রবিবাসরীয় বেহালার দিন প্রতিদিন বিশেষ - সাংবাদিক কাজল ভট্টাচার্যের কলমে এক ভাস্করের জীবনের লুকিয়ে থাকা ইতিহাস - ' বিস্মৃতির অতলে বিসর্জন বুগীর, জি পালের জলজ্যান্ত দূর্গা '
বিশেষ কলম
বিস্মৃতির অতলে বিসর্জন বুগীর, জি পালের জলজ্যান্ত দূর্গা
- কাজল ভট্টাচার্য
(যে কোনও সৃষ্টির নেপথ্যে লুকিয়ে থাকে একটি মুখ। সেই মুখই সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির উৎসমুখ। সৃষ্টি বেঁচে থাকে। সৃষ্টির মধ্যেই বেঁচে থাকেন সৃষ্টিকর্তাও। হারিয়ে যায় সৃষ্টির আড়ালে থাকা সেই মুখ। বাংলার প্রবাদপ্রতিম মৃৎশিল্পী গোপেশ্বর পালের শিল্পসম্ভারের ঔজ্জ্বল্যে হারিয়ে যাওয়া সেরকমই এক মুখের ইতিকথা ।)
ছোট্ট এক মেয়ে।
দুগ্গাঠাকুর সেজে ঠায় দাঁড়িয়ে। অসুরবধে মনোযোগ। চোখ পাকিয়ে যতটা সম্ভব মহিষাসুরমর্দিনী হয়ে ওঠার আপ্রাণ চেষ্টা। মেয়ে ওইটুকু হলে হবে কী? বেশ এলেম আছে। আর থাকবে নাই বা কেন! রক্তের মধ্যেই তো সুপ্ত অবস্থায় ছিলো শিল্প। তারওপর পৃথিবীতে আগমণের পরেই চোখ মেলে দেখেছিল দূর্গা, কালী, মৃৎশিল্পের অপরূপ শিল্পসম্ভার।
কয়েক হাত দূরে বসে এক ওস্তাদ আঁকিয়ে। খসখস করে কাগজে স্কেচ করে চলেছেন। পেন্সিলের টানে ফুটে উঠছে মাতৃমূর্তি। মা দূর্গা থাকবে, আর অসুর থাকবে না তাও কি হয়। কেমন যেন নেপালি অসুর! চোখমুখ পাকিয়ে একরত্তি মা দূর্গাকে বলছে- যুদ্ধং দেহী! তবে সবচেয়ে মজার পশুরাজ। একটা পুরনো কাঠের বেঞ্চ।
- 'অসুরের দিকে একবার তাকা তো বুগী।' শিল্পীর আদেশ। এতক্ষণে বোঝা গেলো ওই ছোট্ট মা দূর্গার নাম 'বুগী'। আর যিনি এতক্ষণ মোটামুটি ঝড়ের গতিতে স্টাডি করে চলেছিলেন তিনি বুগীর বাবা। নাম, গোপেশ্বর পাল। বাংলার প্রবাদপ্রতিম মৃৎশিল্পী। এক যুগ প্রবর্তক। প্রতিবাদী মানুষ। সবসময় কাল, প্রথা ডিঙিয়ে নতুনকিছু গড়ার স্বপ্নে বিভোর।
বাবার আদরের বুগীর একটা পোশাকি গালভরা নামও ছিলো- কল্যাণী। আত্মজার মধ্যেই দেবী দূর্গাকে দর্শন করতে চেয়েছিলেন পিতা।
আজ সময়চক্রে, সেদিনের সেই একরত্তি দেবী দূর্গার সূত্র ধরেই গোপেশ্বর পাল ঘরানার বেঁচে থাকা।
দুই সন্তান সিদ্ধেশ্বর, কল্যাণী আর স্ত্রী প্রভা দেবীকে নিয়ে বাগবাজারের ৬ নাম্বার কাশী মিত্র ঘাট স্ট্রিটেই ছিলো বাংলার গর্বের মৃৎশিল্পী গোপেশ্বর পালের ছোট্ট সংসার।
মায়ের মধ্যে মানবীরূপ আবিষ্কার করেছিলেন শিল্পী গোপেশ্বর পাল। গভীর অনুভূতির সেই ছোঁয়া লেগেছিলো দেবীমূর্তির গড়নে। স্টুডিয়ো আলো করে দেখা গেছিলো জলজ্যান্ত মহিলার চিন্ময়ীমূর্তি। কুমোরটুলির সেই স্টুডিয়োতে সেদিন ঘটে গেছিলো এক নিঃশব্দ শিল্পবিপ্লব। দেবী মানবী একাকার।
একী অনাসৃষ্টি কাণ্ড!
গোপেশ্বরের এহেন কাণ্ড দেখে কপালের ভাঁজ চওড়া হয়েছিলো ধর্মের মহাজনদের। মানবীর মুখ, অবিকল রক্তমাংসের শরীরীভঙ্গিমার দেবীমূর্তিকে পূজা উপাচার নিবেদন করতে অস্বীকার করলেন ব্রাহ্মণকূল। তাঁরা বিস্মৃত হয়েছিলেন কবি বড়ু চণ্ডীদাসের সেই অমরবাণী।
'সবার ওপরে মানুষ সত্য
তাহার ওপরে নাই।'
কবির সেই বাণীই সেদিন মূর্ত হয়ে উঠেছিল শিল্পীর হাতের ছোঁয়ায়। সেই সঙ্গে নিঃশব্দে সূচনা হয়েছিলো দেবীমূর্তি গড়ার এক নতুন যুগের।
এমন হাজারো স্মৃতিজড়ানো গোপেশ্বর পাল, সিদ্ধেশ্বর পালের সেই স্টুডিয়ো অবশেষে হেরিটেজের মুকুট পরলো মাথায়। আজ যখন থিম পূজার ধূম দেখি মনে পড়ে যায় সেই পট পরিবর্তনের কথা। কতোই না এক্সপেরিমেন্ট দেবীমূর্তিকে নিয়ে। তাঁর রূপবন্দনায়। তবে আদি সেই রূপবন্দনার সঙ্গে আজকের এক্সপেরিমেন্টের এক সূক্ষ্ম ফারাক আছে বৈকি।
সেদিন দেবীমূর্তির নতুন রূপ উঠে এসেছিল শিল্পী গোপেশ্বর পালের এক গভীর জীবনদর্শন থেকে। আর আজ যা হয়ে চলেছে তাতে জীবনদর্শনের ছিটেফোঁটা নেই। যা আছে তা হলো, শিল্পীমনের শিল্পদক্ষতায় ভর করে উৎকৃষ্ট দেবীমূর্তি তৈরি। যার সূচনা করে গেছিলেন গোপেশ্বর পাল। পরে সিদ্ধেশ্বর পালের হাত ধরে তা সর্বজনীন হয়। জি পালের হাতেগড়া সেই স্টুডিয়ো, যাবতীয় শিল্পকর্ম হেরিটেজের মর্যাদা পাওয়ার ঘটনা মনে করিয়ে দেয় কবিগুরুর সেই রচনা- 'তোমার সৃষ্টির চেয়ে তুমি যে মহৎ..!'
