা এক্সসেপশন অনলি।
কুমুদিনী নামটা আমার খুব ভালো লেগেছে। মেয়েটাও নিশ্চয়ই ভালো। আই উইশ হার অল দা বেস্ট। অল দা ভেরি বেস্ট ফর ইউ অলসো। একটা কথা খুব জানতে ইচ্ছে করছে। কৃষ্ণনগরের বাড়িটা কি বিক্রি করে দিয়েছ? অমলতাসের যে চারাটা আমি বসিয়ে ছিলাম সেটা খুব বড়ো হয়ে গেছে, তাই না? ফুল ফোটে? কে জানে কেমন দেখতে হল?
ভালো থেকো
রুরু
(ক্রমশ)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন