রবিবাসরীয় বেহালার দিন প্রতিদিন এ কাজল ভট্টাচার্যের বিশেষ কলম - সাপ খেলা

 কাজল ভট্টাচার্যের বিশেষ কলম 

   সাপখেলা 




কাজল ভট্টাচার্য

সবাই খেলাটা দেখছে।
পয়সা ফেকো তামাশা দেখো। এখানে পয়সাও লাগছে না। ফোকটে সীমাহীন আনন্দ। কেউ মুখের মধ্যে দু আঙ্গুল পুরে সিটি বাজাচ্ছে। কেউ উত্তেজনায়  চেঁচিয়ে উঠছে- 'দে এবার রামপ্যাঁচ।' অজগরটাও একেবারে পাকে পাকে জড়িয়ে ধরছে মানুষটাকে। অজগরতো নয়, যেন এক তীব্র ঘৃণা! গোটা মানুষটাকে পারুক না পারুক, মানুষটার জীবনকে গিলে খাবেই। তার আগে একটু খেলিয়ে নেওয়া। ঠিক যেভাবে ইঁদুরকে পেটে চালান করার আগে, তাকে খেলায় শিকারি হুলো। কখনও রসিকতা করে যেন নিতান্ত অবহেলায়, পাক শিথিল করছে অজগর। মানুষটার মুখের কাছে মুখ নামিয়ে ফিসফিসিয়ে অজগর বলছে- 'দেখ, কেমন লাগে তোর সুন্দর এই পৃথিবীটাকে।'

সবাই দেখছে। তামাশা জমে গেছে। ঘটনা যা ঘটছে, তাকে অজগর, মানুষের লড়াই বলা যায় না। কারণ সাপের পাক শিথিল হতেই মানুষটা একটু ছটফট করছে।  কিন্তু অজগরকে পাল্টা দেওয়া তো দূরের কথা, বাঁচার কোনও চেষ্টাই করছে না মানুষটা। 
- 'পালা পালা,' চেঁচিয়ে উঠছে অনেকে।

যত খবর ছড়াচ্ছে, তত ভিড় বাড়ছে। ফোকটে তামাশা দেখার মজা কে ছাড়ে? ভিড়টা ভাগাভাগি হয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনেই শক্তিধর অজগরের দিকেই বেশি মানুষ। আর ক্রমেই নিস্তেজ হয়ে আসা মানুষটার দিকে কম মানুষ। তবু থেকে থেকেই উল্লাসে ফেটে পড়ছে দু'পক্ষ।
- 'শক্ত করে চাপ। আরও চাপ।'
- 'বেটার জিভ ঝুলে গেছে।'
অজগরের কান হয় না। সে কিছুই শুনতে পায় না। সে কিছুই বলে না, কিছুই দেখে না। সবকিছুর উর্ধ্বে সে। সে শুধু মনোযোগ দিয়ে নিজের কাজটা করে যায়। একবারে শিকার নিধন করলে আর মজা কী? ধীরে ধীরে রইয়ে সইয়ে, খেলিয়ে মারতে হবে। তবেই না মজা!

- 'বোঝ এবার অজগরকে পোষ মানানোর ঠেলা!' ভিড় থেকে কোনও একজন চেঁচিয়ে উঠলো।
পোষমানা অজগরের বেইমানিতে অবাক মানুষটা। সাপমাত্রই ঠান্ডা রক্তের। আর এই অজগরটাও স্বভাবেও শান্ত। একেবারে কুল কুল। হুবহু বাবুরাম সাপুড়ের সেই সাপের মতো- করে নাকো ফোঁসফাঁস/ মারে নাকো ঢুসঢাস। এই অজগরটাই এতদিন কোলে, পিঠে উঠে খেলা করতো। পাকেও জড়াতো। 'সাপও ভালবাসা বোঝে', ভাবতো ছন্নছাড়া মানুষটা- 'মানুষ বোঝে না।'

আদর যত্নে বেড়ে উঠছিল সাপটা। রোজ  সে মানুষটার শরীরে পাক মেরে দেখতো, ধড়তাই ঠিকঠাক হচ্ছে কিনা। আর ঠিক কতটা বড় হলে মানুষটাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরা যাবে। অজগরের এই মাপামাপিকে আদর ভাবতো আহাম্মক মানুষটা। অজগরের মনে যে তখন একটু একটু করে বিষ জমছে, ঘুণাক্ষরেও তা টের পায়নি মানুষটা। উল্টে সে চোখবুজে অজগরের আদর খেতো। অজগরকে আদর দিতো।

যন্ত্রণায় নীল হয়ে গেছে মানুষটা। মুখে টু শব্দটি নেই। শুধু শরীরটাই না, ততক্ষণে হয়তো মনটাও অসাড় হয়ে গেছে মানুষটার। সে যতো নিস্পন্দ হয়ে আসে, ততই যেন মজা পায় অজগরটা। কখনও সে বাঁধন আলগা করে। রাস্তার ধুলায় গড়াগড়ি খায় মানবশরীর। অজগরটা তার জিভ দিয়ে ছুঁয়ে দেখে। তখনও হঠাত করে হাত বা পা নড়ে ওঠে মানুষটার। হইহই করে ওঠে ভিড়।
- বেঁচে আছে মানুষটা। এখনও প্রাণ আছে।
- শালা যমের অরুচি। 
অজগর হাসে কিনা জানি না। তবে ফের পড়ে থাকা মানুষটার শরীরে পাক মারে। চাপা একটা শব্দ ওঠে- মড়মড় করে। 
- এহ, হাড্ডিগুড্ডি সব চুরচুর করে দিচ্ছে।
- এবার গিলে খাবে।
ঘটনা ক্লাইম্যাক্সের দিকে এগোচ্ছে। বিস্ফারিত চোখ ভিড়ের। উৎসাহ, কৌতুক যেন উপচে পড়ছে।

- 'যাহ বেটা, এবার বোঝ।'
অজগর তার মুখটা নামিয়ে নিয়ে এলো মানবশরীরের মুখের কাছে। কোনও এক উৎসাহী দর্শক হাততালি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো- 'হামি খেয়ে মানুষটার ঋণ শোধ করবে অজগর।' সেই রসিকতায় হাসির রোল উঠলো। এতদিনের প্রেম তো! তাই গেলার আগে একবার ঠোঁটে ঠোঁট অজগর, মানুষের।
ঘননীল মানুষটার চোখ, নাক, কান, মুখ দিয়ে তখন রক্ত গড়াচ্ছে। ফেটে বেরিয়ে আসছে চোখ দুটো। যন্ত্রণায় বিস্ফারিত চোখ যেন কিছু বলতে চাইছে।

ক্লাইম্যাক্সের উত্তেজনা। অজগরটা কিন্তু নিজের কাজে মত্ত। কোনদিকে তার কোনও ভ্রুক্ষেপই নেই। এমন সময় হঠাতই একটা ইটের টুকরো পড়লো অজগরের গায়। হতবাক ভিড়। 
কে এই স্পর্ধা দেখালো? মুহূর্তের জন্য ভিড়ের দিকে ঘুরে তাকালো অজগর। ব্যাস অমনি পালানোর হিড়িক পড়ে গেলো। অনেকদূরে দাঁড়িয়ে ভিড়টা ঘটনার আচমকাই পালাবদল দেখছে।
 
রাস্তায় তখন একা দাঁড়িয়ে এক কিশোর। হাতে তার কুঠারের বদলে গাছের ভাঙা এক ডাল। অজগরটাও চমকে গেছে। সামান্যতম প্রতিবাদের আঁচ পেলেই ঘৃণা থমকে দাঁড়ায়। 
অজগরটার চোখে চোখ রেখে এগিয়ে গেলো কলির পরশুরাম।

ছবি সৌজন্যঃ সংগৃহীত

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন