রবিবাসরীয় সাহিত্যের দিন প্রতিদিন - সাহিত্যিক সন্দীপ চক্রবর্তীর অন্য ধারার গল্প গাঁথার ধারাবাহিক - " তুহু মম "

  রবিবাসরীয়   ধারাবাহিক 

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের নবীন লেখক সন্দীপ চক্রবর্তী । সন্দীপ লেখেন, নিজের অনুভুতি দিয়ে। সেখানে পাওয়া যাবে নিজেকে খুঁজে। বর্তমানে সন্দীপ একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের অন্যতম ।সন্দীপের  প্রতিটি অক্ষরের মাঝে লুকিয়ে থাকে সমাজের চালচিত্র। প্রতিদিন থাকছে  এই সমাজের কথকতা। একেবারে নতুন এক আঙ্গিক। একেবারে অন্য রকম আখ্যান গাথা  

                 তুঁহু মম / ৩৯        


 


সন্দীপ চক্রবর্তী


রাখিগঢ়ি
হরিয়ানা
কুমুদিনী,
তুমি সেরে গেছ জেনে মনটা খুশিতে ভরে গেল। এ ক'দিন একটা দমবন্ধ করা আতঙ্ক বুকের ওপর আততায়ীর মতো বসেছিল। আমার জীবনের সুখ আর শান্তির ওপর তার নজর। বহুবার সে তাদের খুন করেছে৷ এবারও চেষ্টা করেছিল কিন্তু পারেনি। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ তিনি ওকে জিততে দেননি। তোমাকেও সুস্থ করে ফিরিয়ে দিয়েছেন।
আমি এই তিনটি সপ্তাহের কথা কোনওদিন ভুলতে পারব না। জয়াকে প্রতিদিন চারবার-পাঁচবার করে ফোন করতাম। জয়া তোমার সম্বন্ধে খুঁটিনাটি কত কী ইনফর্মেশন দিত! কীভাবে জোগাড় করত জানি না। হয়তো আমাকে সব কথা বলবে বলে ঘন্টার পর ঘন্টা হাসপাতালে বসে থাকত। ওর কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। একদিন তো তোমার কথা বলতে বলতে কেঁদেই ফেলল। অমন ডাকাবুকো মেয়ে। কথায় কথায় যার হাসি পায়। যখন ঠাট্টা করে কাউকে ছাড়ে না, নিজেকেও না। সেই মেয়ে কাঁদছে। তখন তুমি সদ্য হাসপাতালে ভর্তি হয়েছ। ডাক্তারেরা স্বাভাবিকভাবেই কোনও আশার কথা শোনাতে পারছেন না। ঘটনাটা সেই সময়ের। জয়া ফোন করে বলল, 'জানো দাদা, আজ কুমু জ্বরের ঘোরে ইলিশের পাতুরি খেতে চাইছিল। এই বিদেশে আমি ইলিশ কোথায় পাই বলো তো? কুমু খেতে চাইল আর আমি খাওয়াতে পারব না?' কথাটা শুনে আমারও মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। বুঝেছিলাম কেন জয়া কাঁদছে। আমাদের সম্পর্কগুলো মনের সঙ্গে মনের। মনকে এক্সপ্রেস করা শরীরের কাজ। কিন্তু শরীর জন্মমৃত্যুর অধীন। এক মন যখন জানতে পারে ওদিকের মনটি এবং তার এক্সপ্রেশনিস্ট শরীরটি এক প্রবল পরাক্রান্ত ভাইরাসের কবলে পড়েছে, তখন ইলিশের পাতুরি খাওয়াতে না পারলে এমনি করেই ভেঙে পড়ে। যদি তুমি ফিরে না আসো তা হলে তো তোমার অচেতন মনের এই ইচ্ছে, ইচ্ছে হয়েই থেকে যাবে। তারপর সেই ইচ্ছেকে প্লাস্টিক কভারে মুড়ে মাটিতে গর্ত খুঁড়ে পুঁতে দেওয়া হবে। কেউ দেখতে পাবে না, এমনকী আমিও না। কিন্তু জয়া পাবে। বাংলাদেশের মেয়ে, যত্রতত্র ইলিশ দেখে। খুব কাছের কেউ ইলিশ মাছ খাবার বায়না করছে আর স্রেফ বিদেশে আছে বলে ও খাওয়াতে পারছে না--শেষমেশ না খেয়েই চলে যাচ্ছে প্রিয় মানুষটি--এরপরও জয়া কাঁদবে না? তুমি সত্যি সত্যি চলে গেলে জীবনে যতবার কথাটা মনে পড়ত ততবারই জয়ার চোখ ভিজে যেত। ঈশ্বরকে আবারও ধন্যবাদ জানাই, তিনি অন্তত বাড়তি একটা কান্নার হাত থেকে মেয়েটাকে রক্ষা করেছেন। ধন্য তোমার বন্ধুভাগ্য কুমুদিনী! নিবিড় বন্ধন ছাড়া বন্ধুত্ব হয় না। তোমার আর জয়ার মধ্যে সেই বন্ধন আছে। তুমি ঠিকই বলেছ। এরপর আর কোনওদিনই, 'সেমিনারে পেপার পড়তে গিয়ে আলাপ হয়েছিল' বলে তুমি জয়াকে উপেক্ষা করতে পারবে না। তোমার এই কথাটাও ঠিক, করোনা আমাদের শুধু সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং দেয়নি, সোশ্যাল অ্যাটাচমেন্টও দিয়েছে।
যদিও টিভিতে রোজ যা দেখছি বা খবরের কাগজে যা পড়ছি তাতে সবসময় তোমার কথার ওপর আস্থা রাখতে পারি না। দু'দিন আগে নিউজ চ্যানেলে ফ্রান্সের একটা খবর দেখাচ্ছিল। হাসপাতালের খুপরি কেবিনে একটা ডেডবডি পড়ে আছে। আর কেবিনের বাইরে জানলার কাঁচে নাক ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা দশ-এগারো বছর বয়েসের মেয়ে। ডেডবডিটি ওর বাবার। মেয়েটার চোখে কী অপরিসীম মায়া, আমি তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না, কুমুদিনী। যেন ও এই নাগরিক সভ্যতাকে প্রশ্ন করতে চায়, কেন? কেন? কেন?-- মাঝে মাঝে ধন্ধে পড়ে যাই৷ একই সময়ে জয়া আর ওই মেয়েটা সত্যি হয় কী করে? জয়া যদি সত্যি হয় তা হলে তো ওই মেয়েটার মিথ্যে হয়ে যাবার কথা! আমাদের রাজনীতি যতদিন না ক্ষমতার অহংকারে মানুষের জীবন নিয়ে পাশাখেলা বন্ধ না করে ততদিন এই ফ্যালাসি বোধহয় চলতেই থাকবে। একরত্তি মেয়েটা প্রশ্ন করবে, কেন? আর সভ্য পৃথিবী বলবে, ওটা কয়েনের একটা দিক। অন্যদিকে জয়া আছে। যথাবিহিত সান্ত্বনা পেয়ে আমরা শান্ত হয়ে যাব। রাজনীতি আবার দ্বিগুণ উৎসাহে মানুষের জীবন বাজি রেখে পাশা খেলায় বুঁদ হয়ে যাবে।
আমার কথাগুলো কি খুব নৈরাশ্যবাদী বলে মনে হচ্ছে? তা হবে হয়তো। আমি তো তোমার মতো অপটিমিস্ট নই। আমার জীবনে একটা ভালো ঘটনা ঘটার পর একটার পর একটা খারাপ ঘটনা ঘটতে থাকে। স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা সইবার পর যখন নতুন করে শুরু করার কথা ভাবি ঠিক তখনই ফেলে আসা জীবনের ধুলো উড়িয়ে সময়ের ঘোড়া সামনে এসে দাঁড়ায়। সে সময়ের দাস কিন্তু তার গতি পিছন দিকে। এও এক ফ্যালাসি বই কী!-- না, আর হেঁয়ালি করব না। আসলে মনটা ভালো নেই। তোমাকে খুব ডাঁট দেখিয়ে বলেছিলাম, রুরু আর ফিরবে না। রুরু ফিরে এসেছে কি না জানি না, তবে কাল ওর একটা মেইল পেয়েছি। কী সব আবোলতাবোল কথা লিখেছে রুরু। আমি তার কিছুটা বুঝেছি, অনেকটাই বুঝিনি।
এখনও কোনও উত্তরও দিইনি। ওর মেইল তোমাকে ফরওয়ার্ড করে দিলাম। তুমি আমার ভাবী স্ত্রী। আমার জীবনের কোনও কথাই তোমার কাছে গোপন থাকতে পারে না। সুতরাং ভালো করে পড়ে আমাকে জানিও রুরু ঠিক কী বলতে চায়।
ভালো থেকো
অর্জুনদা
কলকাতা
প্রিয় অর্জুন,
অনেকদিন পর হঠাৎই তোমার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে হল। তার মানে অবশ্য এই নয় যে গত তিন বছরে তোমার কথা আমার মনে পড়েনি বা তোমার সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে হয়নি। বাট ইট ডিডনট মেক মি দ্যাট ক্রেজি টু পিক দা ফোন আপ ইমিডিয়েটলি অ্যান্ড কল ইউ। ইচ্ছে হয়েছে আবার অন্য পাঁচটা ইচ্ছের ভিড়ে হারিয়েও গেছে। কিন্তু কাল থেকে মনে হচ্ছে আই মাস্ট টক টু ইউ।
অবাক হচ্ছ? হও হও। দা হোল থিং ইজ আশটনিশিং টু মি অলসো। গত তিন বছরে যাকে হোয়াটসঅ্যাপে একটা মেসেজ পর্যন্ত করলাম না তাকে চিঠি লিখতে বসে পড়া অ্যাশটনিশিং বই কী! যাই হোক, আসল কথাটা বলি। আমি বিয়ে করছি অর্জুন। না, অমলকে নয়। হাউ কুড সামওয়ান বি মাই হাজব্যান্ড ইফ হি ডাজনট হ্যাভ এনি মিসট্রি। অমল ইজ লাইক মাই পেট। উঠতে বললে ওঠে, বসতে বললে বসে। কারণ থাক বা না থাক সবসময় লেজ নাড়ে। হরিবল! আমি বিয়ে করব বিনোদ সাকসেনাকে। হি ইজ আ নাইস গাই। হ্যান্ডসাম, রিচ, কালচার্ড। বিছানায় অ্যাট লিস্ট অমলের থেকে ভালো। বিনোদের এত কিছু আছে তবু কেন জানি না মনে হয় কী যেন নেই। আমরা সিমলিপালে বেড়াতে গেছি। খুব এনজয় করেছি। কিন্ত জানো অর্জুন, ও একটা পাখিরও নাম জানে না। চাঁদনি রাতে পাহাড়ি ঝরনার ধারে দাঁড়িয়ে ও আমাকে আদর করে কিন্তু আমার চোখে চোখ রেখে গালিবের কবিতা বলে না। মাই বুবস আর নট সোয়ানস টু হিম। আমি ওকে নিজের ভেতরে নিয়ে আজও সেই সেভেনথ হেভেনের সিঁড়িটা খুঁজি। কান পেতে অপেক্ষা করি কখন বিনোদ বলবে, কতদিন আমার রাজহংসীদের আদর করিনি। ওদের মুঠোয় নিইনি বলে আমার হাতটাই অপবিত্র হয়ে গেছে।
এরকম কেন হয় অর্জুন? কেন আমি বিনোদের মধ্যে তোমাকে খুঁজি? আমি তো কোনওদিনই তোমার কাছে ফিরব না। দ্যাট স্টোরি ইজ ওভার। আমি বিনোদের কাছে যাব। প্লিজ আমাকে পৌঁছে দাও।
ভালো থেকো।
রুরু
(ক্রমশ)

মন্তব্যসমূহ