রবিবাসরীয় সাহিত্যের দিন প্রতিদিন - সাহিত্যিক সন্দীপ চক্রবর্তীর অন্য ধারার গল্প গাঁথার ধারাবাহিক - " তুহু মম "
রবিবাসরীয় ধারাবাহিক
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের নবীন লেখক সন্দীপ চক্রবর্তী । সন্দীপ লেখেন, নিজের অনুভুতি দিয়ে। সেখানে পাওয়া যাবে নিজেকে খুঁজে। বর্তমানে সন্দীপ একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের অন্যতম ।সন্দীপের প্রতিটি অক্ষরের মাঝে লুকিয়ে থাকে সমাজের চালচিত্র। প্রতিদিন থাকছে এই সমাজের কথকতা। একেবারে নতুন এক আঙ্গিক। একেবারে অন্য রকম আখ্যান গাথা
সন্দীপ চক্রবর্তী
রাখিগঢ়ি
হরিয়ানা
কুমুদিনী
কাল ঘুম ভেঙেছিল বৃষ্টির শব্দে। আর আজ ভেঙেছে পাখির ডাকে। দু'দিনের দু'রকম ঘুম ভাঙার কথা বললাম কারণ তোমার শেষ লেখাটি দু'ধরনের ব্যঞ্জনাই ধারণ করতে পারে। এবং ঘুমও ভাঙাতে পারে। পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল অনেকদিনের শীতঘুম থেকে আমি জেগে উঠছি। যে অন্ধকার ট্যানেলে আমার পথ হারানো, পুব দিগন্তে সূর্যোদয় দেখার জন্য সারারাত কূলহারা এক নদীর পাড়ে বসে থাকা-- তোমার লেখা কয়েকটি শব্দ আর বড়ো একটা মন সেই চেয়ে থাকায় দাঁড়ি টেনে দিল। আমি আবার শ্বাস নিলাম। চোখভ'রে দেখলাম রংপাগল এই পৃথিবীকে।
সত্যি কুমুদিনী তোমার কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। মানুষকে তার সুখ দিয়ে চিনলে সে চেনা প্রায়শই অসম্পূর্ণ হয়ে থেকে যায়। আমার ভাগ্য ভালো, তুমি তা
করোনি। আবার আমার দুঃখও যে তোমার ক্ষমাদৃষ্টিতে ধন্য হয়ে বেশি নাম্বার পেয়ে পাশ করেছে তাও নয়। বস্তুত আমি যাকে দুঃখযাপন বলি তুমি তাকে যাপন বলতেই চাওনি। বলতে চেয়েছ দুঃখবিলাস। হয়তো তুমিই ঠিক। আমি তো নিজেকে তেমন বুঝতে পারি না। নিজের আসল আমি'কে গোপন করে অন্য এক অচেনা আমি হয়ে কাউকে ভালোবাসলে, তাকে স্বপ্ন দেখালে--তার সঙ্গে প্রতারণাই তো করা হয়। রুরু আর আমি দুজনেই একে অপরের সঙ্গে প্রতারণা করেছি। সময় যার প্রতিশোধ নিয়েছে কড়ায়গণ্ডায়। তবে রুরুর ফিরে আসা নিয়ে যা বলেছ তার পরিপ্রেক্ষিতে বলি, রুরু ফিরে আসুক আমি চাই না। রুরুর কাছ থেকে আমি অনেকটাই সরে এসেছি কুমুদিনী। সরেই থাকতে চাই। কবি কালিদাস যখন উজ্জয়িনীতে প্রথম এলেন তখন তার থাকার জায়গা ছিল না। সম্রাট বিক্রমাদিত্য তাঁর প্রাসাদের সংলগ্ন একটি জমিতে প্রিয় কবির জন্য প্রাসাদ বানিয়ে দিতে চাইলেন। কালিদাস সবিনয়ে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখান করে বললেন, না সম্রাট। প্রাসাদ আমার বসবাসের উপযুক্ত নয়। আমার জন্য নদীর ধারে একটি পর্ণকুটীর তৈরি করিয়ে দিন। আমি সেখানেই থাকব।--কী ভাবছ, হঠাৎ কালিদাস বিক্রমাদিত্যের কথা কেন নিয়ে এলাম? কী জানো কুমুদিনী, কালিদাস ছিলেন কবি আর আমি ইতিহাসের গবেষক। লেখাপড়া নিয়ে কাজ আমাদের। প্রাসাদ নিয়ে আমরা কী করব বলো তো? সবাইকে চমকে দিতে রুরুর জন্য প্রাসাদ বানাতে যাওয়াটা ছিল আমার ভুল। সেই ভুল আর আমি করব না। রুরু ফিরে এলেও না। তুমি যদি অনুমতি দাও তা হলে এবার নদীর ধারে পর্ণকুটীর তৈরি করিয়ে দিতে বলব সম্রাট বিক্রমাদিত্যকে। তাতে তোমার খাটনি অবশ্য বাড়বে। দু'বেলা কাঁখে কলসী নিয়ে ঘাটে জল আনতে যেতে হবে। ঘাটে আবার তমালগাছ থাকেই। সেখানে যদি তিনি দাঁড়িয়ে থাকেন বাঁশি হাতে তা হলে আবার মুশকিল! তাঁর বাঁশি বা হাসি--কোনও কিছুর সঙ্গেই পেরে উঠব না। অগত্যা তাঁকে অনুরোধ করব, আমি আরও একবার ভালোবাসতে চাই। স্বপ্ন দেখতে চাই নতুন করে। বারবার যদি আমার আঙুলের ফাঁক দিয়ে জল মাটিতে পড়ে যায় তা হলে আমি আচোমন করব কেমন করে?
হ্যাঁ, কুমুদিনী আমি আবার স্বপ্ন দেখছি। তুমি আমাকে অনুমতি দিয়েছ। আশকারাও দিয়েছ। সুতরাং মনের কথা বিন্দুমাত্র সেন্সর না করে বলতে আমার কোনও দ্বিধা নেই। সারাদিন ইতিহাসের ধ্বংসস্তূপে ঘরে বেড়াই। খোঁজা আমার কাজ। কিছু খুঁজে পেলে নোট নিই। ইতিহাস যেখানে নীরব সেখানে এতদিন, বিশেষত রুরু চলে যাবার পর, সেখানে নিজেরই স্বপ্নের খণ্ড-বিখণ্ড অংশ ছড়িয়ে দিয়ে ভাবতাম একটি জাতির ইতিহাস আর ব্যক্তির ইতিহাস বুঝি সমার্থক। ফুরিয়ে যাওয়ার হাহাকার আর হারিয়ে ফেলার কান্না সর্বত্র। কিন্তু বিশ্বাস করো এখন আর ওভাবে ভাবি না। ভাবতে চাইও না। বরং ইতিহাসের নৈঃশব্দের পাশে বড়ো যত্নে আমার মনের আনন্দ গোলাপের বীজের মতো ছড়িয়ে দিই। ফুটুক, ওরা ফুটুক। এ আনন্দ তোমারই দান কুমুদিনী। তোমার মতোই সে নিরভিমান। সে আমায় বলে, আজকের এই নিঃশব্দ ইতিহাস একদিন নিঃশব্দ ছিল না। সেখানেও ছিল প্রেমে ব্যর্থ যুবক৷ যারও নাম হয়তো বা অর্জুন। সেই অর্জুন হাজার হাজার বছর আগে তখনকার কোনও এক কূলহারা নদীর ধারে বসে থাকত একা। নদী তার ভালো লাগে। আরও ভালো লাগে দূরে, অনেক দূরে, ভেসে যাওয়া নৌকো দেখতে। যা কিছু তার নাগালের বাইরে সবই তার ভালো লাগে। একটি মেয়ে এসব জানত। ধরে নাও তার নাম কুমুদিনী। সে দূর থেকেই ভালোবাসে অর্জুনকে। কখনও কাছে যায়নি। কাছে যেতে তার ভারী লজ্জা। কিন্তু একদিন গেল। দেখল অর্জুন নদীর পাড়ে জলে ভেজা কাদামাটিতে তারই ছবি আঁকছে। কুমুদিনী জিজ্ঞাসা করল, নদী তোমার খুব ভালো লাগে বুঝি? অর্জুন বলল, হ্যাঁ। কুমুদিনী বলল, আমি যদি তোমার নদী হই তা হলে আমাকেও তোমার ভালো লাগবে? অর্জুন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। কিছু বলল না। কুমুদিনী বলল, আমি হব তোমার নদী। আমার স্রোতে ভাসতে
ভাসতে যেয়ো তোমার যেখানে খুশি। সেই থেকে দুটিতে ভাব। দুটিতে প্রেম। সেদিন থেকে আজ। তারপর কাল পরশু তরশুর গল্প।
আমি তোমার কাছে ঋণী কুমুদিনী। এমনি করে আমার নদী হয়ো। এমনি করে আমায় ভালোবেসো। এমনি করে আমায় ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যেয়ো। তোমার কাছে ফিরতে পারলেই আমি খুশি। তারপর যদি মরেও যাই কোনও দুঃখ নেই।
ভালো থেকো
অর্জুনদা
(ক্রমশ)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন