রবিবাসরীয় সাহিত্যের দিন প্রতিদিন - সাহিত্যিক সন্দীপ চক্রবর্তীর অন্য ধারার গল্প গাঁথার ধারাবাহিক - " তুহু মম "

  রবিবাসরীয়   ধারাবাহিক 

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের নবীন লেখক সন্দীপ চক্রবর্তী । সন্দীপ লেখেন, নিজের অনুভুতি দিয়ে। সেখানে পাওয়া যাবে নিজেকে খুঁজে। বর্তমানে সন্দীপ একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের অন্যতম ।সন্দীপের  প্রতিটি অক্ষরের মাঝে লুকিয়ে থাকে সমাজের চালচিত্র। প্রতিদিন থাকছে  এই সমাজের কথকতা। একেবারে নতুন এক আঙ্গিক। একেবারে অন্য রকম আখ্যান গাথা  

                 তুঁহু মম / ২৯       


 


সন্দীপ চক্রবর্তী


কলোম্বো
শ্রীলংকা
অর্জুনদা,
সত্যি বলছি, তোমার লেখা পড়তে পড়তে অনেকদূরে চলে গিয়েছিলুম। বাব্বা! কী ভাব! কী ভাষা! দীর্ঘ ইমেল তিন দিন ধরে পড়ার সময় কখনও হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলুম খেলাঘরের চৌকাঠে, আবার কখনও রাস্তার ধারে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলুম ছুটির দিকে। ছোটবেলায় খেলাঘর আর বড়োবেলায় ছুটি পাওয়া কি কম কথা? মানছি জীবন তোমাকে না-হোক যন্ত্রণা দিয়েছে, হিরের মতো দামি একেকটা স্বপ্ন খুচরো পয়সার মতো হাত ফসকে গড়িয়ে গেছে এধার-ওধার, তবুও অর্জুনদা, দিনের শেষে লক্ষ্মীর ভাঁড়ে জমাও বড়ো কম নয়!
হেসো না বাপু! জানোই তো তোমার মতো সাজিয়ে-গুছিয়ে লিখতে পারি ন। আগডুম-বাগডুম যা লিখি, পড়ার সময় নিজেই হেসে বাঁচি না। তোমার অমন সুন্দর লেখার জবাব লিখতে পারছি, তাই ঢের। যাই হোক, এবার কাজের কথা বলি।
তুমি নিজেকে বহুবার কাপুরুষ বলেছ, ভণ্ড বলেছ--কিন্তু সব ঘটনা জানার পর তোমাকে একবারের জন্যেও আমার কাপুরুষ বা ভণ্ড বলে মনে হয়নি। হ্যাঁ, তুমি সরল। তোমার সারল্য এমন এক ধাঁচের যাকে সময়বিশেষে বোকামিও বলা চলে। মফস্বলের ছেলে হলেই কি তাকে এমন বেলাগাম হতে হয় অর্জুনদা? তোমার ছেলেবেলায় নদী ছিল, আকাশ ছিল, গাছগাছালি ছিল--বটগাছের মতো ছায়া দেওয়া বাবা ছিলেন--তোমারও তো বটগাছ হবারই কথা! কিন্তু কলকাতায় গিয়ে নিজের শেকড় ভুলে তুমি কলকাত্তাইয়া কালচারের উপযুক্ত বনসাই হতে চাইলে। মানছি, রুরুকে দেখে তোমার অপরিণত মাথা ঘুরে গিয়েছিল। এও মানছি রুরুকে দেখার পর যে কোনও পুরুষই অস্থির হয়ে উঠবে। কিন্তু রুরু কি তোমায় বলেছিল, আমায় ভালোবাসো ক্ষতি নেই কিন্তু আমায় পেতে হলে তোমাকে আমার মতো বা আমাদের মতো হতে হবে? এমন সর্বনাশী শর্ত তো রুরু তোমাকে দেয়নি অর্জুনদা! কলকাতার স্নো-পাউডারে সাজানো ইংরিজিয়ানা দেখে আর ছুরি-কাঁটা-চামচের টুংটাং শুনে তোমার মনে কোথাও একটা হীনমন্যতা জেগে উঠেছিল। তোমার মনে হয়েছিল কলকাতার কোলেপিঠে না চড়তে পারলে প্রেসিডেন্সিতে মান থাকবে না। রুরুকেও পাওয়া হবে না। অতিরিক্ত সরল বলেই তুমি এমন সরল করে ভেবেছিলে। এবং সহজেই বিসর্জন দিয়েছিলে তোমার শেকড়।
আমাকে ভুল বুঝো না। তোমাকে আঘাত করার কোনও ইচ্ছে আমার একেবারেই নেই। তুমি আমার মনের রাজাধিরাজ। সোনার সিংহাসন হেলায় ফেলে তুমি যদি ধুলোয় আসন পাতো তা হলে সেই স্খলন তোমাকে কতটা বিদ্ধ করে জানি না কিন্তু আমার মনে হয় এ গ্লানি আমার। কারণ আমারই এক সত্তা আজ স্খলিত, পতিত এবং অবমানিত। আমার সেই যন্ত্রণাই তোমাকে আঘাত করছে, আমি করছি না। বলতে পারো, তোমাকে দেওয়া প্রতিটি আঘাত দ্বিগুণ হয়ে ফিরে এসে বাজছে আমার বুকের ভেতর। এই সময় একবার যদি তোমাকে কাছে পেতুম তা হলে তোমার কাঁধে মাথা রেখে কাঁদতুম। এ ছাড়া আমি আর কীই বা করতে পারি! আমি তো আর সেই সময়টাকে বদলাতে পারব না।
এবার আসব রুরুর কথায়। একটা কথা স্পষ্ট করে বলছি অর্জুনদা, তুমি এবং রুরু দুজনে রোমহর্ষক প্রেমিক প্রেমিকা হতে পারো কিন্তু তোমরা একে অপরের কাছে সম্পূর্ণ সৎ থাকতে পারোনি। তোমার নিদারুণ আত্মপ্রতারণার কথা আগেই বলেছি। কিছু মনে কোরো না, রুরুও সেই একই দোষে দোষী। কারণ রুরুও ওর উচ্চবিত্তের অহংকারকে চুন-সুরকির পলেস্তারার আড়ালে গোপন করে তোমাকে পাওয়ার লোভে মধ্যবিত্ত সাজতে চেয়েছিল। দম্ভকে বদলাতে চেয়েছিল সমর্পণে। এ কি সম্ভব অর্জুনদা? আগুন যদি মোমবাতির বশে না থাকে তা হলে সে আলো হবে কী করে? নিজেকে নতুন আর পুরনোয় ভাগ করে রুরু চেয়েছিল ওর ভেতরের আগুনকে বশে রাখতে। কিন্তু তা তো হবার নয়। পুরনো জীবনটাকে তুমি দূরে সরিয়ে রাখতে পারো একেবারে অস্বীকার করবে কী করে? আর তা ছাড়া, নতুন মানেই তো আর চিরন্তন নয়। জীবনে এরকম অনেক নতুনের আবির্ভাব হয় যারা সময়ের পরীক্ষায় পাশ করতে না পেরে বাতিল জিনিসের ভিড়ে মুখ লুকোয়। ফলে রোদের তাপে আর বৃষ্টির ছাটে রুরুর মধ্যবিত্ত স্বপ্নের পলেস্তারা যত খসল অন্তরের ছাইচাপা আগুনও মোমবাতির সীমানা পেরিয়ে দাবানল হয়ে উঠল। কষ্ট পেলে তুমি। কষ্ট পেল রুরুও।
রুরু সত্যিই এক আশ্চর্য মেয়ে। না, ও অসাধারণ সুন্দরী বলে এ কথা বলছি না। কিংবা, রুরুর শরীরের বর্ণনায় তুমি কালিদাসকে হার মানালেও, আমি তার ওপর ভিত্তি করে এ কথা বলছি না। বলছি তার কারণ একজন মহিলা হিসেবে আমি অনুভব করেছি রুরুকে। পুরুষ রুরুর খেলার জিনিস। সম্পুর্ণ মানুষ হিসেবে কোনও পুরুষকে স্বীকৃতি রুরু কোনওদিনই দেয়নি। বিছানায় ডেকেছে। ভোগ করেছে। ভাগিয়ে দিয়েছে। সারা পৃথিবীতে মেয়েরা ভোগের জিনিস হলেও রুরুকে ভোগ করার স্পর্ধা বোধহয় কোনও পুরুষই আজ অবধি দেখাতে পারেনি। তারা চিরকাল ভোগের নৈবেদ্য হিসেবে নিজেদের উৎসর্গ করেই তৃপ্ত থেকেছে। কিন্তু রুরু তোমায় ভালোবেসেছিল অর্জুনদা। তোমাকে সে খেলার জিনিস ভাবেনি। শুধু নিজেকে রাতারাতি পাল্টাতে গিয়ে যে ফাঁকিটা ও দিয়েছিল সেটাই ফাটল হয়ে ওকে ডুবিয়ে দিল। রুরু যদি তখনই বিয়ে না করে আরও কয়েক বছর অপেক্ষা করত তা হলে সময়ই ওকে পালটে দিত। সেই পরিবর্তন হত স্থায়ী। অমল যোগলেকরের টোকায় এমন তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ত না।
আমার মনে হয় রুরু আবার তোমার জীবনে ফিরে আসবে। খেলতে খেলতে বেলা যত ফুরোবে ওর ঘরে ফেরার ইচ্ছে তত প্রবল হবে। তুমি ছাড়া ওর ঘর তো সম্পূর্ণ হবে না অর্জুনদা। আর রুরু যদি অভিমান করে সেই ঘরের ছায়া থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ও, মনে মনে ও চিরকাল তোমারই থাকবে। তুমি খুব ভালো অর্জুনদা। খুব খুব ভালো। কেন বললে বলো তো আমাকে রুরুর কথা? আমার ঈর্ষা হয় না বুঝি! না গো, ঠাট্টা করছিলাম। রুরু ফিরুক বা না ফিরুক, আমি তোমাকে ভালোবেসেই যাব অর্জুনদা। তুমি বলেছিলে সব কথা জানার পর তোমার সম্পর্কে আমার ধারণা পালটে যাবে। পালটে গেছে তো, সত্যি বলছি। আগে শুধু ভালোবাসতুম, এখন শ্রদ্ধাও করি। তুমি সব কথা আমায় বলেছ, কোথাও নিজেকে আড়াল করোনি--এ কি আমার কম ভাগ্যি! আরও একটা কথা বলতে ইচ্ছে করছে.... না, ধ্যাৎ, সে কথা এভাবে বলা যায় না। দেখা হলে বলব।
ভালো থেকো।
কুমুদিনী
(ক্রমশ)
May be an image of 4 people, tree and body of water

মন্তব্যসমূহ