রবিবাসরীয় সাহিত্যের দিন প্রতিদিন - সাহিত্যিক সন্দীপ চক্রবর্তীর অন্য ধারার গল্প গাঁথার ধারাবাহিক - " তুহু মম "
রবিবাসরীয় ধারাবাহিক
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের নবীন লেখক সন্দীপ চক্রবর্তী । সন্দীপ লেখেন, নিজের অনুভুতি দিয়ে। সেখানে পাওয়া যাবে নিজেকে খুঁজে। বর্তমানে সন্দীপ একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের অন্যতম ।সন্দীপের প্রতিটি অক্ষরের মাঝে লুকিয়ে থাকে সমাজের চালচিত্র। প্রতিদিন থাকছে এই সমাজের কথকতা। একেবারে নতুন এক আঙ্গিক। একেবারে অন্য রকম আখ্যান গাথা
তুঁহু মম / ২৬
সমস্যা শুরু হল যখন বিকাশ চেন্নাইয়ে বদলি হয়ে গেল। আমার জীবনযাপনে বিশেষ কোনও পরিবর্তন হয়নি। সারাদিন কাজের মধ্যে ডুবে থাকি। লোথালে কী ধরনের বাণিজ্য হত তার একটা কাঠামো আমি ততদিনে তৈরি করে ফেলেছি। যেসব দেহাবশেষ পাওয়া গিয়েছিল তাদের কার্বন ডেটিং এবং সম্ভাব্য দু-একটি ক্ষেত্রে ডিএনএ টেস্টের যে পরামর্শ আমি দিয়েছিলাম, কর্তৃপক্ষ তা মেনে নিয়েছেন। সুতরাং আমার ব্যস্ততা তখন তুঙ্গে। তবুও বাড়ি ফিরি রাত ন'টার মধ্যেই। কিন্তু ফিরে কী দেখি?
সেইসময় প্রতিদিন বাড়ি ফিরে দেখতাম রুরু ব্যালকনিতে বসে আছে। এতক্ষণ ধরে যে রুরুর কথা আমি বলেছি, এই রুরু সে নয় কুমুদিনী। মলিন ফ্যাকাসে মুখ। উসকোখুসকো চুল। বেশিরভাগ সময়েই রাতপোশাক পরে বসে থাকা এই রুরুকে আমি আগে কখনও দেখিনি। স্রেফ হাতের কাছে বন্ধু না পেলে যে মানুষ এমন মলাটছেঁড়া বইয়ের মতো অবিন্যস্ত হয়ে পড়ে আমার জানা ছিল না। অসহায় আর্তিতে আমি জিজ্ঞাসা করতাম,'কী হয়েছে রুরু?' সুদূর কোনও নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে রুরু বলত, 'কী আর হবে! বিকাশরা চলে যাওয়ার পর থেকে তো কিছুই হয় না। আর কিছু হবেও না বোধহয়।'
খুব রাগ হত তখন। বুঝতেই পারছ এ রাগ নিজেরই ওপর। যাকে আমি ভালোবাসি কেন তাকে সুখী করতে পারি না? নিজের বলতে আমার কিছু ভালোলাগা ছিল। কিছু ইচ্ছে ছিল। রুরুই তো আমার সেইসব মেঠো সুরকে পরিশীলিত রাগ-রাগিণীতে রূপান্তরিত করেছে। বনের রাখালের মাথায় রাজমুকুট পরিয়ে তাকে সম্রাট বানিয়েছে। বিনিময়ে আমি তাকে কী দিয়েছি? বড়ো অহংকার ছিল ওর একাকিত্ব আমি একাই ভরিয়ে দেব। কিন্তু পারছি কই? আমার কেমন যেন পাগল-পাগল লাগত। ক্লান্তিতে নুয়ে পড়ছে শরীর, বিছানায় শুলেই ঘুমিয়ে পড়ব--এই অবস্থায় আমি বলতাম, 'চলো রুরু, আজ আমরা কোথাও ইটিং আউট করি। বাড়িতে যা রান্না হয়েছে সব ফ্রিজে রেখে দিতে বলো।' রুরু একবার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে উঠে পড়ত। তারপর মুখে হাত চাপা দিয়ে হাই তুলে বলত, 'সরি। আজ একটুও ইচ্ছে করছে না। মাথাটা খুব ধরেছে।' বুঝতে পারতাম মাথা ধরাটা গৌণ। মুখ্য হল নিজেকে সরিয়ে নেওয়া। একে কী বলব, অভিমান? নাকি ক্ষোভ? যাই বলি মানেটা একই দাঁড়াবে।
সে বড়ো কঠিন সময় কুমুদিনী। প্রিয় মানুষটিকে চোখের সামনে বদলে যেতে দেখা খুব সহজ কাজ নয়। হয়তো কেউ কেউ রুরুর ব্যবহারকে বাড়াবাড়ির পর্যায়ে
রাখবেন। ওভাররিঅ্যাকশনের চার্জে ফেলবেন রুরুকে। কিন্তু আমি তা করব না। দোষও দেব না। আমি জানি অনেক মহিলাই তাদের হাজব্যান্ডদের কাজের জায়গায় গিয়ে থাকেন। নতুন জায়গায় গিয়ে নতুন-নতুন মানুষের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করে নিজের একটা জগত বানিয়ে নেন। তা হলে রুরু কেন তাই করল না? বিকাশ আর মালা চলে যাওয়ার পর রুরু কেন আমার অন্যান্য কলিগদের স্ত্রীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করল না? না কুমুদিনী, রুরুকে এ প্রশ্ন করার কোনও অর্থ হয় না। কারণ সেইসময় আমার কলিগদের মধ্যে মাত্র তিনজনই ছিলেন বিবাহিত। শেখর নটরাজন, বিক্রম ভাওয়াল আর অনন্ত রাও রেড্ডি। কিন্তু শেখর নটরাজনের স্ত্রী অম্বিকা হিন্দি ইংরেজি কোনোটাই বলতে পারতেন না। অনন্ত রাও রেড্ডির স্ত্রী সাবিত্রীর সমস্যাও মোটামুটি একই। এর ওপর তিনি আবার বাইরের লোকের সঙ্গে মেলামেশা করা পছন্দ করতেন না। আর বিক্রম ভাওয়ালের স্ত্রী শকুন্তলা আমাদের থেকে অনেকটাই বড়ো। তখনই তার পঞ্চান্ন-ছাপ্পান্ন বছর বয়েস। সারাদিন পুজো-আর্চা আর রান্নাবান্না নিয়ে থাকতেন। বাড়িতে কেউ গেলে কাজের
লোক বলে দিত, মিসেস ভাওয়াল এখন একটু ব্যস্ত আছেন। পরে ফোন করে আসবেন। কিন্তু মুশকিল হল নিজের দরকার না হলে শকুন্তলা ফোন অন করতেন না। একমাত্র বিক্রম ভাওয়াল জানতেন ঠিক কখন শকুন্তলাকে ফোনে পাওয়া যাবে।
এত কিছুর মধ্যেও প্রতি রবিবার আমাদের লং ড্রাইভে যাওয়া তখনও অব্যাহত ছিল। কিন্তু একদিন রুরু বলল, 'আমার ভালো লাগছে না অর্জুন। সপ্তাহে ছ'দিন তো বাড়িতেই থাকি। রবিবারেও থাকতে পারব।'
'একটা দিনই তো আমাদের সময় রুরু। এই একটা দিনই আমরা নিজেদের মতো করে কাটাতে পারি। প্লিজ তুমি না বলো না। দেখবে বাইরে বেরোলেই তোমার মন ভালো হয়ে যাবে।'
'সরি অর্জুন। প্লিজ ডোনট টেল মি টু প্লে আ হ্যাপি উওম্যান ফর আ ডে ওনলি। প্রত্যেক রবিবার আয়নায় যখন নিজেকে দেখি, মনে হয় একটা সং।'
অনেক বোঝালাম। কিন্তু রুরু আমার একটা কথাও শুনল না। প্রচণ্ড রাগ হয়ে গেল। চিৎকার করে বললাম, 'হোয়াট ডু ইউ ওয়ন্ট রুরু? ডু ইউ ওয়ন্ট মি টু লিভ দা জব অ্যান্ড গো ব্যক টু কলকাতা?'
'আই হ্যাভ নেভার টোলড টু লিভ দা জব। বাট আই মাস্ট সে দ্যাট ইউ শুড থিঙ্ক হাউ ইউ ক্যান স্পেন্ড কোয়ালিটি টাইম উইথ ইয়োর ওয়াইফ। প্লিজ ডু নট ডু এনিথিং টু কনসোল হার। আমি জানি সারা সপ্তাহ কাজ করার পর রবিবার তোমার কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। তবুও তুমি যাও আমার ভালো লাগবে বলে। অধিকাংশ দিন ফেরার সময় গাড়ি চালাতে চালাতে তুমি হাই তোলো। দু'একবার ঘুমে তোমার চোখ জড়িয়ে যেতেও দেখেছি। ভাগ্য ভালো এখানকার রাস্তায় হেভি ট্র্যাফিক নেই। নয়তো যে কোনও দিন একটা বিশ্রী অ্যাকসিডেন্ট হয়ে যেতে পারত। হাউ ক্যান আই এনজয় অ্যান আউটিং ইফ ইউ ডু নট এনজয় ইট? তাই বলছি যেদিন তুমি এনজয় করতে পারবে, সেদিন বোলো, আমি নিশ্চয়ই যাব। তার আগে নয়।'
সেদিন রুরু ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পর আমি অনেকক্ষণ একা বসে ছিলাম। রুরুকে খুব অচেনা লাগছিল। তুমি তো জানো কুমুদিনী ওর অভিযোগের অনেকটাই সত্যি নয়। ক্লান্ত থাকলেও রবিবারের জন্য অপেক্ষা করতাম আমিও। কারণ আমার ভালো লাগত রুরুর সঙ্গে একলা থাকতে। হ্যাঁ, এটা ঠিক ফেরার সময়
ঘুম নামত চোখে। কিন্তু শরীর আর মন তো সবসময়
সরলরেখায় চলে না কুমুদিনী। শরীর যখন বিশ্রাম চাইছে, তখনও কি মন মাঝে মাঝে চায় না বেরিয়ে পড়তে? অবুঝ হওয়াই তো মনের ধর্ম! অথচ রুরু শুধু আমার ক্লান্তিটাই দেখল, ক্লান্তি জয় করার স্পিরিটটা দেখল না। কত সহজে বলে দিল একদিনের জন্য সং সাজতে ওর ভালো লাগে না।
সেদিন রুরুর ব্যবহারে দুঃখ পেয়েছিলাম ঠিকই কিন্তু দুঃখকে জিততে দিইনি। মিনতি করেছিলাম দুঃখের কাছে, আমি তোমাকে সারাজীবন বুকে করে রাখব যদি তুমি রুরুকে সুখী করার একটা উপায় বলে দাও।
(ক্রমশ)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন