বেহালার দিন প্রতিদিন বিশেষ কাজল ভট্টাচার্যের কলমে রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী পীযুষ কান্তি সরকারের জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য - " রবীন্দ্রসঙ্গীতের 'পিকাসো' পীযূষকান্তি "

 বেহালার দিন প্রতিদিন বিশেষ 

 রবীন্দ্রসঙ্গীতের 'পিকাসো' পীযূষকান্তি 


 -  কাজল ভট্টাচার্য

বড্ড তাড়াতাড়ি বাঙালি ভুলে গেলো তাঁকে। পীযূষকান্তি সরকারের কথা বলছি। তাঁর সেই দরাজ গলার রবীন্দ্রসঙ্গীত। গত দু'দশক তিনি আর আমাদের মধ্যে নেই। থাকলে অক্টোবর ৩১ তারিখে আমরা তাঁর চুরাশিতম জন্মদিন পালনে মেতে উঠতাম।  )

'তখন পাতায় পাতায় বিন্দু বিন্দু ঝরে জল!'
জল ঝরে পড়ার ওই শব্দকে কবিগুরু ধরেছিলেন শব্দের আখরে। গায়ক তাকে ধরলেন গলার মডিউলেসন, বা স্বরক্ষেপণে।
সুর, তাল, লয়, মীর, গমকের ফাঁকে ফাঁকে যে আরও কিছু লুকিয়ে থাকে, সঙ্গীতের সেই অন্তর্নিহিত সত্তার সঙ্গেই মিতালি পাতিয়েছিলেন পীযূষকান্তি। তাই তাঁর গলায় ধরা পড়তো রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনন্য এক রূপ। একদা সেই রূপেই মজেছিলো রসিক শ্রোতা।

নিন্দুকের সংখ্যা মন্দ ছিলো না।
তারিফ করার মানুষের সংখ্যা ছিলো আরও বেশি। 'এসেছিলে তুমি আসো নাই,' গানের অন্তরাতে ওই কলিটি এলেই, বিন্দু বিন্দু শব্দটা এমন ভেঙে গাইতেন যে চোখের সামনে বৃষ্টিভেজা দিনের ছবিটা মূর্ত হয়ে উঠতো। মনের ক্যানভাসে ফুটে উঠতো সেই ছবি। বৃষ্টিস্নাত গাছ। পাতা থেকে টপ টপ করে গড়িয়ে পড়ছে জল।
'এই গানের সঙ্গে দারুণভাবে মোৎজার্ট ব্যবহার করা যায়,' বলেছিলেন পীযূষকান্তি। তাঁর মতে, রবীন্দ্রনাথের রাগ ভৈরবীর গানে মোৎজার্ট ব্যবহারের এক অদ্ভুত পরিসর ছিলো। পাশ্চাত্য ধ্রুপদ সঙ্গীতে নিজেকে শিক্ষিত বলতে রাজি ছিলেন না পীযূষকান্তি। তবে ঘনিষ্ঠতা ছিলো বেশ মাখোমাখো। আর ছিলো প্রাচ্যের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম। তাই তিনি অতি সহজেই বলতে পারতেন, 'রবীন্দ্রসঙ্গীতের মধ্যে গোটা দুনিয়ার সুর খুঁজে পাই।'

আজ অবশ্য কেউই নেই। না নিন্দুক, না প্রশংসক। বিস্মৃতির অতল গর্ভে হারিয়ে গেছেন সেই দরাজ গলার গায়ক পীযূষকান্তি সরকার। যিনি সুর ধরলেই তন্ময় হয়ে যেতেন রসিক শ্রোতা। সুরের ইন্দ্রজালে বন্দি গোটা অডিটোরিয়াম। শিল্পী গেয়ে চলেছেন- গানে গানে তব বন্ধন যাক টুটে। রাগ আশাবরী- ভৈরবীর মোহে আচ্ছন্ন শ্রোতাদর্শক।

সেই অর্থে পরিবারে কোনও সঙ্গীতচর্চা বলে কিছু ছিলো না। তবে মা, স্মৃতিকণা দেবী হেঁসেলে খুন্তি নাড়তে নাড়তেও রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন। 'তখন আমার কতোই বা বয়স, সাড়ে চার পাঁচ,' বলেন পীযূষকান্তি। 'বেশ লাগতো মায়ের গলায় ওই গান শুনতে,' এক সাক্ষাতকারে স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে বলেছিলেন শিল্পী। 'মা গাইতেন সে যুগের ধারা মেনে, একটু অন্যরকম উচ্চারণে।' 
গানের দিকে ছেলের ঝোঁক চোখ এড়ায়নি মায়ের । তাঁর উৎসাহেই ছেলে পীযূষকান্তির সঙ্গীত সফর শুরু। 'বয়স বাড়ার সঙ্গে বাড়লো বোধ। বুঝতে পারলাম রবীন্দ্রনাথ ছাড়া গতি নেই,' বলেন শিল্পী।
#
উঠতি ভক্তদের কাছে শিল্পী পীযূষকান্তি ছিলেন 'পিকাসো'। নামটি অবশ্য পিতৃদত্ত না, বন্ধুর দেওয়া। বন্ধু মুরারী বসু পীযুসকান্তিকে ডাকতেন 'পিকাসো' বলে। তখন উলুবেড়িয়ার কলেজে ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র শিল্পী। মুরারী সম্ভবত বন্ধুর ভবিষ্যত দেখতে পেয়েছিলেন। পিকাসো নাম সার্থক করেছিলেন পীযূষকান্তিও। কবিগুরুর শব্দে সুরের রং মাখিয়ে যথার্থই নান্দনিক পরিবেশন করতেন একের পর আর এক গানের। দেখতে দেখতে ওই পিকাসো নামটাকেই আপন করে নিয়েছিলো অনুরাগীরা। পীযূষকান্তির গান নিয়ে সেদিন কম পাগলামি করেনি তাঁর অল্পবয়সী ভক্তরা।

গোড়ার দিকে টান ছিলো ধ্রুপদী সঙ্গীতের দিকেই। পন্ডিত নিদানবন্ধু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে খেয়ালশিক্ষা। মনোযোগী শ্রোতা হয়ে আত্মস্থ করা কালীপদ পাঠকের টপ্পা। সুর তাল লয় নিয়ে স্বচ্ছন্দে খেলা করাটাই ছিলো অভ্যাস। আজ অনেকেই রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইবার আগে, মূল শাস্ত্রীয় সঙ্গীতটিও শোনান। রসিক শ্রোতার অনেকেই হয়তো জানেন না, মঞ্চে উঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত ধরার আগে অনেক সময়েই মূল রাগটিও শোনাতেন পীযূষকান্তি। তান ধরতেন। গানের প্রতিটি শব্দের মর্মার্থ উদ্ধার করতেন নিপুণ গলায়। তখন গান শুধু গান থাকতো না। বরং হয়ে উঠতো শব্দসুরের এক ছবি। 
সেই ছবি দেখে গোঁসা করেছিলেন বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ডের কেষ্টবিষ্টুরা। সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছিলেন শিল্পী। তবু দমে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না পীযূষকান্তি সরকার।

পীযূষকান্তির গায়কীতে রসিক শ্রোতার অনেকেই খুঁজে পেতেন আর এক দিকপাল দেবব্রত বিশ্বাসকে। ধরাবাঁধা আঙ্গিকে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়ার সেই প্রচলিত ধারাকে চুরমার করে দিয়েছিলেন দেবব্রত। অগ্রজর দেখানো সেই রাস্তাতে হাঁটতে গিয়ে একইভাবে হোঁচট খেয়েছেন পীযূষকান্তি। বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ডের অনুমোদন পায়নি তাঁর গান। ঠিক সেমুহূর্তেও হয়তো মনে বল জুগিয়েছেন সেই কবিগুরুই। 
'পথে যদি পিছিয়ে পড়ি কভু
ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু!'

দেবব্রতর মতোই পীযূষকান্তিও ব্রাত্য হতে বসেছিলেন আর কী! যাঁরা আলোআঁধারির অডিটোরিয়ামে বসে মঞ্চে পীযূষকান্তির গান শুনেছেন, একমাত্র তাঁরাই স্বাদ পেয়েছিলেন এক অনন্য অভিজ্ঞতার। 
হারমোনিয়াম ধরে বেশ জমিয়ে বসে গান গেয়ে চলেছেন শিল্পী। আচমকাই উঠে দাঁড়ালেন। বাঁ হাতে মাউথপিস। দৃপ্তকন্ঠে গান ধরলেন- একদিন যারা মেরেছিল তাঁরে গিয়ে। 'মারো মারো' শব্দের ওপর কী ভীষণ জোর। মিশ্র ইমনের সেই সুরে কিন্তু কোথাও কোনও বিচ্যুতি নেই। গোটা হল তখন আবেগে ভাসছে। একই ছবি যখন তিনি ধরতেন- আমার সোনার বাংলা।
'আর যাই হোক,' বলতেন পীযূষকান্তি, 'এই গানগুলি বসে গাওয়া যায় না।'

অতি নাটকীয়তা! অনেকেই অভিযোগ করতেন। হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। সেই আকচাআকচিতে যাবো না। মোদ্দা কথা, কোনদিনই সুললিত কন্ঠে নিছক রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েই শিল্পীর দায় ঝারেননি পীযূষকান্তি। অন্তরের উপলব্ধিতে ভর করে তিনি গলায় তুলে আনতেন গোটা রবীন্দ্রনাথকেই। রবীন্দ্রনাথকে বিকশিত করতেন শিল্পী তার নিজের সমস্ত সত্তাটুকু উজার করে। প্রাণের আকুতি মূর্ত হতো পীযূষকান্তির শরীরে ভর করে। গায়ে কোনও প্রতিষ্ঠানের সিলমোহর ছাড়া ফুলেশ্বর থেকে উঠে আসা সেই তরুণ তুর্কির রকমসকমে ভীষণরকম আপত্তি দেখিয়েছিল বাংলার তথাকথিত রক্ষণশীল রবীন্দ্র অনুরাগী সমাজের এক ব্যাপক অংশ।


বেশ কিছুদিন ধরেই হাজারোরকম এক্সপেরিমেন্ট চলছে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে। আজ আর বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ডের অনুমোদনের অপেক্ষায় বসে থাকতে হয় না শিল্পীর। কোথাও মিশেল হচ্ছে ধ্রুপদ। আবার কোথাও ফিউসন। নতুন আঙ্গিকের সেই রবীন্দ্রসঙ্গীতের কোনও কোনওটা হিট হচ্ছে। আবার মুখ থুবড়ে পড়ার সংখ্যাটাও কম নয়। প্রশ্নটা অন্য জায়গায়। রবীন্দ্রসঙ্গীতের শুদ্ধতা রক্ষাই না, তার আভিজাত্য থাকছে কি? পীযূষকান্তির গায়কী নিয়েও অজস্র প্রশ্ন তুলেছিলেন বুদ্ধিজীবীরা। তবে সেসব ধোপে টেকেনি। রসিক শ্রোতার মন কেড়ে নিয়ে ঝড়ের বেগে এগিয়ে গেছিলেন শিল্পী।

রঙিন লম্বা ঝুলের পাঞ্জাবি, পাচাপা পাজামা, চোখে চশমা, মাঝে সিঁথি কাটা একমাথা লম্বা চুল, লম্বা দাড়িওয়ালা পীযুসকান্তির চেহারাটাও বেশ চোখ টানতো। গানের ফাঁকে ফাঁকে টুকরো কথা, অভিজ্ঞতার, গানের। আর সেসব মিলিয়ে মিশিয়ে বেশ এক মেহফিল সাজিয়ে, খোশ মেজাজে গান শোনাতেন শিল্পী।
ঝড়ের মতো এসেছিলেন। চলেও গেছিলেন সেভাবেই। মধ্যে ছোট্ট সঙ্গীত জীবন। আমরা চোখের সামনে শিল্পীকে প্রথমবার দেখেছিলাম অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসের মঞ্চে। সালটা ছিলো ১৯৮৩। একাই মাতিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। সেই সঙ্গে উসকে দিয়েছিলেন সমালোচনার বারুদ। তারপর সুদীর্ঘ অপেক্ষা এগারো বছরের। সাল ১৯৯৪। বাজারে এলো পীযূষকান্তির রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রথম অ্যালবাম। কিন্তু সেখানেও বিশ্বভারতীর ফসকা গেরো। শিল্পীর বারোটি গানের মধ্যে ছাড়পত্র পেলো মাত্র চারটি। 

এর কিছুদিন পর বাজারে এলো শিল্পীর অ্যালবাম 'গানের খেয়া'। বিশ্বভারতীর গেরো একটানে ছিঁড়ে ফেললেন রসিক শ্রোতারা। 'গোল্ডেন ডিস্ক'- এর মর্যাদা ছিনিয়ে নিলেন পীযূষকান্তি। এরপর আর মাত্র পাঁচটি অ্যালবাম করেই সঙ্গীত সফর শেষ করেছিলেন শিল্পী। ১৯৮৩কে মাইলস্টোন ধরলে মাত্র আঠারো বছরের সঙ্গীত জীবন শিল্পী পীযূষকান্তি সরকারের।

তবে সব শুরুর নেপথ্যেই আর এক শুরু থাকে। সেই শুরু হয়েছিল পীযূষকান্তির বয়স যখন মাত্র দশ। শিল্পীর জন্মস্থান বহরমপুরের মঞ্চে গান শুনিয়েছিলেন শ্রোতাদের। এরপর কলেজে গানের প্রতিযোগিতায় পুরস্কার প্রাপ্তি। সাল ১৯৬৯। হাতে এলো এক মস্ত সুযোগ। নেপথ্য শিল্পী হয়ে কন্ঠদান করলেন অষ্ট্রেলিয়ান ফিল্ম ইনস্টিটিউটের পরিচালক পলকক্সের তথ্যচিত্র 'কলকাতা সঙ্গীত'য়ে। ঠিক চারবছর পর, নিজের সুরে রেকর্ড করেছিলেন বীরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের লেখা গান। তবে তখনও সঙ্গীত রসিকদের সঙ্গে অন্তরঙ্গতা গড়ে ওঠেনি। সেটা হয়েছিল অ্যাকাডেমির মঞ্চে ওঠার পরেই।

বেশকিছু সিনেমাতেও ব্যবহার করা হয়েছিল পীযূষকান্তির কন্ঠ। সাত সমুদ্র তেরো নদী পারের দেশেও আমন্ত্রিত হয়েছেন তিনি। বারেবারে গেছেন। বিশ্ব দরবারে শুনিয়ে এসছেন কবিগুরুর গান। বলেছেন তাঁর সৃষ্টি, বিশ্ব মানবিকতার বাণী। নিজেও কিছু রবীন্দ্রসঙ্গীতের ইংরেজি তর্জমা করেছিলেন পীযূষকান্তি। তর্জমার যথার্থতা প্রসঙ্গে শিল্পীর বক্তব্য ছিলো, 'কবিগুরুর মর্মবাণীর যতটুকু পারি, পৌঁছে দিতে চেষ্টা করেছি।'

তবে সঙ্গীত সফরের শুরুতেই বিশ্বভারতীর সঙ্গে যে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছিলেন শিল্পী, তা শেষ হয়েছিলো ২০০১ সালে শিল্পীর মৃত্যুতে। মাত্র কুড়িটা বছর, শিল্পী আর আমাদের মধ্যে নেই। আর এরমধ্যেই যেন আমরা ভুলে গেছি তাঁকে। শিল্পী বেঁচে থাকেন তাঁর শিল্পে। কিন্তু কোথায় সেই শিল্প? কোনও আসরে, মণ্ডপে তাঁর দরদী গলা আজ আর কানে আসে না। এরকমই হয় শিল্পীজীবন।
আজ বেঁচে থাকলে ৮৪বছর পূর্ণ করতেন দাপুটে শিল্পী পীযূষকান্তি সরকার।

(ঋণস্বীকার: এবং ঋতুপর্ণ)
চিত্র সৌজন্যঃ সংগৃহীত 

মন্তব্যসমূহ