রবিবাসরীয় সাহিত্যের দিন প্রতিদিন - সাহিত্যিক সন্দীপ চক্রবর্তীর অন্য ধারার গল্প গাঁথার ধারাবাহিক - " তুহু মম "

  রবিবাসরীয়   ধারাবাহিক 

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের নবীন লেখক সন্দীপ চক্রবর্তী । সন্দীপ লেখেন, নিজের অনুভুতি দিয়ে। সেখানে পাওয়া যাবে নিজেকে খুঁজে। বর্তমানে সন্দীপ একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের অন্যতম ।সন্দীপের  প্রতিটি অক্ষরের মাঝে লুকিয়ে থাকে সমাজের চালচিত্র। প্রতিদিন থাকছে  এই সমাজের কথকতা। একেবারে নতুন এক আঙ্গিক। একেবারে অন্য রকম আখ্যান গাথা  

                 তুঁহু মম / ৩৬        


 


সন্দীপ চক্রবর্তী



কলম্বো
শ্রীলংকা
অর্জুনদা,
আজ সকাল থেকে জ্বর। যদিও খুব বেশি না, সাড়ে আটানব্বই মতো। কোভিডের অন্য উপসর্গও নেই। তবুও আমি প্যারাসিটামল খেয়ে নিয়েছি। ডাক্তার হিসেবে মনে হচ্ছে ঠাণ্ডা লেগে জ্বর। ভয়ের কিছু নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভয় করছে। আমার মনে যে পাগলিটার বাস, ভয় দেখাচ্ছে সে-ই। বিশেষ করে তোমার রূপকথার কথা জানার পর ভয়টা আরও বেড়ে গেছে।
তোমার সঙ্গে আমার দেখা হবে তো অর্জুনদা?
সকাল থেকে এই প্রশ্নটাই মাথায় ঘুরছে। যদি কোভিড হয়! আমি এরকম ছিলুম না। ক্লাস নাইনে আমার অ্যাপেন্ডিসাইটিস অপেরেশন হয়েছিল। আমাকে ট্রলিতে চাপিয়ে ওটিতে নিয়ে যাবার সময় মা খুব কান্নাকাটি করেছিল। আমার যথারীতি কোনও ভয়ডর নেই। মাসতুতো বোন দীপুর সঙ্গে খুব মজা করছি। যেন ওটিতে লোকে সেলফি তুলতে যায়। মনে আছে, বলেছিলুম, কাঁদছ কেন মা! আমার কিচ্ছু হবে না। এখন তো জুলাই, ফিরে এসে অক্টোবরে পুরী বেড়াতে যাব। সেবার সত্যি সত্যি আমাদের পুরী বেড়াতে যাবার কথা ছিল। গিয়েওছিলুম। সে কী আনন্দ বলে বোঝাতে পারব না। সার্জিকাল ছুরিকাঁচির জঙ্গল থেকে বেরিয়ে সমুদ্রের বুকে আশ্রয় নেবার মধ্যে একটা আদি রসাত্মক ফিলিং আছে। মনে হয় যেন একজন প্রবল পুরুষ ছিঁচকাঁদুনে মৃত্যুর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আমায় আদর করছে। তখন বয়েস কম, এ হেন কসমিক অর্গাজমের স্বাদগন্ধ অতটা বুঝিনি। বুঝলুম কলেজে গিয়ে। কারণ সেবার হঠাৎ জানা গেল আমার ইউটেরাসে টিউমার হয়েছে। ও মা সে কী কথা! এইটুকু মেয়ে! বাঁঁচবে তো?--এইসব বলে-টলে আত্মীয়স্বজনেরা ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমার মা জননী তো আত্মীয়বাণী শুনে যথারীতি ভয়ে ফ্যাকাসে। যদিও ডাক্তারবাবু বলে দিয়েছিলেন বিনাইন টিউমার, ভয়ের কিছু নেই। অর্থাৎ, টিউমারটি আদ্যিকালের অম্বল-গ্যাসে ভোগা বাঙালি বৃদ্ধের মতো আমার ইউটেরাসকে দেওঘর বা মধুপুর ধরে নিয়ে সেখানেই থাকবেন। গতর সামান্য নেড়ে আশেপাশের জায়গাগুলো দেখার জন্য তিন মাসের কনট্র্যাক্টে নেওয়া ঘরের বাইরে যাবেন না। কিন্তু মা'কে এসব কথা কে বোঝাবে! তিনি টেনশন করার জন্য পৃথিবীতে এসেছেন, টেনশনই করবেন। আগে ছিল স্বামী এবং কন্যা। এখন শুধুই কন্যা। ভয় আমারও একটা ছিল। একদিন মা চেম্বার থেকে বেরনো মাত্র লজ্জা-শরম বিসর্জন দিয়ে ডাক্তার সুধন্য সরকারকে কথাটা জিজ্ঞাসা করেই ফেললুম, আচ্ছা ডাক্তারবাবু, অপারেশনের পর আমার ক্যারি করতে কোনও অসুবিধে হবে না তো? তখন ডাক্তার সরকারের বয়েস চল্লিশ-বিয়াল্লিশের বেশি হবে না। বেশ হ্যান্ডসাম চেহারা। হাসিটা উত্তম কুমারের মতো ভুবনভোলানো না হলেও মেয়েপটানো বলা যেতে পারে। ডাক্তার সরকার হেসে বললেন, কোনও ভয় নেই। ইউ উইল বি আ লাভলি মাদার। কাণ্ডটা ভেবে দেখো একবার। তখন কুমু পাগলির জীবনের পাঁচ হাজার মাইলের মধ্যেও তুমি নেই। অথচ মা হতে পারব কিনা সেই ভাবনায় আমার ঘুম হচ্ছিল না। শুধু কি তাই! ক্যারি করতে বাধা নেই শুনে অপার আনন্দে আমার সেই ভাবী সন্তানের নাম পর্যন্ত ঠিক করে ফেলেছিলুম। কুমু পাগলির কী হবে? মেয়েই তো হবে। তারই মতো কালোকুচ্ছিত অ্যাংলা কাঙলা মেয়ে। যে খুব লেখাপড়া করবে আর একটুআধটু গানও গাইবে। কী নাম হবে মেয়ের? আমোদিনী হলে কেমন হয়। বেশ হয়। মায়ের মতো দুঃখকে ভেংচি কাটতে পারা চাই তো! আমোদিনী ওসব খুব পারবে। পারবেই পারবে।
কিন্তু বিশ্বাস করো অর্জুনদা, এবার সেই ভেংচি কাটার জোরটা নেই। ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে ডাক্তার আর পাগলির মধ্যে ঝগড়া চলছে। ডাক্তার বলছে, ধুস এটা আবার জ্বর নাকি! একটা প্যারাসিটামলেই বাপ বাপ বলে পালাবে। কিন্তু পাগলির কান্নার শেষ নেই। কোভিড হলে যেখানে গায়ের তাপে জল ফুটে যায় সেখানে মাত্র সাড়ে আটানব্বই জ্বরের পুঁজি নিয়ে আমি ভাবছি এতদিন কলম্বো বন্দরে যেসব জাহাজ এমনি-এমনি ডাকত, তারা বুঝি এবার আমাকে না নিয়েই মাঝ সমুদ্রের তেপান্তরে হারিয়ে যাবে। আমার আর তোমাকে পাওয়া হবে না। হয়তো প্যারাসিটামলে কাজ হবে না। জ্বর আরও বাড়বে। শ্বাসকষ্ট হবে। তারপর কোয়ারেন্টাইন। অক্সিজেন সিলিন্ডার। নেবুলাইজার। প্লাস্টিকের ব্যাগ। ছয় বাই চার গর্ত। অন্ধকার৷ তারপর পিন ড্রপ সাইলেন্স।--জীবন এত ছোট কেন গো অর্জুনদা।
তুমি ভাবতে পারো হঠাৎ এমন উচাটন হয়ে পড়লুম কেন? সে কি মৃত্যুভয়ে? হ্যাঁ গো। মরে যাবারই তো ভয়। আগে কখনও মরার ভয় পাইনি বলে এখন পাব না! আগে আমার কী ছিল বলো? ক'টা বইখাতা, একটা হারমোনিয়াম আর একটা রুগি দেখার চেম্বার। অর্থ বলো, যশ বলো সবই তো পার্থিব। আজকের তরুণ যশস্বী কাল বৃদ্ধ হয়ে নবীনের দিকে কাঙালের মতো চেয়ে থাকে। হয়তো ভাবে আমারও সূর্যোদয় ছিল কিন্তু আজ সেই সূর্য অস্তাচলে যাবার জন্য ব্যাকুল। দিনান্তের গেরুয়া আলোয় ডুবে যাওয়া প্রাসাদের দিকে তাকিয়ে সম্রাটকেও দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হয়৷ কারণ যা কিছু পার্থিব পৃথিবীর সিন্দুক থেকে তাকে বের করার অনুমতি কারোর কাছে নেই। একমাত্র অপার্থিব মৃত্যুর সঙ্গী হতে পারে৷ আর আমার জীবনে অপার্থিব মানে তুমি। যেদিন তুমি আমায় বিয়ে করার কথা বলেছিল সেদিনই নিজেকে মনে মনে বলেছিলুম, তোকে অন্তত একশো বছর বাঁচতে হবে কুমু। নয়তো অর্জুনদার সঙ্গে শুধু সংসার করা হবে, বাঁচা হবে না। কত রকম ভাবে বাঁচা যায় বল তো? মেয়ে হয়ে, বউ হয়ে, মা হয়ে, প্রেমিকা হয়ে, বন্ধু হয়ে, মানুষ হয়ে-- তোকে সব হতে হবে। যাকে পেয়েছিস সে মানুষটা বড়ো ছড়ানো-ছিটনো। যে মানচিত্রেই রাখিস না কেন তাকে সমুদ্রের মতো লাগে। গণ্ডি কেটে তাকে বাঁধতে চাইলে ভুল করবি। সে তোর পেতলের ঘটিতে আপনিই ধরা দিতে চায়। এ কী তোর কম ভাগ্যি!
আমার এমন কপাল ফেরার দিনে যদি মিছিমিছি মরে যাই তা হলে তার থেকে আক্ষেপের আর কী বা হতে পারে! করোনার সময়ে জ্বর সাড়ে আটানব্বই বলে সে তো আর ফেলনা নয়। বামনের দৈত্য হতে আর কতক্ষণ! সাবিত্রী আম্মা নেই বলে সিদ্ধার্থ ধরমসেনা নামের একটা শ্রীলংকান ছেলে আমাদের খুব দেখভাল করছে। ইংরিজিটা দিব্যি বলে, হিন্দি ভাঙা ভাঙা। আমার টেম্পারেচার সাড়ে আটানব্বই শুনে বলল, ইউ শুড চেক ইয়োর অক্সিজেন স্যাচুরেশন এভরিডে। তা তো বটেই। ওকে দিয়েই আনিয়ে নিলুম একটা অক্সিমিটার। তারপর থেকে অক্সিজেন দেখা চলছে। সবই ঠিকঠাক। তবু ভয় করোনা হবে না তো? চারিদিকে এত মৃত্যু, এত চোখের জল। মাঝখানে কুমু পাগলি তার ঘটিভরা সমুদ্দুর কেমন করে বাঁচাবে সেই চিন্তায় অস্থির। তার একদিকে রুরুর ফিরে আসার ভয়, অন্যদিকে করোনার ভয়। জানি না চোখের জলের মতো দেখতে এই দেশটায় এসে আমাকে শেষ পর্যন্ত চোখের জলই ফেলতে হবে কিনা!
আশীর্বাদ করো অর্জুনদা। যেন সেরে উঠতে পারি। যেন তোমার বউ হতে পারি। যেন আমোদিনীর মা হতে পারি। শালগ্রাম শিলা খুঁজে পাওয়ার পর আর অলক্ষ্মী হয়ে থাকতে ইচ্ছে করে না। আমার মা সারাজীবন যা চেয়েছে ঠিক সেরকম লক্ষ্মী হতে ইচ্ছে করে।
ভালো থেকো
কুমুদিনী
(ক্রমশ)

মন্তব্যসমূহ