রবিবাসরীয় সাহিত্যের দিন প্রতিদিন - সাহিত্যিক সন্দীপ চক্রবর্তীর অন্য ধারার গল্প গাঁথার ধারাবাহিক - " তুহু মম "

 রবিবাসরীয়   ধারাবাহিক 


 আধুনিক বাংলা সাহিত্যের নবীন লেখক সন্দীপ চক্রবর্তী । সন্দীপ লেখেন, নিজের অনুভুতি দিয়ে। সেখানে পাওয়া যাবে নিজেকে খুঁজে। বর্তমানে সন্দীপ একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের অন্যতম ।সন্দীপের  প্রতিটি অক্ষরের মাঝে লুকিয়ে থাকে সমাজের চালচিত্র। প্রতিদিন থাকছে  এই সমাজের কথকতা। একেবারে নতুন এক আঙ্গিক। একেবারে অন্য রকম আখ্যান গাথা  

                 তুঁহু মম / ২৩     



সন্দীপ চক্রবর্তী

অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে একদিন চলে গেলাম লালবাজারে। যে অফিসারের সঙ্গে সেদিন আমার কথা হয়েছিল দুর্ভাগ্যবশত তার নাম আমি ভুলে গেছি। কিন্তু কী কথা হয়েছিল এখনও স্পষ্ট মনে আছে। ব্যাপারটা বেশ মজার। তাই তোমাকে বলার লোভ সামলাতে পারলাম না।
ভদ্রলোক মন দিয়ে কাজ করছিলেন। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরেও ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে না পেরে বাধ্য হয়ে বললাম, 'স্যার একটু শুনবেন?'
জাবদা খাতাটি থেকে চোখ এবং মন কিছুই না সরিয়ে তিনি বললেন, 'বলে ফেলুন।'
'শহিদ মিনারের ভেতরে যাওয়ার পারমিশনের জন্য এসেছি।'
'তা বেশ তো। একা যাবেন নাকি সঙ্গে আর কেউ যাবে?'
সমস্যায় পড়লাম। রুরুর কী পরিচয় দেব! অন্য কেউ হলে অসুবিধে ছিল না। কিন্তু যার কাছে এসেছি একে তিনি পুলিশ অফিসার তাতে রীতিমতো রাশভারী চেহারা। গলাটিও বাজখাঁই। যা বলব তার যদি উলটো মানে করেন। ইতস্তত করে বললাম, 'মানে আমি আর আমার ফিয়সেঁ --দুজনে যাব।'
ভদ্রলোক এবার খাতা থেকে চোখ সরিয়ে আমার আপাদমস্তক দেখে বললেন,' বাঙালি তো?'
আমি অবাক হয়ে বললাম, 'হ্যাঁ। কেন বলুন তো?'
'বাঙালির ছেলে তো বান্ধবীকে ফিয়সেঁ বলে না। তাই জানতে ইচ্ছে হল। তা, কী উদ্দেশ্যে যাবেন?'
'এমনি। বেড়াতে। এ ছাড়া আর কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে?'
'অনেক কিছুই থাকতে পারে ভাই। আপনার বয়েস কম তাই জানেন না। তা, আত্মহত্যা-টত্যা করার প্ল্যান নেই তো?'
'অ্যাঁ--'
'মানে আপনি ফিয়সেঁকে নিয়ে আত্মহত্যা করার জন্য শহিদ মিনারে যাচ্ছেন না তো? গত বছরে এরকম একটা ঘটনা ঘটেছিল। তাই ওপর থেকে অর্ডার এসেছে সব কথা খুঁটিয়ে না জেনে পারমিশন দেওয়া যাবে না।'
'না না আমাদের সেরকম কোনও প্ল্যান নেই।'
'একটা ফর্ম দিচ্ছি। ভালো করে পড়ে ফিল আপ করে দিন।'
ফর্ম ফিল আপ করে দিলাম। ভদ্রলোক একবার চোখ বুলিয়ে রীতিমতো সম্ভ্রমের সঙ্গে বললেন, 'আপনি আর্কিওলজিস্ট!'
'হ্যাঁ।'
'ছি ছি। আপনার মতো ট্যালেন্টেড একজন মানুষকে এতক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখাটা খুবই অন্যায় হয়েছে। যাই হোক, প্রায়শ্চিত্ত-স্বরূপ কিছু একটা করতে দিতেই হবে।'
ভদ্রলোকের কথা বলার ধরণটাই এমন যে না হেসে পারা যায় না। হেসে জিজ্ঞাসা করলাম, 'কী করতে চান?'
'এক কাপ চা অন্তত খেতেই হবে।'
রাজি হয়ে গেলাম। চা খেতে খেতে অনেকক্ষণ গল্প হল। ফিরে আসার সময় ভদ্রলোক আমার আর রুরুর নামে দুটো পাশ দিয়ে বললেন, 'একটা অনুরোধ আছে, করব?'
