রবিবাসরীয় সাহিত্যের দিন প্রতিদিন - সাহিত্যিক সন্দীপ চক্রবর্তীর অন্য ধারার গল্প গাঁথার ধারাবাহিক - " তুহু মম "
রবিবাসরীয় ধারাবাহিক
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের নবীন লেখক সন্দীপ চক্রবর্তী । সন্দীপ লেখেন, নিজের অনুভুতি দিয়ে। সেখানে পাওয়া যাবে নিজেকে খুঁজে। বর্তমানে সন্দীপ একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের অন্যতম ।সন্দীপের প্রতিটি অক্ষরের মাঝে লুকিয়ে থাকে সমাজের চালচিত্র। প্রতিদিন থাকছে এই সমাজের কথকতা। একেবারে নতুন এক আঙ্গিক। একেবারে অন্য রকম আখ্যান গাথা
কলম্বো
শ্রীলংকা
অর্জুনদা
তোমার সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলেই আবার লিখতে বসে পড়েছি। কথা কী আর ফুরোয়! এক ঝুড়ি শেষ করি তো আর এক ঝুড়ি জমে যায়। তবে বাপু ফোনে কথা বলে তেমন সুখ নেই। বিশেষ করে ভিডিও কলে। কোন কথাটা তুমি শুনলে আর কোনটায় অন্যমনস্ক হলে সেটা বুঝতে পারি বলেই গণ্ডগোল বাঁধে। যাকে অল্প বুঝি আর অনেকটা বুঝি না তাকে হঠাৎ পুরোপুরি বুঝে ফেললে নিজের ওপরেই সন্দেহ হয়। মনে হয়, এই রে, রহস্যের ভাণ্ডার ফুরিয়ে গেল না তো! এরপর আনপ্রেডিক্টেবল বলে ঝগড়া করব কার সঙ্গে?
যাই হোক, আর কাব্যি করব না। ভিডিও কলের আইডিয়াটি ছিল জয়ার। অনেকদিন থেকেই কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করছে মুখপুড়ি। কী বলে জানো? বলে, যতই তুই মনের ব্যামো নিয়ে লেকচার দিস আসলে তুই নিজেই সন্দেহবাতিকগ্রস্ত। পাছে তোর অর্জুনকে নিয়ে পালাই সেই ভয়ে তুই ভিডিও কল করতে চাস না। আজ তোমার সঙ্গে কথা বলার পর বলল, না, হি ইজ রিয়েলি হ্যান্ডসাম। আব্বাসকে কথা না দিয়ে ফেললে একবার চেষ্টা করে দেখতাম। এইসব কথা যখন হচ্ছে তখনই আব্বাস ফোন করল। এইসময় রোজই করে। জয়া ফোন ধরে ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানে না গোছের মুখ করে বলল, খুব ভালো সময়ে ফোন করেছ। তোমার কথাই ভাবছিলাম। কী পাজি মেয়ে, ভাবো একবার! আব্বাসকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরায়।
তোমার এবারের মেলটা পড়ে মন খারাপ হয়ে গেল। মাঝে মাঝে খুব ভয় করে জানো। এই যে তুমি আমায় নদী হতে বলো, ঘরে ফিরিয়ে আনার কথা বলো-- এসব কি আমি পারব? আমি খুব সাধারণ। তুমি চাইলে আমি তোমার সঙ্গে ঘর বাঁধতে পারি। সেই ঘরকে সেবায়, যত্নে, ভালোবাসায় ভরিয়ে দিতে পারি। কিন্তু নদী হব কী করে? নদী পাহাড় থেকে নেমে লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে, ভাসিয়ে-ভরিয়ে হারিয়ে যায় সমুদ্রের বুকে। তার অপেক্ষা করার, থিতু হওয়ার, বাঁধা পড়ার সময় কই? নদী হয়ে আমি যদি শুধু তোমাকে ভাসিয়েই নিয়ে যাই তা হলে তো তুমি একমাত্র আমারই হবে। কিন্তু তুমি তো শুধু আমার নও অর্জুনদা! তুমি রুরুরও। তুমি এই দেশের। সারা পৃথিবীর। তবে হ্যাঁ, তুমি যেটুকু আমায় দেবে সে স্বাদের ভাগ আমি কাউকে দেব না। তোমার রুরুকেও না। ছোটবেলায় ক্যাডবেরি খেতে খুব ভালোবাসতুম। এখনও বাসি। তবে সেই হ্যাংলামি আর ততটা নেই। একবার মা আমায় ডেয়ারি মিল্কের বড়ো একটা প্যাকেট দিয়েছে। আমি মনের আনন্দে প্যাকেট থেকে আমার প্রাণভোমরাকে বের করছি। খেয়াল করিনি আমাদের কাজের মাসির ছেলে বাবলু আমারই দিকে তাকিয়ে রয়েছে। চোখে চোখ পড়তে বলল, আমাকে একটু দেবে, দিদি? সেদিন বাবলুর কাতর আবদার শুনে মনে হয়েছিল ও কখনও খায়নি। পুরো প্যাকেটটাই ওকে দিয়ে দিয়েছিলুম। তাই বলে ভেবো না আমার ভাগের অর্জুনকে আমি কাউকে দিয়ে দেব। বাবলুকেও না, রুরুকেও না। তুমি তো আর ক্যাডবেরি নও।
