রবিবাসরীয় সাহিত্যের দিন প্রতিদিন - সাহিত্যিক সন্দীপ চক্রবর্তীর অন্য ধারার গল্প গাঁথার ধারাবাহিক - " তুহু মম "

 রবিবাসরীয়   ধারাবাহিক 

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের নবীন লেখক সন্দীপ চক্রবর্তী । সন্দীপ লেখেন, নিজের অনুভুতি দিয়ে। সেখানে পাওয়া যাবে নিজেকে খুঁজে। বর্তমানে সন্দীপ একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের অন্যতম ।সন্দীপের  প্রতিটি অক্ষরের মাঝে লুকিয়ে থাকে সমাজের চালচিত্র। প্রতিদিন থাকছে  এই সমাজের কথকতা। একেবারে নতুন এক আঙ্গিক। একেবারে অন্য রকম আখ্যান গাথা  

                 তুঁহু মম / ৩৫        


 


সন্দীপ চক্রবর্তী


রাখিগঢ়ি
হরিয়ানা
কুমুদিনী,
তোমার খ্যাপার বৃত্তান্ত পড়ে একটু ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। কে জানে কে আবার আমার মাটির ঘরে সিঁধকাঠি লাগাল। বারবার সর্বস্বান্ত হলে যে কোনও মানুষই ডাকাতদের ভয় পায়। সেই মানুষটি যদি আমি হই তা হলে তো কথাই নেই। আমার জীবনের সঞ্চয় অতি সামান্য। জীবন ভালোবেসে আজ যা দেয়, কাল ভালোবেসেই তা চেয়ে নিয়ে যায় দূর কোনও বিদেশবিভূঁইয়ে খরচ করবে বলে। যেতে যেতে একা দাঁড়িয়ে থাকি। আবার কীসের তাগিদে কে জানে গণ্ডি পেরিয়ে চলেও যাই। নিজের চারপাশে গণ্ডি টানতে যেমন আমার ভালো লাগে ঠিক তেমনই আনন্দ পাই গণ্ডি মুছতেও। কী যে চাই নিজেও জানি না। তবে ভাগ্যিস জানি না। জানলে গণ্ডির মধ্যেই কাটিয়ে দিতাম জীবনটা। রুরু চলে যাবার পর আমার পোড়া ভিটেতে দিনে ঘুঘু আর রাতে শেয়ালই ডাকত, তোমার হাতের প্রদীপ কখনও জ্বলত না। আজ আমি আবার যখন সেই আলোয় স্বপ্ন দেখছি, যখন ভাবছি আমার নতুন পাওয়া এই ঘরের দেওয়ালে কী থাকবে--পাহাড় না সমুদ্র--নাকি দেওয়ালই থাকবে না--তখন খ্যাপাবাবুর মতো কেউ পাশ কাটিয়ে ঢুকে পড়লে ভয় তো হয়ই। হাজার হোক ঘর পোড়া গোরু তো! সিঁদুরে মেঘেই তার যত ভয়। তবে শেষ পর্যন্ত যে ভয়টা ভয় হয়ে থাকেনি, হাসিঠাট্টার কাছে হার মেনে দখল ছেড়েছে সেটাই যা রক্ষে! আরেকবার দাগা খেলে সেই দাগ হাজারবার ধুলেও যেত না। আমাকেও বাকি জীবনটা দাগি হয়ে জীবনের কয়েদখানায় কাটাতে হত। তুমি পাঞ্চালকন্যা দ্রৌপদীর মতোই রমণীরত্ন। তাই একটি কথা সবসময় মনে রাখতে অনুরোধ করি। একবিংশ শতকের এই অর্জুনের ভাগ্য দ্বাপরের অর্জুনের মতো তত ভালো নয়। আমার মতে মহাভারতে কৌরবপক্ষের সব থেকে শক্তিশালী যোদ্ধা ছিল কর্ণ। তাকে সুতপুত্র-ফুতপুত্র বলে হতোদ্যম করে দিলেন ভীষ্ম। কর্ণকে লোয়ার অর্ডারে নামাতে বাধ্য হল দুর্যোধন। কর্ণ যখন যুদ্ধ করতে এল ততক্ষণে ভীষ্ম আর দ্রোণের মতো যোদ্ধাকে হারিয়ে মনে মনে হার মেনে নিয়েছে কৌরব বাহিনী। তাতে সুবিধে হল পাণ্ডবদের। বিশেষ করে অর্জুনের। তার ওপর কর্ণের রথের চাকা স্কিড করে গর্তে পড়ল এবং সেই রথকে আর ঠিক করা গেল না। অর্জুনের
ভাগ্যটা একবার দেখো। কৃষ্ণের মতো একজন গ্রেট
ডিপ্লোম্যাট সঙ্গে ছিলেন বলে শস্তায় বাজিমাত করতে পেরেছিল অর্জুন। সেও ভাগ্য। কিন্তু তোমার খ্যাপার সঙ্গে যদি আমার যুদ্ধ হয় তা হলে ঠিক উল্টোটা ঘটবে। আমারই রথের চাকা স্কিড করবে। গর্তে আমিই পড়ব। কৃষ্ণও এবার হয়তো খ্যাপার সঙ্গেই থাকবেন।
যাই হোক, রসিকতা অনেক হল। এবার কাজের কথা। কাল ভারত সরকার লক ডাউন শিথিল করার কথা ঘোষণা করেছে। লক ডাউন-পরবর্তী এই সময়টার একটা অদ্ভুত নামও শুনছি। নিউ নর্মাল। শ্রীলংকার কী খবর? ওখানে নিউ নর্মাল কবে থেকে শুরু হবে কিছু জানো? ফান্দে পড়িয়া বগা আর কতদিন কাইন্দবে বলো দেহি! তুমি যদি খবর জোগাড় করতে না পারো, আমি এখানে সেই চেষ্টা করতে পারি। আমার এক বন্ধু ফরেন অ্যাফেয়ার্স ডিপার্টমেন্টের বড়ো অফিসার। তোমার সঙ্গে কথা না বলেই আমি কাল ওকে একটা মেইল করেছি। আজ সকালে ও জানিয়েছে দিল্লির শ্রীলংকান এমব্যাসির সঙ্গে কথা বলবে। যতদূর জানি ভারত সরকার বিভিন্ন দেশে আটকে পড়া নাগরিকদের দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করতে চাইছে। মনে হয় খুব শীগগির স্পেশাল শিপ বা প্লেনে তোমাদের ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হবে। আমার বন্ধু সেই ইঙ্গিতই দিয়েছে। মোট কথা এই বন্দি জীবন আমার আর ভালো লাগছে না। গোটা পৃথিবী যেন একটা নেতা ধোপানির ঘাটে পরিণত হয়েছে। সেখানে শুধু একটার পর একটা মৃতদেহ আসছে। আর পিপিই জ্যাকেট পরা যমদূতেরা প্রতিটি ডেডবডি প্লাস্টিক ব্যাগে ভরে কোথায় যে ফেলে দিয়ে আসছে ভগবানই জানেন। এই ধ্বংসস্তূপ পেরিয়ে আমি তোমার কাছে যেতে চাই। তোমাকে কাছে পেতে চাই। পৃথিবীকে নেতা ধোপানির ঘাট থেকে আবার মনমেলান্তির ঘাটে ফিরিয়ে আনতে চাই।
অনেক কাজ পড়ে আছে কুমুদিনি। কলকাতায় যেতে হবে। পুরনো ফ্ল্যাট বিক্রি করে নতুন ফ্ল্যাট কিনতে হবে। ছুটি যখন ফুরিয়েই গেছে তখন আর তার মায়া বাড়িয়ে লাভ নেই। যে অতীত এখন কেবল বুড়ো হবে তাকে হিসেবের মধ্যে রাখতে আমি ভালোবাসি না। স্মৃতি ততক্ষণই সুন্দর যতক্ষণ সে নতুন কিছু করার শক্তি জোগায়। রুরু চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছুটির প্রয়োজন ফুরিয়েছে। এবার যে ফ্ল্যাট কিনব তার নাম দেব রূপকথা। খেলাঘর আর ছুটির পর রূপকথা। তুমি আমার রূপকথার নায়িকা নাকি নিজেই একটা রূপকথা, আমি জানি না। শুধু এইটুকু জানি তোমার মতো নারীর ভালোবাসা পেলে পুরুষমানুষের একরৈখিক জীবন রূপকথা হয়ে যায়। আমি এখন রূপকথাতেই ডুবে আছি। এবং ডুবে থাকব সারা জীবন।
সুতরাং আমাকে হারিয়ে ফেলার ভয় ত্যাগ করো। জীবনের কোনও সম্মোহনেই তোমাকে হারিয়ে ফেলার দুর্মতি আমার হবে না বলে আমাকে হারিয়ে ফেলার যে ভয়ে তুমি কাতর, সেটা অমূলক।
ভালো থেকো
অর্জুনদা

মন্তব্যসমূহ