রবিবাসরীয় সাহিত্যের দিন প্রতিদিন - সাহিত্যিক সন্দীপ চক্রবর্তীর অন্য ধারার গল্প গাঁথার ধারাবাহিক - " তুহু মম "

 রবিবাসরীয়   ধারাবাহিক 


 আধুনিক বাংলা সাহিত্যের নবীন লেখক সন্দীপ চক্রবর্তী । সন্দীপ লেখেন, নিজের অনুভুতি দিয়ে। সেখানে পাওয়া যাবে নিজেকে খুঁজে। বর্তমানে সন্দীপ একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের অন্যতম ।সন্দীপের  প্রতিটি অক্ষরের মাঝে লুকিয়ে থাকে সমাজের চালচিত্র। প্রতিদিন থাকছে  এই সমাজের কথকতা। একেবারে নতুন এক আঙ্গিক। একেবারে অন্য রকম আখ্যান গাথা  

                 তুঁহু মম / ২৬       



সন্দীপ চক্রবর্তী

পুরীর ভজন কুটীরে সাতদিন কাটিয়ে আমরা ফিরে এলাম কলকাতায়। হনিমুন নিয়ে সকলেরই একটা ফ্যান্টাসি থাকে। কিন্তু দেখলাম বাস্তবের হনিমুন ফ্যান্টাসির থেকেও সুন্দর। সাতটা দিন রুরুকে সকাল-বিকাল আদর করে আর সমুদ্রের ধারে বসে শেলি,কিটস, রবীন্দ্রনাথের কবিতা আউড়ে কেটে গেল। উপরি পাওনা ছিল ভজন কুটীর। এত বছর পরেও বাড়িটা বিশেষ বদলায়নি। জানলায় দাঁড়ালে এখনও সমুদ্র দেখা যায়। লবণগন্ধী সামুদ্রিক হাওয়া হঠাৎ-হঠাৎ এসে সব এলোমেলো করে দেয়৷ আর অন্যমনস্ক কোনও মুহূর্তে শুনতে পাওয়া যায় মিষ্টি সুরেলা একটা গলা, 'এই সন্ধ্যেবেলায় ছাদে যাবি কী রে! না অজু, একদম না। কার্তিক মাস পড়ে গেছে। হিম পড়ে এইসময়। এখন ঠাণ্ডা লাগালে পুরো শীতটা ভুগতে হবে।'-- আমি যত বোঝাই,'মা এটা কার্তিক মাস নয়, ফাল্গুন মাস। এখন হিম পড়ে না। আর তা ছাড়া আমি কি কৃষ্ণনগরে আছি? আমি তো আছি পুরীতে। সমুদ্র সব হিম শুষে নেয়।' --কিন্তু কে কার কথা শোনে! জানলার ওপারে সারাক্ষণ শুধু হিম পড়ার গল্প। আর এপারে উষ্ণতার। মাঝখানে মৃত্যুর বুনে দেওয়া ব্যবধান। ঠান্ডা লাগার ভয় বুকের মধ্যে জাঁকিয়ে বসলেই মনে হত, আমি কি পারি না অন্তত একবার মা'কে ফাল্গুনে নিয়ে আসতে? আমার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করে মা তো চলেই যাবে। তা হলে মা কেন হ্যাপি এলিফ্যান্ট ডিজাইনের সোয়েটারটা আমার মাথা গলিয়ে পরিয়ে দেবার জন্য একবার আসতে পারে না?




অ্যামেরিকানরা বলে, ডোনট বি ইয়োর মাম্মিজ ডারলিং হোয়েন ইউ আর ইন হনিমুন। কিন্তু কুমুদিনী, আমি তো চিরকালই মাম্মিজ ডারলিং। মাকে বাদ দিলে তো আমার কিছুই থাকে না। তুমি যে অর্জুনকে চেনো, আমি যে অর্জুনকে চিনি--তারা সকলেই শ্রীমতি সরোজিনী দাশগুপ্তার অংশবিশেষ। অংশ হয়ে আমি কী করে পূর্ণকে অস্বীকার করি? সুতরাং হিমের গল্পটা থাক। সেইসঙ্গে সোয়েটারটাও থাক। নয়তো সত্যিই ঠাণ্ডা লেগে যাবে।
কলকাতায় ফেরার পর আবার সেই থোড় বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোড়ের জীবন শুরু হয়ে গেল। সত্যি কথা বলতে কী, যতদিন ছাত্র ছিলাম কলকাতাকে আমার ক্লিওপেট্রার মতো সুন্দরী মনে হত। মনে হত পৃথিবীর আর কোনও শহরের এমন মাধুর্য নেই। এমন প্রাণসম্পদ নেই। কিন্তু চাকরি পাওয়ার পর কলকাতার সেই মাধুর্য আর খুঁজে পেতাম না। মনে হত কলকাতা ভীষণ যান্ত্রিক। এখানকার লোক দিবারাত্র শুধু টাকার পিছনে দৌড়য়। জীবনটা যে বাঁচার জন্য সেটা ওরা জানেই না।--- তুমি হয়তো ভাবছ, এক-দু' বছরে কলকাতার কী এমন পরিবর্তন হল যে আমি হঠাৎ এরকম ভাবতে শুরু করলাম? না কুমুদিনী, কলকাতার কোনও পরিবর্তনই হয়নি। বদলে গিয়েছিলাম আমি। চাকরি পাবার পর ক্কচিৎ-কদাচিৎ কেউ কেউ এরকম বদলে যায়। একদিন হঠাৎ তার মনে হয়, যত ভালো চাকরিই করুক দিনের শেষে সে চাকর ছাড়া আর কিছুই নয়। হ্যাঁ, বেশ দামি চাকর। দুম করে কাজ ছেড়ে দিলে মালিককে মাথায় হাত দিয়ে বসতে হবে। আমারও এরকমই হচ্ছিল। তার ঝাঁঝটা পড়ছিল কলকাতার ওপর।
পরে আমি অনেক ভেবেছি। কেন তখন চাকরিটা আমার কাছে পায়ের বেড়ির মতো হয়ে উঠেছিল। এরকম হওয়ার কথা তো ছিল না। গবেষণার কাজ করতে আমার ভালোই লাগে। অফিসে আমি সেটাই করি। তা হলে কী হল? আসলে কী জানো কুমুদিনী, কলকাতায় এসে যে মুখোশ আমি পরেছিলাম তার এক্সপায়ারি ডেট পেরিয়ে গিয়েছিল। তাই মন আবার সেই চব্বিশ ক্যারেটের জীবনে ফিরতে চাইছিল। না, কৃষ্ণনগরে নয়। কোনও আরকিওলজিক্যাল সাইটে৷ যেখানে আমি হাতেকলমে কাজ করতে পারব। আর যেখানে নীল আকাশের নীচে খোলা হাওয়ায় বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারব। এবং যেখানে কাজ করলে আমার নিজেকে চাকর বলে মনে হবে না। বরং বিশ্বাস করতে পারব আমি দেশের কাজ করছি। ইতিহাসের কাজ করছি।
মন খারাপের অসুখ আমার চিরকালের। কিন্তু সেইসময়টায় ঠিক মন খারাপ নয়। অন্য এক অসুখ আমাকে পেয়ে বসেছিল। মনে হত আমার যা করা উচিত তা আমি করছি না। আমি জীবনের গভীরতম আনন্দের অংশীদার হতে পারি কিন্তু হচ্ছি না। এ এক অদ্ভুত স্ববিরোধিতা কুমুদিনী। আমি তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না। রুরুকেও পারিনি। খুব ছোট ছোট জিনিস নিয়ে রুরু টেনশন করত। রাগ করত। কখনও কখনও ঝগড়াও করত।
একদিনের ঘটনা বলি। সেদিন আমি পাজামা-পাঞ্জাবি পরে অফিসে গিয়েছিলাম। এরকম আমি মাঝে মাঝে যেতাম। পাজামা-পাঞ্জাবি আর কাঁধে একটা ঝোলা। আমার সহকর্মীরাও অনেকে এইভাবে অফিসে আসতেন। হাজার হোক আমি তো কোনও কর্পোরেট অফিসে চাকরি করি না যে ড্রেস কোড থাকবে। আমি একজন ইতিহাসবিদ--গবেষক। ওয়েস্টার্ন আউটফিট আমার কী কাজে লাগবে! কিন্তু সেদিন অফিস থেকে ফিরতেই রুরু বলল, 'তোমার ড্রেস সেন্স দিন-দিন খুব পুওর হয়ে যাচ্ছে অর্জুন। তুমি কতটা হ্যান্ডসাম জানো না। একটু ভালো ড্রেস পরলে যদি দেখতে আরও ভালো লাগে সেই চেষ্টাই তো করা উচিত। পাজামা-পাঞ্জাবি তুমি বাড়িতে পরছ ঠিক আছে। কিন্তু এসব পরে কেউ অফিস যায়?'
'কেন যাবে না! অনেকেই যায়। সুবিমলবাবু তো ধুতি-পাঞ্জাবি পরে আসেন।
'সে আসুন। তুমি ওইভাবে যাবে না। পিটার ইংল্যান্ডের যে-শার্ট দুটো কেনা হল ওগুলো কি ওয়ার্ডরোবে পড়েই থাকবে?'
'প্লিজ একটা কথা বোঝার চেষ্টা করো রুরু। আরকিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ায় যারা চাকরি করেন তারা সবাই খুব বড়ো স্কলার। ড্রেস-ফেস নিয়ে মাথা ঘামান না। কেউ কেউ তো বোতাম ছেড়া শার্ট পরেও দিব্যি চলে যান। সেখানে একজন যদি ফ্যাশন করে যায় তা হলে সেটা দেখতে খারাপ লাগে।'
'লজিকটা খুব বোকা-বোকা। ভালো স্কলার হলে ফ্যাশনেবল হওয়া যাবে না এটা কোথায় লেখা আছে? আসলে তুমি এবার অফিসের মতো হতে চাইছ। ইয়োর জব ইজ বিকামিং ইয়োর আইডেনটিটি। আই ডোন্ট লাইক দিস।'
অনেক বোঝালাম। কিন্তু রুরু বুঝল না। ওর একটাই কথা। কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় আমি যেরকম সিনেমার হিরোদের মতো স্টাইল করে ঘুরে বেড়াতাম, এখনও সেরকমই থাকতে হবে। ফরমাল ক্যাজুয়াল দুরকম ড্রেসেই নাকি আমাকে দারুণ মানায়। জিন্স টিশার্টে তো একেবারে মার্টিন জোন্সের মতো লাগে। এইসব ড্রেসের সঙ্গে অনুষঙ্গ হিসেবে থাকবে মেটাল ফ্রেমের রিমলেস চশমা, ঘাড় উপছানো চুল, ক্লিন শেভেন গাল, আফটার শেভ আর ডিওডেরান্টের গন্ধ এবং ঠোঁটে ঝুলন্ত কিংসাইজ ফিল্টার উইলস।
অম্লমধুর স্বাদের দিনগুলো এক-এক করে কেটে যাচ্ছিল। এরই মধ্যে অন্য একটা খবর এসে হাজির হল। দিল্লি অফিস জানাল ঈশ্বর আমার প্রতি সদয় হয়েছেন। আমাকে সাইট চিফ হিসেবে লোথাল আরকিওলজিকাল সাইটে যেতে হবে। ওখানে হরপ্পা শহরের অংশবিশেষ পাওয়া গেছে। সেখানে আরকিওলজিস্টদের টিমকে পরিচালনা করার দায়িত্ব আমারই।
আমি তো আনন্দে আত্মহারা। রুরুকে খবরটা দেবার জন্য ফোন করতে গিয়ে মনে পড়ল দু'দিন ধরে ফোন ডেড। তখন ফোন খারাপ হলে সাতদিনের আগে টেলিফোনের বাবুদের দেখা পাওয়া যেত না।
অগত্যা অফিস থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি নিয়ে ছুটলাম বাড়ির দিকে।

চিত্রঃ সংগৃহীত 

(ক্রমশ)

মন্তব্যসমূহ