রুরুর কথা তুললুম বলে রাগ করলে? দোহাই রাগ করো না। ঘাট মানছি। নাককান মলছি। আসলে কী বলো তো, আমার ভাবনায় রুরু এসেই যায়। না, রুরুর জন্য আমার কোনও হীনমন্যতা নেই। তবে নিদারুণ একটা অনিশ্চয়তার বোধ আছে। আমি জানি ও ফিরে আসবে। ফিরে এসে ও যদি অর্জুনকে ফেরৎ চায়? তখন আমি কী করব? আমি তো আর রুরুর মতো শ্বেতপাথরের প্রাসাদ নই। সামান্য একটা গাছ মাত্র। হঠাৎ বৃষ্টি নামায় তুমি আমার ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছ। প্রাসাদ যেদিন তার শূন্য সিংহাসনের অসম্পূর্ণতা বুঝতে পারবে, সেদিন কি তোমার এই গাছতলা ভালো লাগবে? গাছ তোমায় যতই ছায়া দিক, তার কোটরে বাসা বাঁধা কোকিলেরা যতই তোমায় গান শোনাক, রুরুর সম্মোহনের সঙ্গে আমার সমর্পণ পেরে উঠবে কেন? তাকে তো হার মানতেই হবে। হার মানার পর গাছটার বড্ড অভিমান হবে গো! হয়তো সে আর কোনওদিন ফুল ফোটাতেই পারবে না। উষ্ণতা না পেয়ে কোকিলেরাও উড়ে যাবে নতুন বাসার সন্ধানে। সেই দিনটার কথা ভাবলেই ভয়ে আমার বুক কেঁপে ওঠে। নিজেকে তখন এই বলে সান্ত্বনা দিই, রুরু ওর জিনিস ফিরিয়ে নিলে নিক না। তুই যা পাবি তাও কি কম? দেখবি সেই তোড়ায় বাঁধা যৎসামান্যে একটা জীবন দিব্যি কেটে যাবে।
কী ভাবছ, খুব নেগেটিভ কথা বলছি? এইসব মন খারাপের কথাবার্তা কুমু পাগলিকে মানায় না, তাই না? জয়ার ভাষায় মনের ব্যামোর ডাক্তার বলে কথা! কিন্তু কী করব বলো! পজিটিভ হওয়ার অর্থ যদি হৃদয়ের সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকা হয় তা হলে আমি একটুও পজিটিভ নই। লোকের মুখে মুখে ফেরার জন্য আমি কারোর মন জুগিয়ে চলতে পারব না। আমার কাছে যা সত্য তা তোমার কাছে সত্য নাও হতে পারে। কিন্তু তুমি
তাকে সত্য বলে গ্রহণ করতে পারলে না বলে আমার কাছে তা মিথ্যে হয়ে যেতে পারে না। রাগ করো না অর্জুনদা। আজ বড়ো কঠিন সুরে কথা বলছি। আসলে আমার মন আজ ভালো নেই। একটা গভীর সংশয় আমাকে ঘিরে ধরেছে। নিজেকে যতই বীরবাহাদুর ছেত্রী ভাবি রুরু ফিরে আসার পর তুমি যদি বদলে যাও তা হলে সেই রিক্ততার ভার বহন করা আমার পক্ষে দুঃসহ হয়ে উঠবে। মাঝে মাঝে মনে হয় এর চেয়ে তুমি যদি আমার ভালোবাসা স্বীকার না করতে তা হলে বরং ভালো ছিল। দুঃখকে নিয়তি মেনে নিলে দুঃখ সহ্য করা সহজ হয়। কিন্তু দুঃখকে নিয়তি আমি মানতে পারি না। তোমাকে পেয়েছি। তোমার ভালোবাসা পেয়েছি। আমার আর কীসের দুঃখ বলো তো?
সংশয় আমি কাটিয়ে উঠব অর্জুনদা। আর রুরুর ফিরে আসার চিন্তা? মেয়েটা সত্যিই অসাধারণ। তোমাকে ধ্বংসস্তূপ বানিয়েও তোমার মধ্যে রয়ে গেছে। এখন সংশয় হয়ে আমার মনেও ছড়িয়ে পড়ছে।
ভালো থেকো
কুমুদিনী
(ক্রমশ)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন