রবিবাসরীয় সাহিত্যের দিন প্রতিদিন - সাহিত্যিক সন্দীপ চক্রবর্তীর অন্য ধারার গল্প গাঁথার ধারাবাহিক - " তুহু মম "

 

 রবিবাসরীয়   ধারাবাহিক 

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের নবীন লেখক সন্দীপ চক্রবর্তী । সন্দীপ লেখেন, নিজের অনুভুতি দিয়ে। সেখানে পাওয়া যাবে নিজেকে খুঁজে। বর্তমানে সন্দীপ একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের অন্যতম ।সন্দীপের  প্রতিটি অক্ষরের মাঝে লুকিয়ে থাকে সমাজের চালচিত্র। প্রতিদিন থাকছে  এই সমাজের কথকতা। একেবারে নতুন এক আঙ্গিক। একেবারে অন্য রকম আখ্যান গাথা  

                 তুঁহু মম / ৩২        


 


সন্দীপ চক্রবর্তী

কলম্বো
শ্রীলঙ্কা
অর্জুনদা,
আমার হিমকাতুরে বাগবাগিচায় তুমি বসন্তের বাতাস বইয়ে দিয়েছ। ডালে ডালে যে সব হলুদ পাতা খসে পড়ার অপেক্ষায় দিন গুনছিল তারাও দেখলুম দিব্যি সবুজ হয়ে আবার সিংহাসন আলো করে বসে আছে। বাগানের দশা দেখে সন্দেহ হয় এটা আমারই তো? ফোটবার-ফোটাবার এত জোর কি আমার ছিল? আমি কি পারতুম কেবলমাত্র নিজের জোরে ভয়কে ভরোসায় বদলে দিতে?
কী হল? অমন গামলাপানা মুখ করে বসে আছ কেন? তোমাকে দেখতে না পেলেও এই মুহূর্তে তোমার মনের কিংকর্তব্যবিমূঢ় দশাটা দিব্যি আন্দাজ করতে পারি। আরে বাবা, আমি তোমার লেখার কথা বলছি। সাবিত্রী আম্মার ভাবনায় আমি যখন ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছি ঠিক তখনই ফোন ঘাঁটতে ঘাঁটতে তোমার মেলটা পেলাম। পড়ার পর মনে হল, সত্যিই তো, আমার
অর্জুনবাবু ঠিক কথাই লিখেছে। ভালো কিছু হতেও তো পারে। সাবিত্রী আম্মা সেরে যাবে না এরকম কোনও আকাশবাণী তো হয়নি! তা হলে আমি কেন মনে মনে মানুষটাকে মেরে ফেলছি? গত দু'দিন আমি হাসপাতালে ফোন করিনি। জয়াকে দিয়ে করিয়েছি। বাড়ি থেকে অনেক দূরে আছি বলেই বোধহয়, একটা মারাত্মক ভয় আমাকে আষ্টেপৃষ্টে ঘিরে ধরেছিল। যেন শ্রীলঙ্কার সাবিত্রী আম্মা কলকাতা নিবাসিনী শ্রীমতি সুনয়না মিত্রের রেপ্লিকা। এইস্থলে সাবিত্রী আম্মার স্বাস্থ্যের অবনতি হইবার অর্থ কলকাতায় সুনয়নাদেবীর দ্বারপ্রান্তে কালান্তক যম মহোদয় অচিরেই উপস্থিত হইবেন। এই ভয় থেকেই আমার টেলিফোনে অনীহা। কিন্তু তোমার মেলটা আদ্যোপান্ত পড়ার পর ভয় কেটে গেল। নিজেই গেলুম ফোন করতে। যে খবর পেলুম তাতে তোমার প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতায় ভরে গেল মন। কাছে থাকলে হয়তো গলায় আঁচল দিয়ে একটা প্রণামও করে ফেলতুম। একে প্রেমিক তার ওপর গুরুজন--প্রণয় এবং প্রণাম দুটোই প্রাপ্য। হাসপাতাল থেকে জানাল সাবিত্রী আম্মা আগের থেকে ভালো আছে। শ্বাসকষ্ট আর নেই। জ্বরও না থাকার মতোই। নর্মাল খাওয়া-দাওয়া করছে । কন্ডিশন এরকম থাকলে চার-পাঁচ দিন পর ছেড়ে দেবে। ফোন রাখার পর মনে হল ঘরের দরজা বন্ধ করে ধেই ধেই করে নাচি। তুমি বিশ্বাস করবে না অর্জুনদা, মানুষের মনের
চালচলন নিয়ে এতদিন বইয়ে যা পড়েছি তার প্র্যাক্টিকাল অ্যাপ্লিকেশনগুলো এমন করে সম্ভবত জানতেই পারতাম না যদি না কোভিড ১৯ নামক অতিমারী পৃথিবীতে না আসত। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত অবশ্য নাচিনি। সুনয়নাদেবীকে ফোন করলাম। জানি মা দুপুরের এই সময়টায় একটু শোয়। তবুও করলাম। ফোন ধরে মা হাউমাউ করে বলল, কী হয়েছে কুমু? তুই ভালো আছিস তো? হঠাৎ এই সময় ফোন করলি যে? আমি কথা বলব কী অর্জুনদা, শুধু কেঁদেই চলেছি। অনেকদিন ধরে পাথরের মতো চেপে বসা কোনও টেনশন যদি হঠাৎ রিলিজ হয়ে যায় তা হলে এরকম হয়। আমিও কাঁদছি মাও কাঁদছে। অনেকক্ষণ পর বললাম, আমি ভালো আছি মা। সাবিত্রী আম্মাও ভালো আছে। তুমি কেমন আছ? মা বলল, আমি ভালো আছি। এখানে রঞ্জু আছে তাই আমার কোনও চিন্তা নেই। লকডাউনে সকালে দু'ঘন্টার জন্য দোকানপাট খোলে। রঞ্জু ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে জিনিসপত্র কিনে আনে। অনেক ভাগ্য করলে এমন কাজের লোক পাওয়া যায়। আগে সন্ধ্যেবেলায় টিভি দেখতুম। এখন আর দেখি না। দেখলে কেমন যেন ভয় করে। সারাদিন শুধু মরার খবর। রঞ্জু আমাকে টিভি দেখতে দেয় না৷ আমার সব চিন্তা তোকে নিয়ে। কতদিন তোকে দেখিনি বল তো?---জানো অর্জুনদা খুব ইচ্ছে করছিল মা'কে একটা ভালো খবর দিই। অন্তত আজকের রাতটা মা নিশ্চিন্ত হয়ে শুতে যাক। ঘুমিয়ে পড়ুক স্বপ্ন দেখতে দেখতে। মাকে জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ গুঁজে কথাটা বলতে পারলে ভালো হত। কিন্তু কবে দেশে ফিরব জানি না। আদৌ ফিরতে পারব কি না তাও না! মাঝে মাঝে কেন জানি না মনে হয় এই অতিমারী বোধহয় কোনওদিনই শেষ হবে না। আমরাও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বন্দি হয়ে অসম্ভবের প্রতীক্ষা করতে করতে একদিন বুড়ো হয়ে মরে যাব। বলতে না পেরে আফশোস করার থেকে আজই বলা ভালো।
আমাকে নিয়ে মায়ের চিন্তার মধ্যে প্রথম ও প্রধান চিন্তা কেন আমি বিয়ে করছি না? বিয়ে না করলে মায়ের অবর্তমানে কে আমায় দেখবে? কে মনে করিয়ে দেবে, ওরে রাত আড়াইটে বেজে গেছে, আর কখন ঘুমোবি তুই? এইভাবে রাত জাগলে তো একদিন শ্যাওড়া গাছের পেতনিরাও তোকে দেখে নাক শিটকোবে! হ্যাঁ অর্জুনদা আমি এরকমই। মেয়ে কিন্তু মেয়েলি নই। জীবনের যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াই যেমন করতে পারি ঠিক তেমনি, আকাশে দোলপূর্ণিমার চাঁদ দেখে অস্ত্রশস্ত্র নামিয়ে কাঁথাকানি মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়েও পড়তে পারি৷ সুনয়নাদেবী যথারীতি বিয়ের কথা তুললেন। দেশে ফিরলে এবার নাকি সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠে যাকে প্রথম দেখবেন তার সঙ্গেই আমার বিয়ে দিয়ে দেবেন। সুযোগ পেয়ে কথাটা আমি বলেই ফেললুম, আর আমার বিয়ে নিয়ে তোমায় চিন্তা করতে হবে না মা। দেশে ফিরে এবার আমি সত্যি সত্যিই বিয়ে করব। কোনও বাচ্চা মেয়েকে খেলনা কিনে দেবার প্রতিশ্রুতি দিলে সে যেমন আহ্লাদে আটখানা হয়ে ওঠে, ঠিক তেমনই আহ্লাদী গলায় মা বলল, তুই সত্যি বলছিস! কাকে বিয়ে করবি কুমু? আমি তাকে চিনি? বললাম, হ্যাঁ মা, চেনো। অর্জুনদা। মা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, এ যে আমার কত বড়ো ভাগ্য আমি তোকে বলে বোঝাতে পারব না। অত বড়ো স্কলার কিন্তু শিশুর মতো সরল। না হলে কেউ আমার কাছে নারকেল নাড়ু খেতে চায়! আমি তো ভেবেছিলুম, দেশবিদেশে ঘুরে বেড়ায়, নিশ্চয়ই কন্টিনেন্টাল খেতে চাইবে। ও মা! বলে কী, আমার মা খুব ভালো নারকেল নাড়ু বানাত। আপনি একদিন খাওয়াবেন আন্টি? অর্জুন খুব ভালো ছেলে কুমু। আজকাল এত কেয়ারিং অ্যাটিটিউড দেখা যায় না। তুই খুব সুখী হবি।
আমারও তাই মনে হয় অর্জুনদা। খুব সুখী হব। শুধু হব না, সুখী করবও। যে বিশাল মরুভূমি তুমি জীবনের প্রতিটি পরোতে জমিয়ে রেখেছ তাকে আমি সবুজ করে দেব। গত বছর প্রিন্সেপ ঘাটে বসে তুমি একটা কবিতা বলেছিলে। আমি মোবাইলে রেকর্ড করে রেখেছিলুম। আজ মাকে অনেকদিন পর খুশিতে ভাসতে দেখে সেই কবিতাটার কথা মনে পড়ছে।
তোমার নামটি বিষম ভারী উচ্চারণে
হালকা পায়ে রাতবিরেতের গভীর বনে
সফেদ বাড়ির পরদা ফেলা দরজা দিয়ে
যে-যার মতো অশ্বমেধে যায় হারিয়ে।
ছদ্মবেশের আড়াল ভাঙে স্বেচ্ছাচারী
আলগা আলোর চারপাশে স্থির অন্ধকারই।
রইল প্রিয় সম্বোধনের গৃহস্থালী
শূন্য চোখের ছাউনিতে আজ মরণবালি।
মেপল গাছের ছায়ায় বাসা আপনমনে
ডাক দিয়েছে, কেউ ফেরেনি সিংহাসনে।
তবুও যখন পিছন ফিরে আকাশ দেখি
মৌনমুখর ঝলমলে দুই মেরুন পাখি
তক্ষুনি ঠিক কলিংবেলে বসন্তদিন
আমায় ডাকে ও আলাদিন, ও আলাদিন!
তুমি আমার জীবনে আলাদিন হয়ে এসেছ। আলাদিন হয়েই থেকো। হাত বাড়ালেই যেন জীবনের অধরা মাধুরী এমনি করে আমার সব অসম্পূর্ণতা ঢেকে দেয়।
ভালো থেকো
কুমুদিনী
(ক্রমশ)

মন্তব্যসমূহ