রবিবাসরীয় সাহিত্যের দিন প্রতিদিন - সাহিত্যিক সন্দীপ চক্রবর্তীর অন্য ধারার গল্প গাঁথার ধারাবাহিক - " তুহু মম "

   রবিবাসরীয়   ধারাবাহিক 

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের নবীন লেখক সন্দীপ চক্রবর্তী । সন্দীপ লেখেন, নিজের অনুভুতি দিয়ে। সেখানে পাওয়া যাবে নিজেকে খুঁজে। বর্তমানে সন্দীপ একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের অন্যতম ।সন্দীপের  প্রতিটি অক্ষরের মাঝে লুকিয়ে থাকে সমাজের চালচিত্র। প্রতিদিন থাকছে  এই সমাজের কথকতা। একেবারে নতুন এক আঙ্গিক। একেবারে অন্য রকম আখ্যান গাথা  

                 তুঁহু মম / ৪০        


 


সন্দীপ চক্রবর্তী


কলোম্বো
শ্রীলঙ্কা
অর্জুনদা,
তোমার লেখা পড়ে জাস্ট ফিদা হয়ে গেছি। চিঠি বলো বা মেল বলো-- আমরা তো সবাই লিখি কিন্তু ক'জন তোমার মতো কথা দিয়ে ছবি আঁকতে পারি? উফ, ভাবা যায় না! মাঝে মাঝে কী মনে হয় বলো তো, মনে হয়, তুমি যদি আর্কিওলজিস্ট না হয়ে লেখক হতে তা হলে বোধহয় বেশি ভালো হত। এখন যারা লেখেন তাদের মধ্যে অনেকেই ভালো--যথেষ্টই উঁচু জাতের লেখক তারা--কিন্তু কেউই তোমার মতো নয়। তোমাকে ভালোবাসি বলে তোমার সব কিছুই আমার ভালো লাগে কিন্তু লেখার প্রশংসা আমি মোটেই সেইজন্য করছি না। যেটুকু সাহিত্য বুঝি তাতে মনে হয় লেখকের সঙ্গে পাঠকের মনের সেতুরচনাই সাহিত্যের উদ্দেশ্য। এই সেতু যেমন ভাবের, ঠিক তেমন ভাষারও। যত শক্ত কথাই তুমি লেখো আমার বুঝতে অসুবিধে হয় না। আর একান্তই যদি কোনও কথা বুঝতে না পারি, তা হলে জিজ্ঞসা করে নিই। যে সেতুতে পারাপারের এমন সুবিধা তাকে ভালো না বেসে উপায় আছে?
হেসো না বাপু! সঙ্গদোষ যদি থাকে তা হলে সঙ্গগুণও তো থাকবে, নাকি? তোমার সঙ্গে দিনরাত বকবক করে আমিও একটু-আধটু লিখতে শিখেছি। এমনিতেই আমি তোমার লেখা একবার নয়, অন্তত দু-তিনবার পড়ি। এবারের লেখাটা প্রথমবার পড়ার পর তোমার ভাষার মাধুর্যে এমন আটকে গিয়েছিলুম যে চোখেই পড়েনি তুমি রুরুকে এখনও ভালোবাসো। ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে তোমার মুখ লুকনো লাজুক প্রেম। কতটা নরম জানো? সূর্য ডুবে যাবার পরেও আলোর যে রেশ থেকে যায়, তার মতো। কলকাতাতে দেখেছি এই আলো। কিন্তু কলম্বোয় এসে যা দেখছি তার কোনও তুলনা হয় না। বিশ্বাস করবে কি না জানি না, ঘর আর ঘাটের মাঝখানে থমকে দাঁড়ানো এই আলোয় প্রতিটি মানুষের মুখ সুন্দর হয়ে ওঠে। ঠিক যেমন কথার চাবুকে বারবার আঘাত করেও তুমি রুরুকে মুহূর্তের জন্যেও অসুন্দর হতে দাওনি। চোখের দেখায় রুরু যতটা সুন্দর তোমার তীব্র ও কঠোর আত্মবিশ্লেষণেও ততটাই। একে তুমি ভালোবাসা বলবে না তো কী বলবে অর্জুনদা?
তোমাকে আমি আগেও শ্রদ্ধা করতাম, এর পর আরও বেশি করে করব। কারণ আমি আছি বলে তুমি রুরুকে উপেক্ষা করোনি। ওকে বঞ্চিত করোনি ওর প্রাপ্য সম্মান থেকে। তোমার মুখে অনেকবার শুনেছি, তুমি নাকি অতীতকে মনে রাখতে চাও না। কারণ অতীতের কোনও ক্রিয়েটিভ মোশন নেই। অতিরিক্ত অতীত-নির্ভরতা বা স্মৃতিকাতরতা মানুষকে একটু একটু করে ইনার্ট করে দেয়। সে আর পরিবর্তনশীল সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারে না। এসব তোমার কাছেই শোনা। কিন্তু বিশ্বাস করো, যতবার শুনেছি ততবারই খটকা লেগেছে। অতীতের যে ঘটনা বা যে মুখ আজও অনুভবে ধরা দেয়, অতীতকে ভোলার মাথার দিব্যি দিয়ে তাকে কি জোর করে দূরে সরিয়ে রাখা যায়? তোমার রিয়ালিটিতে রুরু আজ নেই, সে অতীত হয়ে গেছে--মানছি, কিন্তু তোমার অনুভবে আজও সে জীবন্ত। আর সেটাই স্বাভাবিক। কুমু পাগলির ভাগ্য ভালো রুরুর কাছে লার্জার দ্যান লাইফ হয়ে ওঠার পুরনো লোভ ত্যাগ করে তুমি ওর সঙ্গে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক আচরণ করেছ। আমাকে বড়ো দেখাতে ওকে খাটো করোনি। আমার চুপিচুপি খটকাটা যে সমুদ্দুর পেরিয়ে তোমার ইগোর ঠ্যাং ধরে টান দিতে পেরেছে, এটা ভেবেই আমি খুশি।
সত্যিই আমি খুশি অর্জুনদা। কারণটা তুমি যদি মেয়ে হতে তা হলে ভালো বুঝতে। এই যে একটা অপার নিশ্চিন্তির বোধ, এটা সম্পূর্ণতই মেয়েদের। মানুষের জীবনে আজ সকাল তো কাল বিকেল। পরশু আবার সন্ধ্যেও নামতে পারে। তখন কি শুধু মায়া দিয়ে অন্ধকারকে দূরে ঠেলতে পারব অর্জুনদা? আজ যেমন তোমার খুব কাছে আছি, কে বলতে পারে কাল কোনও ধাক্কায় অনেক দূরের কোনও অ্যাক্সিসে ছিটকে যাব না? তুমি সাধারণ পুরুষ হলে বলার কিছু ছিল না। মোটামুটি আহার নিদ্রা মৈথুনে বাঁধা থাকত জীবন। কুমুদিনী মিত্র হয়তো তার ডাক্তারি গাম্ভীর্য বজায় রেখে তাকে বিয়েও করে ফেলত। যেমন অনেকে করে আর কী! সে সুখী হত, সবাই যেমন হয়। সে দুঃখ পেত, সবাই যেমন পায়। চল্লিশ পেরিয়ে অবসাদে ভুগত, সবাই যেমন ভোগে। কিন্তু কুমুদিনী মিত্রের কুমু পাগলি হওয়া হত না। কৃষ্ণের হাসি আর বাঁশির জন্য রাতভর ঘরবার করা হতো না। সে যাই হোক--যে কথা বলছিলুম সেটাই বলি। তুমি সাধারণ হলে আমার এই নিশ্চিন্তির দরকারই হত না। তুমি অসাধারণ। আমাদের ইতিহাসে পুরাণে তোমার মতো মানুষকেই দেবতা বলা হয়েছে। তোমাদের দেশে দেশে ঘর থাকে। সেইসব ঘর থেকে ডাকার মতো নারীও থাকে। তেমনই কারোর ডাকে তুমি যদি সাড়া দাও আমি তো ছিটকে যাবই অর্জুনদা। তবে তাতে আমার ভয় নেই। কারণ তোমার কাছে থাকি বা দূরে--তোমার অন্তর থেকে কেউ আমাকে সরাতে পারবে না। ভেবো না যেন এই প্রবল আত্মবিশ্বাস আমার নিজস্ব অর্জন। ধুস, আমি এত দামি জিনিস কোথায় পাব! আমার সব হিরে-জহরতের গয়নার মতো এই আত্মবিশ্বাসও তোমারই দেওয়া। আজ রুরু যেমন একটা সোনালি সময়ের মুখ হয়ে তোমার হৃদয়ে বেঁচে আছে, দৈবাৎ দূরে ছিটকে গেলে আমিও সেরকমই থাকব। আমরা যে ভালোবেসেছি অর্জুনদা। আর তাই আমরা একে অপরের কাছে চিরকালের হয়ে গেছি। সময় কখনও মরে না। ঘটনা মরে, স্মৃতি ফুরোয় কিন্তু যে সময়ে এসব হয়েছিল সে মাঝে মাঝেই ফিরে ফিরে আসে।
তা বলে ভেবো না যেন যাহোক-তাহোক একটা ধাক্কাতেই আমি ছিটকে যাব। কুমু পাগলিকে তার দেবতার পুজোর আসন থেকে ছিটকে দিতে পারে এরকম ধাক্কা বোধহয় এখনও জন্মায়নি। যদি কোনওদিন আমার পুজোয় তোমার অরুচি হয়, তবুও আমি পুজোর আসন ছাড়ব না। এটা আমার ব্যক্তিগত চয়েস। এখানে তোমারও নাক গলানোর অধিকার নেই। ছিটকে-টিটকে যাওয়া নিয়ে এত কথা বললাম কারণ রুরুকে নিয়ে বা তোমাকে নিয়ে আমার ভয় ক্রমশ কেটে যাচ্ছে বলে। আজ আর আমার কোনও দ্বিধা নেই। হ্যাঁ অর্জুনদা, আমি তোমাকে পেয়েছি। একেবারে নিজের মতো করে পেয়েছি।
এবার একটা সুখবর। আগামী সপ্তাহ থেকে শ্রীলঙ্কান গভর্নমেন্ট আনলকিংয়ের প্রোসেস ধীরে ধীরে শুরু করবে। বিমান চলাচল শুরু হলেই আমি দিল্লি উড়ে যাব। ওখান থেকে রাখিগঢ়ি। তোমার কাছে। কতদিন তোমাকে দেখিনি। ভালো করে তোমায় দেখে, তোমার সঙ্গে প্রাণ ভরে গল্প করে পাড়ি দেব কলকাতায়। মা জননীর কাছে। তুমি যাবে? ছুটি না পেলে জোর করব না।
ভালো থেকো
কুমুদিনী
(ক্রমশ)

মন্তব্যসমূহ