রবিবাসরীয় সাহিত্যের দিন প্রতিদিন - সাহিত্যিক সন্দীপ চক্রবর্তীর অন্য ধারার গল্প গাঁথার ধারাবাহিক - " তুহু মম "

  রবিবাসরীয়   ধারাবাহিক 


 আধুনিক বাংলা সাহিত্যের নবীন লেখক সন্দীপ চক্রবর্তী । সন্দীপ লেখেন, নিজের অনুভুতি দিয়ে। সেখানে পাওয়া যাবে নিজেকে খুঁজে। বর্তমানে সন্দীপ একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের অন্যতম ।সন্দীপের  প্রতিটি অক্ষরের মাঝে লুকিয়ে থাকে সমাজের চালচিত্র। প্রতিদিন থাকছে  এই সমাজের কথকতা। একেবারে নতুন এক আঙ্গিক। একেবারে অন্য রকম আখ্যান গাথা  

                 তুঁহু মম / ২৬       



সন্দীপ চক্রবর্তী

রুরু সব শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, 'লোথাল! সে তো অনেক দূর।'

'গুজরাটে।'
'গুজরাট! তা হবে। আমাকেও কি যেতে হবে?'
আমি বেশ অবাক হলাম। ভেবেছিলাম রুরু খবরটা শুনে খুশিতে পাগল হয়ে যাবে। কিন্তু খুশির কোনও চিহ্ন ওর চোখেমুখে খুঁজে পেলাম না। কেমন একটা অন্যমনস্ক ভাব। উদাসীনতা। অন্য কেউ হলে হয়তো সেদিনই ভবিষ্যতের একটা ইঙ্গিত পেয়ে যেত। আমি পাইনি। কারণ আমার মন তখন কলকাতাকে বিদায় জানিয়ে লোথালে উড়ে গেছে। শরীরটাকে কোনওরকমে দরজা দিয়ে গলিয়ে প্রাচীন হরপ্পা শহরের ছায়ায় নিয়ে গিয়ে ফেলতে পারলেই আমি তখন বাঁচি। কলকাতা আর আমার ভালো লাগছে না। কিন্তু এটাও তো ঠিক যে রুরুই আমার শক্তি। আমার ভালোবাসা। ও যদি আমার আকাশছোঁয়া আনন্দের দিনে এমন উদাসীন হয়ে থাকে তা হলে আমি কীভাবেই বা স্বপ্নপূরণের লগ্নটিকে সার্থক করে তুলতে পারি? অভিমান হল খুব। জিজ্ঞাসা করলাম, 'কেন, তুমি কি যেতে চাইছ না?'
রুরু বোধহয় লজ্জা পেল, 'না না তা নয়। আসলে কলকাতার বাইরে বেড়াতে গিয়ে আট-দশ দিনের বেশি কখনও থাকিনি। কিন্তু এ তো একরকম পারমানেন্টলি চলে যাওয়া। তাই ভাবছি।'
'কী ভাবছ?'
'তেমন কিছু না। মানে, কলকাতাতেই তুমি এত ব্যস্ত যে আমার দিকে তাকানোর সময়ও তোমার নেই। এখানে তবু আমার ক্লাব আছে, সোসাইটি আছে, ড্যাডি-মাম্মি আছে--- ওখানে তো আমি কাউকে চিনিই না। সারাদিন একা-একা আমি কী করব?'
মনে হল রুরুর আশঙ্কা অমূলক নয়। ইদানীং সত্যিই কলকাতার অফিসে চাপ মারাত্মক বেড়ে গেছে। রাত দশটার আগে কোনওদিন বাড়ি ফিরতে পারি না। লোথালেও যদি এরকম অবস্থা হয়--সত্যিই তো, সারাদিন কী করবে রুরু? দিনের পর দিন কি কেউ বাড়িতে একা ভূতের মতো বসে থাকতে পারে? অভিমান গলে জল হয়ে গেল। একটা সম্ভাবনার কথাও মনে পড়ল। বললাম, 'একটা রাস্তা আমি দেখতে পাচ্ছি। ওখানে তো অন্য অফিসাররাও আছেন। ওদের ওয়াইফরা নিশ্চয়ই সময় কাটানোর জন্য ক্লাব-টাব কিছু করেছেন। যেসব মহিলা হাজব্যান্ডদের সঙ্গে ওখানে আছেন তারা ডেফিনিটলি হাউজওয়াইভস। ইউ ক্যান জয়েন দেম। তবে তার পরেও একটা কথা থেকে যায়।'
'কী কথা?'
'যদি ওখানে তোমার ভালো না লাগে--কিছুদিন থাকার পরেই তুমি বুঝতে পারবে ভালো লাগছে কিনা--তুমি চলেও আসতে পারো।'
রুরু হেসে বলল, 'আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু কাম ব্যাক অর্জুন। আই ওয়ান্ট টু স্টে উইথ ইউ। কিন্তু কী বলো তো, নাউ ইউ আর আ চেঞ্জড পারসন। তুমি আর সেই আগেকার অর্জুন নও। রুরুকে তোমার পাওয়া হয়ে গেছে। নাউ শি ইজ জাস্ট টেকেন ফর গ্রান্টেড। তাই ভয় হয়। যদি পুরনো রুরু ফিরে আসে?'
'রিল্যাক্স রুরু। আই নো দিস কনফ্লিক্ট। তুমি এর আগেও বলেছ। পুরনো রুরু আর কোনওদিনই আসবে না। কেন আসবে না জানো? বিকজ ইউ আর দা লাইটহাউজ ইন মাই লাইফ। আর, লাইট ক্যান নট বি টেকেন ফর গ্রান্টেড রুরু।'
রুরু হঠাৎ রেগে চিৎকার করে বলল, 'হাউ ডু ইউ নো আসবে না? আমি জাস্ট ওকে একটা ঘরে বন্ধ করে রেখেছি। মেরে ফেলতে পারিনি। সামটাইমস শি শাউটস বিহাইন্ড দা বার, ওপেন দা ডোর, ইউ ব্লাডি বিচ। ডোন্ট ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড, দা ম্যান ইউ ডাই ফর, ট্রিটস ইউ অ্যাজ আ বাঞ্চ অফ ব্রোকেন লিলি? মলেসটেড অ্যান্ড ডেসট্রয়েড। ওপেন দা ডোর। ওপেন দা---'
কথা শেষ করতে পারল না রুরু। উত্তেজনায় ওর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। হাপরের মতো ওঠানামা করছে বুক। সুন্দর মুখ সম্পূর্ণ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। আমি ওর এই অন্তর্দ্বন্দ্বের কথা জানি। নিজেকে নিয়েই ওর যত ভয়। কিন্তু সেদিনের মতো এতটা ভেঙে পড়তে ওকে আগে কখনও দেখিনি। এই অবস্থায় আমার উচিত ছিল লোথালে যাওয়া অন্তত কিছুদিনের জন্য পিছিয়ে দেওয়া। অথবা একেবারেই না যাওয়া। কিন্তু আমি তা করিনি। হ্যাঁ কুমুদিনী, স্বপ্নপূরণের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে তাকে উপেক্ষা করার মতো মনের জোর আমার ছিল না। নিতান্ত স্বার্থপরের মতো, কাপুরুষের মতো আমি বলেছিলাম,' আমি আছি তো রুরু। আবার আমি আগেকার মতো হয়ে যাব। তোমার গায়ে আমি কোনও আঁচ লাগতে দেব না।'
রুরু বাচ্চা মেয়ের মতো বলল, 'আর ও যদি আসে?'
'আসুক না। আমি ওকেও ভালোবাসব। পুরনো রুরুও একদিন নতুন হয়ে যাবে।'


লোথাল/গুজরাট 


দিন সাতেক পর আমরা গুজরাট রওনা দিলাম। আমেদাবাদে দু'দিন থেকে সোজা লোথাল। আমেদাবাদ-ভাবনগর রেলপথেই পড়ে লোথাল। সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতায় লোথাল ছিল বন্দর নগরী। এই শহরের নির্মাণ শুরু হয়েছিল ২২০০ খ্রীস্ট পূর্বাব্দে। ২৪০০ খ্রীস্ট পূর্বাব্দ নাগাদ কাজ শেষ হয়। ১৯৫০ সালে লোথালের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেছিলেন পুরাতত্ত্ববিদেরা। লোথালে যে বন্দর ছিল সেটা তখনই বোঝা গিয়েছিল। কিন্তু আমাদের দেশের কিছু পণ্ডিত কথাটা মানেননি। পরে ওসিয়ানোগ্রাফির গবেষকেরা ভূগর্ভস্থ জল পরীক্ষা করে প্রমাণ করেন যে হ্যাঁ, একসময় সমুদ্র ছিল লোথালের কাছেই। তারপর মাটির নীচে প্রাচীন জাহাজের কংকাল আবিষ্কারের পর পরিষ্কার বোঝা গিয়েছিল লোথাল সত্যি সত্যিই বন্দর ছিল।

লোথালে আমার কাজ ছিল উৎখননের ফলে প্রাপ্ত কিছু তথ্যপ্রমাণ বিশ্লেষণ করা। বিশেষ করে লোথালে কী ধরনের বাণিজ্য হত সেটা দেখাও ছিল আমার কাজ। বলতে পারো আমি কাজের মধ্যে ডুবে গিয়েছিলাম। তুমি তো জানো কুমুদিনী, প্রকৃতি আমার কত প্রিয়। লোথালের আকাশ-বাতাস, লুপ্ত বন্দর নগরীর প্রাচীন রাস্তাঘাট, অসম্ভব উন্নত ড্রেনেজ সিস্টেম আমাকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করত। কাজের ফাঁকে সামান্যতম অবসর মিললেই আমি অফিস থেকে বেরিয়ে সাইটে ঘুরে বেড়াতাম। আমাকে সব থেকে বেশি আকর্ষণ করত পাঁচ হাজার বছর আগেকার সেই ওয়াশরুমটি।
রুরুও বেশ ভালোই ছিল। সহকর্মীদের মধ্যে বিকাশ দেশমুখের সঙ্গে কলকাতাতেই আমার আলাপ হয়েছিল। লোথালে বিকাশ আর ওর বউ মালাই ছিল আমাদের সব থেকে কাছের বন্ধু। মালার সঙ্গে রুরুর সম্পর্কটা ছিল বেশ মাখো-মাখো ধরনের। কারণ মালা বাঙালি। স্কটিশ চার্চের ছাত্রী। রুরুর মতো মালাও ইংলিশ কালচারে বড়ো হয়েছে। ওরা প্রায়শই কাছেপিঠে ঘুরতে চলে যেত। আমার বিরুদ্ধেও রুরুর কোনও অভিযোগ ছিল না। যত ব্যস্তই থাকি বাড়ি ফিরতাম রাত ন'টার মধ্যে। রোববারে রুরুকে নিয়ে চলে যেতাম লং ড্রাইভে। উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে বেড়িয়ে, মাঝে মাঝে মাঝ রাস্তায় গাড়ি পার্ক করে গাছের নীচে পা ছড়িয়ে বসে আমরা কাটিয়ে দিতাম ছুটির দিনগুলো। যৎসামান্য আয়োজনে ভালো থাকার পাসওয়ার্ড আমরা পেয়ে গিয়েছিলাম। অন্তত লোথালে যাওয়ার পর প্রথম দু'বছরে পুরনো রুরুর ফিরে আসার কোনও সম্ভাবনাই দেখা যায়নি।
কিন্তু এত করেও শেষরক্ষা হল না।

(ক্রমশ)



ছবিঃ সংগৃহীত 


মন্তব্যসমূহ