রবিবাসরীয় সাহিত্যের দিন প্রতিদিন - সাহিত্যিক সন্দীপ চক্রবর্তীর অন্য ধারার গল্প গাঁথার ধারাবাহিক - " তুহু মম "
রবিবাসরীয় ধারাবাহিক
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের নবীন লেখক সন্দীপ চক্রবর্তী । সন্দীপ লেখেন, নিজের অনুভুতি দিয়ে। সেখানে পাওয়া যাবে নিজেকে খুঁজে। বর্তমানে সন্দীপ একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের অন্যতম ।সন্দীপের প্রতিটি অক্ষরের মাঝে লুকিয়ে থাকে সমাজের চালচিত্র। প্রতিদিন থাকছে এই সমাজের কথকতা। একেবারে নতুন এক আঙ্গিক। একেবারে অন্য রকম আখ্যান গাথা
তুঁহু মম / ২৯
সন্দীপ চক্রবর্তী
নিরাসক্ত মনে কলকাতায় পৌঁছলাম। কারণ আমি জানতাম কী হতে চলেছে। মৃত্যু অনিবার্য জানার পর মানুষ হয় মৃত্যুভয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে আর নয়তো সবকিছু থেকে নিরাসক্ত হয়ে যায় আমার মতো। দমদম এয়ারপোর্ট থেকে রুরুদের বাড়িতে যাওয়ার সময় ট্যাক্সির পিছনের সিটে বসে আমার মনে হচ্ছিল রিয়্যালিটি থেকে অনেকটাই দূরে সরে এসেছি। সময় বলো, জীবন বলো--কেউ আমার নাগাল পাবে না।আমি নিজেই নিজের নাগাল পাব কিনা তারও বোধহয় ঠিক নেই।
জীবনে দুঃখ আমি কম পাইনি, কুমুদিনী। জ্ঞানগম্যি হবার আগেই মায়ের মৃত্যু, রানুদির নিষ্ঠুরতা, বাবার চলে যাওয়া--এই সব ঘটনাই আমার জীবনে দুঃখের পদচিহ্ন হয়ে রয়ে গেছে আজও। তুমি হয়তো বলবে, মৃত্যু দুঃখজনক হলেও স্বাভাবিক একটি ঘটনা। তাকে মেনে নেওয়াই ভালো। হ্যাঁ তাই। মেনে নেওয়াই ভালো। কিন্তু মৃত্যুকে মানতে পারলেও তার ফেলে যাওয়া শূন্যতা আমি মানতে পারিনি। এই শূন্যতা কোনও কিছুতেই ভরে না। সমাজ সংসারের দেওয়া সব কৌলিন্য উৎসর্গ করার পরেও আমি নিঃস্ব একাকী এক দলছুটের মতো পৃথিবীর ভিড়ে দাঁড়িয়ে থাকি। থেকে এসেছি এতকাল। কিন্তু রুরু যা করল তা বোধহয় মৃত্যুও পারত না। এমন নিঃশব্দে মৃত্যু কি কাউকে হত্যা করতে পারে? পারে না বোধহয়। সে যত নিষ্ঠুরই হোক, স্বাভাবিক থাকার জন্য মৃত্যুপথযাত্রীকে ঘোলাটে হয়ে আসা চোখদুটি তুলে তাকিয়ে থাকার সময় দেয়। কখনও কখনও সেই চোখ থেকে জলও গড়িয়ে পড়ে। কম্পমান হাতটি তুলে দূরে কী যেন দেখায় মানুষটা। তারপর হাতটা এক সময় পড়ে যায়। আর ওঠে না। থম মেরে বসে থাকা কয়েকটি মুখ বুঝতে পারে পুড়ে পুড়ে ধুপটা শেষ হয়ে গেছে। পড়ে আছে শুধু ধুপদানিতে আটকে রাখার কাঠিটা। আমার দুঃখ কোথায় জানো কুমুদিনী? রুরু আর আমার ভালোবাসার ধুপ ফুরিয়ে যায়নি। সে আরও অনেকদিন গন্ধ দিতে পারত। কিন্তু অহংবোধের হাড়িকাঠে রুরু তাকে খুন করে ফেলল।
সেদিন রুরুদের বাড়িতে যাবার সময় আমি এইসব কথাই ভাবছিলাম। রে ব্যান সানগ্লাসের আড়ালে আমার চোখের জল ক্যাব ড্রাইভার দেখতে পায়নি। প্রবল একটা নেতিবোধ আমাকে দুমড়ে মুচড়ে দিলেও মনে মনে বারবার ঈশ্বর নামের অদৃশ্য এক সত্তাকে বলছিলাম, এই কষ্ট আমি কাউকে দেখাব না। তিনি নিশ্চয়ই আমার কথায় হেসেছিলেন। কারণ তিনি জানতেন অনেকদিন পর তুমি আসবে। আমার মতো ভিতু, কাপুরুষ আর ভণ্ড একজন মানুষকে ভালোবাসবে। এবং সানগ্লাস খুলে ভেজা চোখে আমাকে আবার সব বলতে হবে। স্বীকার করতে হবে, হ্যাঁ কুমুদিনী, আমিও তোমাকে ভালোবাসি। কিন্তু কথাটা মুখে আনতে আমার ভয় করে। যদি তুমিও একদিন আমায় ছেড়ে চলে যাও--
যাই হোক, রুরুর কথা বলি। আমি বাড়িতে পা রাখা মাত্র শাশুড়ি ঠাকরুন কান্নাকাটি শুরু করে দিলেন। ওর একটাই কথা,'ইফ সামওয়ান রিজেক্টস আ ম্যান লাইক ইউ ইন সাচ আ হার্টলেস ম্যানার, হাউ ক্যান শি বি হ্যাপি ইন লাইফ?' --এ প্রশ্নের কোনও জবাব আমার কাছে ছিল না। আমি কিছু বলিওনি। শ্বশুর মশাই রুরুরই বাবা। ইগো তারও কিছু কম নয়। মেয়ের বিয়ে ভেঙে যাওয়ার থেকেও তার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ জীবনের বাজিতে অমল যোগলেকরের কাছে হেরে যাওয়া। পাইপ টানতে টানতে বললেন, 'ইফ ইউ ওয়ান্ট আই ক্যান ড্র্যাগ দ্যাট বাস্টার্ড ইনটু দা কোর্ট।'
আমি জানতাম রুরুর বাবা এরকমই কিছু একটা বলবেন। বললাম, 'আমি জানি আপনি সেটা পারেন। কিন্তু অমলকে কোর্টে টেনে নিয়ে যেতে পারলেও রুরুর
মন আপনি বদলাতে পারবেন না। কলকাতা শহরে ওর অ্যাডমায়ারারের অভাব নেই। অমল না থাকলে ও অন্য কাউকে খুঁজে নেবে?'
'তা হলে তুমি কী চাও?'
কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করলাম। মনকে শক্ত করতে যেটুকু সময় লাগে আর কী! তারপর আত্মহত্যা করতে চাওয়া মানুষ যেভাবে একগাদা ঘুমের ওষুধের ফেনায় আচ্ছন্ন গ্লাসের জল এক নিঃশ্বাসে খেয়ে ফেলে, ঠিক সেইভাবে বললাম, 'আমি ডিভোর্স চাই।'
শাশুড়ি ঠাকরুন ডুকরে উঠলেন, 'ডোন্ট ইউ ইভেন ওয়ান্ট টু ট্রাই টু গেট হার ব্যাক? আই নো মাই পুওর ডটার হ্যাজ রুইনড ইয়োর লাইফ। বাট আই বেগ ইয়োর হেল্প অর্জুন। প্লিজ ট্রাই টু গেট হার ব্যাক।'
পরের দিন আমি বর্ধমানে গেলাম। ওখানে একটা হোটেলে উঠে গাড়ি ভাড়া করে গেলাম অমলের ফার্ম হাউজে। বিশাল বড়ো ফার্ম হাউজ। দারোয়ানকে বললাম, 'আমি তোমার ঘরে বসছি। তুমি রুরুকে খবর দাও। বলো অর্জুন এসেছে।'
রুরু খবর পেয়ে রুরু দৌড়ে এল, 'তুমি এসেছ অর্জুন! আমি জানতাম তুমি আসবে। কালও অমলকে বলেছি। এখানে বসে আছ কেন? চলো ভেতরে চলো।'
'না রুরু। ভেতরে যাওয়ার জন্য বা থাকার জন্য আমি আসিনি। আমি শুধু তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি।'
রুরু কিছুক্ষণ পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থেকে বলল, 'আমি আর কোনওদিনই গুজরাটে যাব না অর্জুন। তুমি যদি কলকাতায় ট্রান্সফার নিয়ে চলে আসতে পারো একমাত্র তা হলেই আমি তোমার কাছে ফিরব।'
আমি মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করলাম, চেষ্টা করলে কি কলকাতায় ট্রান্সফার নেওয়া সম্ভব নয়? উত্তর এল, সম্ভব। খুবই সম্ভব। কিন্তু তুমি কি কলকাতায় ফিরতে চাও? আমি বললাম, না। কারণ ততদিনে একটা জিনিস আমার কাছে স্পষ্ট। কলকাতায় থাকলে রুরু কাগজে কলমে আমার স্ত্রী থাকবে ঠিকই কিন্তু ওর জীবনে অমল বা অমলের মতো স্তাবকেরা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। আই উইল বিকাম আ ট্রাসটেড ওয়াচডগ ফর এভার। না, সেটা আমি চাই না। বললাম, 'তার দরকার হবে না রুরু। তোমাকেও গুজরাটে যেতে হবে না আর আমিও কলকাতায় ট্রান্সফার পাব না। আমি তোমাকে আমার
কাছে নয়, তোমার বাবা-মা'র কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য এসেছি। ওরা চান তুমি ওদের কাছে ফিরে যাও।'
'তুমি কি চাও অর্জুন?'
'আমিও তাই চাই।'
'আমাকে তোমার কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাও না?'
আবার থমকালাম। নিজেকে বললাম, কম্প্রোমাইজকে স্যাক্রিফাইজ হিসেবে ধরে নিলে কোনও গ্লানি থাকে না অর্জুন। পারবে না এই শেষবারের মতো রুরুকে আরেক বার ক্ষমা করতে? মন সায় দিল না। ভারী নিষ্ঠুরের মতো বলল, কাউকে ক্ষমা করে সারা জীবন ভালোবাসতে না পারার থেকে তাকে ক্ষমা না করে জনারণ্যে হারিয়ে ফেলা ভালো। জলে ভাসিয়ে দেওয়া ভালো। হোক না সে অন্য কোথাও সুখী। তোমার কী দায়! বললাম, 'আমার সব চাওয়া তো তুমি শেষ করে দিয়েছ রুরু। এখন যদি তোমাকে ফিরিয়ে নিয়েও যাই, বোধহয় কোনওদিন বিশ্বাস করতে পারব না। আমাদের মাঝখানে একটা ছোট্ট হাইফেনের মতো এই বিশাল ফার্ম হাউজটা থেকে যাবে।'
'তার মানে ডিভোর্স চাও?'
'হ্যাঁ। তুমি ডিভোর্স স্যুট ফাইল করো। আমি কনটেস্ট করব না।'
অনেকক্ষণ কোনও কথা বলল না রুরু। বোধহয় আমাদের ঝাপসা হয়ে যাওয়া অ্যালবামটা মনে মনে দেখে নিল। তারপর বলল, 'এতদূর এলে এক কাপ চাও খাবে না?'
'না রুরু। অমল যোগলেকরের ফার্ম হাউজে বসে চা খাওয়ার রুচি আমার নেই।'
এই আমার গল্প কুমুদিনী। রুরু ডিভোর্স স্যুট ফাইল করেছিল। আমিও কনটেস্ট করিনি। আমাদের বিয়ে খুব সহজেই ভেঙে গিয়েছিল। কিন্তু জানো কুমুদিনী, পরে যতবার সেই দিনটার কথা ভেবেছি, মনে হয়েছে আমি বোধহয় মাত্রাতিরিক্ত নিষ্ঠুর আচরণ করেছি। আজও আমি রুরুর অবাক এবং আহত চোখদুটোর কথা ভুলতে পারিনি। রুরু কি ভেবেছিল আমি ওর সব আঘাত ভুলে ওকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে যাব? জানি না। আমি কিছুই জানি না। এই না-জানা আমাকে কুরে কুরে খায়। পারলে আমায় একটু শান্তি দিয়ো। বলে দিও কীভাবে মানুষ অতীত ভোলে। কীভাবে নিজেকে ক্ষমা করে।
ভালো থেকো
অর্জুনদা
(ক্রমশ)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন