ক্যানভাস
স্বপ্নসার্থক সুদীপ্তর, শেষ হলো ফ্রিউইংসের ছবিমেলা
এ এক অদ্ভুত প্ল্যাটফর্ম। সারসার ছবি ঝুলছে দেওয়ালে। পেশাদার গ্যালারির কেতা না মেনেই। তবে আলো, আয়োজন, পরিবেশে কোথাও কোনও খামতি ছিলো না। বরং বাড়তি পাওনা ছিলো রোজ নিয়ম করে একগুচ্ছ শিল্পীর সঙ্গে দর্শকদের নরক গুলজার। যার সুযোগ পেশাদার গ্যালারিতে মেলে না। তাও নাগাড়ে আটদিন। সবমিলিয়ে ছবির প্রদর্শনী না বলে, ছবিমেলাও বলা যেতে পারে।
কাউন্টডাউন শুরু হয়েছিল রবিবার বেলা দুটোয়, হল খোলার পর থেকেই। রাত আটটার পরেও তা যেন শেষ হতে চায় না। শেষ হলেও রেশ থেকে যায়। তখন ভাঙা মেলা। মেলার মতোই ফ্রিউইংসের প্ল্যাটফর্মেও কোনও জাত, বর্ণের বাছবিচার ছিলো না। হেভিওয়েট শিল্পীর পাশেই ঝুলেছে লাইটওয়েটের ছবি। কন্টির পাশেই এক্রিলিক। দেড়ফিট, দুফিটের পাশেই তিন বাই আড়াই ফুটের ক্যানভাস। বৈষম্যহীন আনন্দ আয়োজন।
যাদের জন্য শিল্পীরা ছবি আঁকেন, যাদের জন্য এই বর্ণময় আয়োজন, সেই দর্শকদের সংখ্যাও শেষদিন পর্যন্ত ছিলো যথেষ্ট ভালো। এঁদের কেউ ছিলেন আমন্ত্রিত আবার অধিকাংশই নিছক রসিক দর্শক। ছবি দেখতে ছুটে এসেছিলেন স্বেচ্ছায়, নেহাতই প্রাণের টানে। সবাই দুচোখ ভরে ছবি দেখেছেন। এমনকি গ্যাঁটের কড়ি খসিয়ে বেশকিছু ছবিও কিনেছেন।
কালীপুজোর পরদিন, শুক্রবার বিকেলে পাশের মাঠেই বসেছিল বসে আঁকোর আসর। প্রতিযোগিতা শেষ হতেই সেখান থেকে জলস্রোতের মত এক্সিবিসন হলে ঢুকে পড়লো একদল ছেলেমেয়ে, কচিকাচার দল। সে এক অন্য আবহাওয়া।
দক্ষিণ কলকাতার গড়িয়াতে ছবির এক্সিবিসন করার কথা আচমকাই কীভাবে মনে এলো?
'এই এলাকায় অসংখ্য শিল্পীর বাস। শিল্পরসিকের সংখ্যাও কম নেই,' বলেন সুদীপ্ত অধিকারী। 'তাই ঠিক করে ফেললাম, এখানেই এক্সিবিসন করবো।'
সাধারণ দর্শকরা পৌঁছোন ছবি দেখতে। তাহলে ছবিই বা দর্শকের কাছে পৌঁছোবে না কেন? এই তত্ত্বের ওপর দাঁড়িয়েই শিল্পী বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন সুদীপ্ত। আর তারপর যা হলো, তাতো আমরা স্বচক্ষেই দেখলাম।
প্রদর্শনীতে সব্যসাচীর ভূমিকা ছিলো সুদীপ্তর। একদিকে প্রদর্শনীর আয়োজনে ব্যস্ত থেকেছেন। আবার কর্পোরেট কেতার ভাষায়, পিআরও'র কাজটিও সামলেছেন তিনিই। আবার অন্যদিকে প্রদর্শনীর জন্য ছবি এঁকেছেন।
কেমন ছবি আঁকেন তিনি?
রং নিয়ে রংবাজি খেলতে চান সুদীপ্ত অধিকারী। ক্যানভাস জুড়ে ভায়ব্রেন্ট কালারের ছড়াছড়ি। দুই বিপরীত রংয়ের সংঘাত থেকেই বেরিয়ে আসে সুদীপ্তর ছবি। ঘননীল পটভূমি জুড়ে হলুদ, সাদার বৃষ্টি। মধ্যে আবার লালের ছিটেফোঁটা। তারার খসে পড়া হতে পারে, আবার উল্কার ধেয়ে আসাও হতে পারে। সবমিলিয়ে রংয়ের মহোৎসব। সেই উৎসবে নানা রংয়ের ভিড়ে হঠাতই দেখা হয়ে যায় এক মানবিক অবয়বের। বোঝা যায় বিশ্বের ব্যাপকতা। মানবশরীরের ক্ষুদ্রতা। বিশ্বের ক্ষমতা হাতের মুঠোয় নিতে চলছে জোর কাড়াকাড়ি। প্রকৃতি মায় বিশ্বকে ছাপিয়ে মাথা তুলতে চাইছে বিশ্বরাজনীতির শক্তিধররা। ঠিক এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে সুদীপ্ত যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চাইছেন মানবজাতির ক্ষুদ্রতা।
এই অন্ধকার জগত থেকে উড়ে যেতে ডানা মেলে সুদীপ্তর কল্পলোকের কোনও এক চরিত্র। আবার কোথাও যেন রংয়ের ঝর্ণায় অবগাহন করে কোনও এক রহস্যময় শরীর। তার শরীরের আভায় বিচ্ছুরিত দশদিশি। ক্যানভাসের সামনে দাঁড়ালে ভাবনাচিন্তার পরিসর যতটা না থাকে, তারচেয়ে অনেক বেশি থাকে দুচোখ ভরে শুধুই দেখা। মেধা না, কবজির জোর লাগে বটে, তবে সুদীপ্ত আসলে ছবি আঁকেন আবেগের রংয়ে।
প্রদর্শনীতে ছবি দেখা গেলো অতীন বসাক, নবকুমার চক্রবর্তী, বাদল পাল, রঞ্জনা চ্যাটার্জির মতো পরিচিত শিল্পীদের বেশকিছু উঁচুদরের কাজ। দৃষ্টিনন্দন কাজ দেখালেন রুচিরা মজুমদার, সুমন চৌধুরী, বাপ্পা ভৌমিক, মিহির কয়াল, প্রতীক মল্লিকের মতো শিল্পীরাও। পরিচিত গণ্ডির বাইরে গিয়েও যে কিছু করে দেখানো যায়, তার চমৎকার নজির তৈরি করলো সুশীলা ভবনে "ফ্রিউইংস'- এর প্রদর্শনী।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন