রবিবাসরীয় সাহিত্যের দিন প্রতিদিন - সাহিত্যিক সন্দীপ চক্রবর্তীর অন্য ধারার গল্প গাঁথার ধারাবাহিক - " তুহু মম "

 রবিবাসরীয়   ধারাবাহিক 

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের নবীন লেখক সন্দীপ চক্রবর্তী । সন্দীপ লেখেন, নিজের অনুভুতি দিয়ে। সেখানে পাওয়া যাবে নিজেকে খুঁজে। বর্তমানে সন্দীপ একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের অন্যতম ।সন্দীপের  প্রতিটি অক্ষরের মাঝে লুকিয়ে থাকে সমাজের চালচিত্র। প্রতিদিন থাকছে  এই সমাজের কথকতা। একেবারে নতুন এক আঙ্গিক। একেবারে অন্য রকম আখ্যান গাথা  

                 তুঁহু মম / ৩৮        


 


সন্দীপ চক্রবর্তী


কলম্বো
শ্রীলঙ্কা
অর্জুনদা,
পাক্কা একুশ দিন পর তোমায় লিখছি। এর মধ্যে সাতদিন হাসপাতালে আর চোদ্দ দিন কোয়ারেন্টাইনে। ফোনে টুকটাক কথা হয়েছে কিন্তু তরিবত করে বসে প্রেমপত্তর লেখা হয়নি। এইটুকু না পেয়েই আমার প্রায় চুল ছেঁড়ার দশা। দেশলাই কাঠির জাত। বারুদে মাথা ঘষে পুড়ে না মরলে ভাত হজম হয় না। জয়া খুব ভালো সার্ভিস দিয়েছে কী বলো! তোমার সঙ্গে ফোনে কবে কী কথা হয়েছে তার সব রিপোর্ট আমায় দিয়েছে। আর যে চিঠিটা তুমি ওকে লিখেছ সেটাও দেখেছি। খুব সুন্দর লিখেছ। আমি অবশ্য ঠাট্টা করতে ছাড়িনি। মিছিমিছি বলেছি, ওমা এ তো প্রেমপত্র। অর্জুনদা খুব পাজি তো! জয়া হি হি করে একচোট হেসে বলল, আমাগো দ্যাশে একখান কথা আসে। চোরের মন বোঁচকা পানে! অর্জুনদার লগে আমার ভাইবোনের সম্পর্ক। এহানে নাক গলাইতে আইলে নাক কাইট্যা শূর্পণখা বানাইয়া দিমু। জয়া সাধারণত ঢাকার ভাষায় কথা বলে। ঢাকা আর কলকাতার ভাষা মোটামুটি একই। সেদিন ঠাট্টা করবে বলেই বোধহয় ডায়ালেক্টে কথা বলছিল। শুনতে কিন্তু ভারী মিষ্টি লাগছিল। মনে হচ্ছিল কোনও এক জন্মে আমিও হয়তো এই সুরে, এই টানে কথা বলতাম। তুমিও হয়তো ছিলে। যশোর খুলনার কোনও কোর্টে ওকালতি করতে। ওদিকে মেয়েদের হাইস্কুলের তো অভাব নেই। ক্লাস টেনে পড়া দুদিকে বেণী ঝোলানো মানসী কী কল্পনা কী শিখারানি একুশ-বাইশ বছরের ভ্যাবলাগোছের উকিলবাবুর দিকে কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে থাকার পর টুপুস করে মাথাটি নামিয়ে এক দৌড়ে গোয়ালঘরের পাশের শর্টকাট দিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে যাচ্ছে--এমন একটা ছবি বোধহয় এখানে নেহাত বেমানান হবে না।
যাক, ঠাট্টাতামাশা অনেক হল। হাসপাতালে প্রথম কয়েকদিন তো জলের মাছকে ডাঙায় তুললে যেমন করে ঠিক তেমন খাবি খেয়ে কেটেছে। অক্সিজেনকে আমাদের দেশে প্রাণবায়ু কেন বলে করোনা আমায় বুঝিয়ে দিয়েছে। উফ কী কষ্ট কী কষ্ট! এক একদিন মনে হত আজকের রাতটা বুঝি আর কাটবে না। তোমার সঙ্গে আর আমার দেখা হবে না। তখন বিছানার গদিটাকে আঁকড়ে ধরতাম। ওই উথালপাথাল কষ্টের মধ্যেও আমার চোখে জল আসত। মরে যাচ্ছি বলে নয়, মরে যেতে চাই না বলে। বাঁচতে চাই বলে কাঁদতাম। অত জ্বরেও আমার জ্ঞান কিন্তু টনটনে৷ শুধু চোখদুটো কেমন যেন হয়ে গিয়েছিল। হাসপাতালের বড়ো বড়ো আলোগুলো ছাড়া চোখে কিছু দেখতুম না। মানুষের মুখ সব ঝাপসা। ইকরি মিকরি সিংহলী কথা কানে আসত। মানে কিছু না বুঝলেও মানুষ কথা বলছে শুনে ভরসা পেতুম। আশেপাশে অনেক করোনা পেশেন্ট। ওই কথাবার্তায় মিশে থাকা নার্সদের চাপা ভয় বুঝিয়ে দিত কিছুক্ষণ আগে একটা উইকেট পড়েছে! ভয়টা জলের মতো গ্লাস থেকে ছলকে পড়ে আমাকেও ভিজিয়ে দিত। আবার বিছানা আঁকড়ে ধরতুম। আমার উইকেট কাউকে দেব না। আমি সেঞ্চুরি করব। ডাবল সেঞ্চুরি করব। ট্রিপল করব। তারপর ক্লিন বোল্ড হলে চলে যাব৷ মোটকথা, করোনায় আমি মরব না। কিছুতেই না।
হুঁশগম্যি ফিরতে আলোর পাশে একদিন ভালোকেও দেখলুম। অর্থাৎ মানুষের মুখ দেখলুম। সে কী আনন্দ! যেন এতদিন কোনও এক পাণ্ডববর্জিত দ্বীপে আটকা পড়েছিলুম। ঈশ্বরের পাঠানো ডিঙি নৌকোয় চড়ে ফিরে এসেছি মানুষের মাঝখানে। ডাঃ মুরলীধরণকে ঈশ্বর বলব না তো কী বলব অর্জুনদা? জেঠু-জেঠু চেহারার মানুষটাই তো আমাকে যমের দক্ষিণদ্বার থেকে ফিরিয়ে এনেছেন। তোমাকে ভালোবাসার পুন্যি আমার মনে বেঁচে
থাকার একটা বুনো ইচ্ছেশক্তি বুনে দিয়েছে ঠিকই কিন্তু এই বিদেশ বিভুঁইয়ে অমন স্নেহচ্ছায়া না পেলে আমি বোধহয় এই মরণফাঁদ পেরিয়ে আসতে পারতুম না। মানুষটা শুধু ডাক্তারি করেই দায় সারতে পারতেন। কিন্তু তা না করে তিনি বুদ্ধের দেশ থেকে আসা এই অভাগী কুমুদিনী মিত্তিরের রোগমুক্তির জন্য ভগবান বুদ্ধের কাছে প্রার্থনাও করেছেন। তাই যেদিন ডাঃ মুরলীধরণ বললেন, 'দুষ্টু ভাইরাসটাকে তুমি হারিয়ে দিয়েছ কুমদিনী। এখন শুধু চার্ট মেনে খাওয়াদাওয়া আর বিশ্রাম।-- সেদিন আমি কিছুতেই স্থির থাকতে পারিনি। ওর হাতদুটো জড়িয়ে ধরে বলেছিলুম, 'ভাইরাসটা আমার কাছে হেরেছে ডকটর। আর আমি হেরেছি আপনার কাছে। শ্রীলঙ্কায় এসে সাবিত্রী আম্মাকে পেয়েছি, আপনাকেও পেলুম। এই দেশ আমার সেকেন্ড মাদারল্যান্ড হয়ে গেল।' আমি কি কিছু ভুল বলেছি অর্জুনদা? বিদেশে এমন রংবেরংয়ের ছায়া ক'জন পায় বলো? এই দেশে এসে তোমাকে পেলুম, সাবিত্রী আম্মার বকা খেলুম, আবার করোনার চোখ রাঙানির দিনে ডাক্তারবাবুর স্নেহময় হাতটি নেমে এল আমার কপালে--আমার ঝুলি তো ভরে গেল অর্জুনদা! এরপর যা পাব রাখব কোথায়!
কাল বাড়ি ফিরেছি। হ্যাঁ অর্জুনদা, এই জায়গাটাকে আর লেডিজ গেস্ট হাউস বলে মনে হয় না, বাড়ি মনে হয়। কলকাতায় থাকলে মা যেমন হাউমাউ করে রোগাভোগা মেয়েটার দিকে ছুটে আসে, এখানে ঠিক তেমনটাই করে সাবিত্রী আম্মা। হেসে কেঁদে বকা দিয়ে কিংবা বাবা বাছা করে বুঝিয়ে আমাকে টাইমে টাইমে ভালোমন্দ খেতে বাধ্য করে। আম্মার দলে জয়াও আছে। আমার সামনে ডাঁট দেখায় কিন্তু কিচেনে গিয়ে বলে আসে, কুমু মটনের থেকে চিকেন বেশি পছন্দ করে। কাজের কথা ফিসফিস করে বলে অকাজের টিপ্পনীটা বেশ চিৎকার করে কাটে, 'হিন্দু কায়স্থের মেয়ে আর পণ্ডিতমশাইয়ের ভাবী বউ। তাই পাঁঠার মতো আনরোম্যান্টিক জীব ম্যাডামের মুখে রোচে না।' এই মেয়ে তোমার সঙ্গে ভাইবোনের সম্পর্ক পাতিয়েছে। কিন্তু ও আমার কে? ছোট বোন নয়? আমি কি কোনও দিন ওকে, 'শ্রীলঙ্কায় একটা সেমিনারে পেপার পড়তে গিয়ে আলাপ হয়েছিল' বলে উপেক্ষা করতে পারব? করোনা শুধু আমাদের সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং দেয়নি গো অর্জুনদা, সোশ্যাল অ্যাটাচমেন্টও দিয়েছে। অদ্ভুত এক ভোজবাজিতে ঘর আর পৃথিবীর মধ্যের ব্যবধানটা কমিয়ে দিয়েছে করোনা। এখন কুমু আর জয়া কত সহজে পিঠোপিঠি বোন হয়ে যায়। এ কী কম কথা!
আরও একজনের কথা বলা দরকার। সিদ্ধার্থ ধরমসেনা। তোমাকে তো ওর কথা বলেছি। প্রথম যখন ওকে দেখি তখন মনে হয়েছিল আমাদেরই বয়েসি বুঝি। পরে সাবিত্রী আম্মার কাছে শুনলুম ওর বয়েস বড়োজোর চব্বিশ-পঁচিশ। ওর বাবার মাছের ট্রলারের ব্যবসা। ভাড়া দিয়ে মোটা টাকা রোজগার। নিজে পড়াশোনা বেশি না করলেও ছেলেকে মুখ্যু করে রাখেননি। তোমার লাইনেই ওর পড়াশোনা। ইতিহাসে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করেছে। পরীক্ষা-টরিক্ষা দিয়ে এখন সরকারি গেস্ট হাউসের কেয়ারটেকার। মাইনেপত্তর মন্দ নয়। কিন্তু কথা সেটা নয়। আমার অসুখের সময় রীতিমতো একটা কাণ্ড বাধিয়েছে সিদ্ধার্থ। কুমু পাগলির প্রেমে পড়েছে!! জয়ার মুখে সব শুনে আমি তো হেসে বাঁচি না। করোনার প্রথম ধাক্কায় আমার শ্বাসকষ্ট যখন তুঙ্গে, তখন সিদ্ধার্থ নাকি গেস্ট হাউসের একতলার একটা ঘুপচি মতো ঘরে সারাদিন চুপ করে বসে থাকত। কারোর সঙ্গে কথাবার্তা বলা তো দূর, খাওয়াদাওয়াও ঠিকমতো করত না। সাবিত্রী আম্মা দু-একবার কারণ জানতে চাইলেও কিছু বলেনি। হাসপাতাল থেকে ফিরে জয়া একদিন দেখে সিদ্ধার্থ ঘরের ভেতর অস্থির ভাবে পায়চারি করছে। অস্বাভাবিক মনে হওয়ায় জয়া জিজ্ঞাসা করে, 'হোয়াট হ্যাপেনড সিদ্ধার্থ? আর ইউ ওকে?' সিদ্ধার্থ অন্যমনস্ক ভঙ্গীতে বলে, 'লর্ড বুদ্ধা ক্যান নট বি সো ক্রুয়েল!' সেদিন আর কোনও কথা হয়নি। তারপর একদিন আমার প্রসঙ্গ ওঠায় সিদ্ধার্থ নাকি কোনও কারণ ছাড়াই জয়াকে বলে, 'ইয়োর ফ্রেন্ড ইজ আনকাট ডায়ামন্ড। আই লাইক হার।' জয়াটা তো একের নম্বরের বিচ্চু। সিদ্ধার্থর চোখ দেখেই নাকি ও বুঝে গিয়েছিল যে সে কুমুদিনী মিত্তিরের প্রেমে একেবারে হাবুডুবু খাচ্ছে। তাই ভাজা মাছ উলটে খেতে জানে না গোছের মুখ করে জানতে চেয়েছিল, 'শুধু লাইক করো নাকি সাবস্ক্রাইবও করতে চাও?'-- কথাটা তোমাকে লিখতেও লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছে। ছি! যাই হোক, সিদ্ধার্থ এসব ঘোরপ্যাঁচের কথা একটুও বুঝতে পারেনি। জয়া মেমসাহেব আর কথা না বাড়িয়ে তোমার কথা বলে সিদ্ধার্থকে নিরস্ত করেছে। পরে আমার সঙ্গেও কথা হয়েছে ওর। আমিও বুঝিয়েছি। বুঝেছে বলেই তো মনে হল। এরা কী বলো তো! প্রেম কি এত সহজ? গোমুখের পাহাড় থেকে আঁকুপাঁকু করে মাটিতে নেমে পড়লেই তো আর গঙ্গা হওয়া যায় না। গঙ্গা হতে গেলে সবার সব পাপ ধুয়ে সবাইকে দেবতা করে তুলতে হয়। সিদ্ধার্থ ভালো ছেলে। আমি চাই ওর জীবনে ভালো একটা মেয়ে আসুক৷ তাকে বিয়ে করে ও সুখী হোক। আমি না হয় আসব মাঝে মাঝে। বড়ো দিদির মতো থাকব কয়েকদিন ওদের বাড়িতে। এসব কথাই বলেছি। গোড়ায় মুখ গোমড়া করে বসে থাকলেও পরে হেসেছে। ভুলভাল প্রেমের বরফও গলে ঝরনা হয়ে গেছে।
এবারের লেখায় পাড়াপড়শির কথাই বেশি হল। আমাদের কথা হল না। শুধু একটা কথা। জয়ার কাছে শুনলুম ক'দিন খুব টেনশন করেছ৷ তুমি কি ভেবেছিলে করোনায় আমি মরে যাব? সে গুড়ে বালি! তোমার বউ না হয়ে আর আমোদিনীর মা না হয়ে আমি মরব না। কোটি টাকা দিলেও উইকেট ছাড়ব না।
ভালো থেকো।
কুমুদিনী
- ক্রমশঃ

মন্তব্যসমূহ