'বলুন না।'
'একটু-আধটু ফরাসি আমি জানি। পুলিশ হবার আগে গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশনে গিয়ে শিখেছিলাম। ফিয়সেঁ অতি চমৎকার শব্দ। কিন্তু আমরা বাঙালি তো-- ভাবী স্ত্রী বললে শুনতে আরও ভালো লাগে। জ্ঞান দিচ্ছি ভাববেন না যেন--'
'আপনি আমার চোখ খুলে দিলেন। এবার থেকে ভাবী স্ত্রীই বলব। আর ভুল হবে না।'
সেদিন ভদ্রলোক আমাকে লালবাজারের গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছিলেন। একজন অচেনা অপরিচিত মানুষের কাছে এতটা সহৃদয় ব্যবহার সত্যিই আশা করিনি। বাংলা ভাষার প্রতি ওর মমত্ববোধ আমাকে চমৎকৃত করেছিল। এই ঘটনার অনেক দিন পরে শুধু ওর সঙ্গে দেখা করার আশায় একদিন গিয়েছিলাম লালবাজারে। কিন্তু ততদিনে তিনি বদলি হয়ে গিয়েছেন। ওর সঙ্গে আর আমার দেখা হয়নি।
তারপর শহিদ মিনার পর্ব। আমি ক্যামেরা নিয়ে গিয়েছিলাম। ইচ্ছে ছিল ওপর থেকে দেখা কলকাতার ছবি তুলব। কিন্তু আমার কাঁধে ক্যামেরার ব্যাগ দেখে বয়স্ক কেয়ারটেকারটি বেঁকে বসলেন, 'উঁহু ক্যামেরা নিয়ে ওপরে ওঠা যাবে না। নিয়ম নেই।' অগত্যা ক্যামেরার ব্যাগ ওর জিম্মায় রেখে যেতে হল।
শহিদ মিনারকে বাইরে থেকে যতটা রোমান্টিক লাগে ভেতরটা একেবারেই তার উলটো। আলো প্রায় নেই বললেই চলে। ঘুলঘুলি দিয়ে যেটুকু আলো এসে পড়ে সেটুকুই ভরসা। সিঁড়ির ধাপও এবড়োখেবড়ো। আমরা আন্দাজে আন্দাজে ওপরে উঠতে শুরু করলাম। রুরুর কোনও অসুবিধে হচ্ছিল না। কিন্তু আমার অবস্থা খুবই খারাপ। বারতিনেক হোঁচট খেয়েছি। ডানপায়ের বুড়ো আঙুলের নখ ফেটে রক্ত পড়ছে। মারাত্মক ব্যথা। হাঁটতে পারছি না। টপ ফ্লোরে পৌঁছবার কিছুটা আগে বললাম, 'একটু বসতে হবে রুরু। বেশি না, পাঁচ মিনিট। তারপর আবার যাব।'
রুরু বলল, 'হাঁপিয়ে গেছ? সিগারেট খেতে কেন বারণ করি এবার বুঝতে পারছ তো?'
পায়ের কথা বললে রুরু ব্যস্ত হয়ে উঠতে পারে। এমনকী, টপ ফ্লোরে যাবার প্ল্যান বাতিল করে নীচে নামার জন্যেও জিদ করতে পারে। ওর আনন্দ মাটি করতে মন চাইল না। তাই শুধু হাসলাম। অর্থাৎ মেনে নিলাম, হ্যাঁ, হাঁপিয়েই গেছি।
কয়েকটা মুহূর্ত নিঃশব্দেই কেটে গেল। মাটি থেকে অনেকটাই ওপরে আকাশের কাছাকাছি এরকম আলোআঁধারি পরিবেশে আমার বেশ ভালো লাগছিল। মনে হচ্ছিল আমরা অ্যাবানডানড। মানব সভ্যতা থেকে অনেক দূরে আমরা কোনও এক প্রাচীন প্রাগৈতাহাসিক পৃথিবীতে চলে এসেছি। আমি একজন প্রস্তরযুগীয় পুরুষ আর রুরু আমার রমণী। এখন যদি রুরুকে আমি আদর করি তা হলে আমাদের আশ্লেষ সময়ের শাসনকে উপেক্ষা করে এই গ্যালাক্সির বাইরে অনেক দূরে কোথাও পৌঁছে যাবে।
হঠাৎ রুরু বলল, 'রাজহংসিনীরা কাল থেকে খুব কাতর হয়ে আছে।'
'তাই! কই দেখি।' বলে যেই আমি রুরুর দিকে হাত বাড়িয়েছি, ঠিক সেইসময় নীচে কারোর পায়ের শব্দ শোনা গেল। কিছুক্ষণ পর বয়স্ক কেয়ারটেকারটি উঠে এলেন এবং আমাদের দেখে আঁতকে উঠে বললেন, 'এ কী! আপনারা এখানে বসে আছেন কেন?'
আমি কিছু বলার আগেই রুরু বলল, 'আসলে ও হাঁপিয়ে গিয়েছিল। তাই একটু রেস্ট নিচ্ছি।'
'অ। আপনারা ইয়াং। এমন কিছু করবেন না যাতে আমাকে আবার বড়ো সাহেবের কাছে জবাবদিহি করতে হয়।'



কেয়ারটেকার মশাই চলে গেলেন। আমরা খুব হাসলাম। তারপর আবার সিঁড়ি ভাঙা। টপ ফ্লোরে পৌঁছবার পর রুরু খুশিতে পাগল হয়ে গেল। আমার বুকেও জলপ্রপাতের শব্দ। এতবড়ো আকাশ আমরা কখনও দেখিনি। অনেক নীচে কলকাতা খুব ছোট। লিলিপুটের শহর। রুরু আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, 'থ্যাঙ্কস অর্জুন। তুমি আমার অনেক দিনের একটা ইচ্ছে পূরণ করলে।'
ঠাট্টা করে বললাম, 'তুমি তো বিজনেসম্যানের মেয়ে। তোমার এরকম মধ্যবিত্ত ইচ্ছে হল কী করে?'
'বোধহয় তোমার সঙ্গে একদিন দেখা হবে বলে এইসব ইচ্ছে পুষে রেখেছি।'
প্রায় শূন্যে দাঁড়িয়ে রুরুকে চুমু খেলাম। ওর শার্টের বোতাম খুলে আমার প্রিয় রাজহংসিনীদের আদর করলাম। তীব্র সুখে ডুবে যেতে যেতে রুরু বলল, 'প্লিজ ডোন্ট ব্রেক দা গ্লাস। দেয়ার ইজ নো বেড।'
বুকের ভেতর জলপ্রপাতের শব্দ ক্রমশ বাড়ছিল। বললাম, 'বাট দেয়ার ইজ আ স্কাই। লেট আস ফ্লাই ব্যাক টু দ্যাট এনসেইন্ট ওয়ার্ল্ড। যেখান থেকে মানুষ একদিন তার জার্নি শুরু করেছিল। যাবে রুরু?'
'যাব। কিন্তু সেই পৃথিবী কত দূরে?'
'কাছেই। চোখ বন্ধ করো, দেখতে পাবে।'

(ক্রমশ)

চিত্র সৌজন্যঃ সংগৃহীত 


মন্তব্যসমূহ