কিন্তু সেই সৃষ্টির উৎসমুখ উপেক্ষিত থেকে গেলো। বিস্মৃতির অতলে চলে গেলো সেই মুখ, যাকে দেখে দেবীমূর্তির মানবীরূপ গড়েছিলেন শিল্পী গোপেশ্বর পাল। শিল্পীপুত্র সিদ্ধেশ্বর পালের কথা বিক্ষিপ্তভাবে উঠে এলেও, কন্যা কল্যাণীর কথা বিস্মৃত হলো বাংলা।
আত্মজার মধ্যেই দেবীদর্শন করেছিলেন গোপেশ্বর পাল। যে মানবতাবাদ, লিঙ্গ বৈষম্যের প্রতিবাদে আজ এতো গলা ফাটান বিদ্বজ্জনেরা, বহুযুগ আগেই তা মূর্ত হয়ে উঠেছিল বাগবাজারের ৪০/এ, কাশীমিত্র ঘাট স্ট্রিটের সেই স্টুডিয়োতে।
বড়ো আদরের মেয়ে ছিলো বুগী। তার জন্ম গোপেশ্বরবাবুর বিলেত থেকে ফেরার পর। বছর চার- পাঁচের ছোট দাদা সিদ্ধেশ্বরের চেয়ে। কাজকর্মের চাপ না থাকলেই মেয়ের হাত ধরে গঙ্গার ফুরফুরে বায়ুসেবন করতে বেরোতেন বাবা। শৌখিন শিল্পীমানুষ গোপেশ্বর পাল। তিনি কী আর সাদামাটা ভাবে বেরোন?
মেয়ে সাজতো, বাবাও সাজতো। গোপেশ্বরবাবুর গোঁফের বাহার ছিলো বেশ নজরকাড়া। তারওপর সেই গোঁফজোড়ায় চড়তো মোম পালিশ। বাহারি গোঁফ মুচড়ে, মেয়ের হাত ধরে ঘুরতে বেরোতেন শিল্পী। সঙ্গে থাকতো বাড়ির নেপালি দারোয়ান। আবার কখনও শখ হলে গাড়ি হাঁকিয়ে আদরের মেয়েকে নিয়ে চলে যেতেন সাহেব পাড়ার সাবেক হগ মার্কেটে। শুরু হতো বাবা মেয়ের পছন্দের জিনিসপত্র কেনাকাটা।
বাবার আদরের বুগী শুধু যে বাবার পছন্দের মডেল ছিলো তাই না, তার গানের গলাও ছিলো ভারী মিষ্টি। বেশ সুরে বাজতো। সেসময়ের হিট গানগুলি গুনগুন করলেও, কিশোরী বুগীর ঝোঁক ছিলো ভক্তিমূলক গানের দিকে।
এহেন গোপেশ্বর পালকে একসময় বয়কট করেছিল তাঁর আত্মীয় পরিজনরা। দোষটা কী? সাতসাগরের পারে বিলেত গিয়ে জাত খুইয়েছিলেন শিল্পী। 'প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে!' ফতোয়া জারি করেছিলেন সবাই। আত্মীয়স্বজনের সেই ফতোয়া দারুণ ক্ষত তৈরি করেছিল গোপেশ্বরবাবুর সংবেদনশীল মনে। নিঃশব্দে প্রতিবাদ করেছিলেন তিনি সেই বিকারগ্রস্ত সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে। যে শিল্পী মানুষের মধ্যে দেবদর্শন করেন, তিনি এবারেও এক বিপ্লবী পদক্ষেপ করলেন। নির্দ্বধায় ঘুচিয়ে দিলেন মানুষে মানুষের ভেদাভেদের এই লক্ষণরেখা।
কৃষ্ণনগরের ঘূর্ণির এক ওস্তাদ নামজাদা মৃৎশিল্পী পরিবারে জন্ম গোপেশ্বর পালের। সেই পরিবারের রীত- রেওয়াজের বিরুদ্ধে এক চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে বসলেন উদারমনা শিল্পী। আদরের একমাত্র মেয়ে কল্যাণীর বিয়ে দিলেন ওপার বাংলার, ঢাকার এক পাত্রের সঙ্গে।
কেন? কারণ বিলেতফেরত হওয়ার অপরাধে এপার বাংলার আত্মীয়জনরা যখন তাঁকে ব্রাত্য ঘোষণা করেছেন, ঠিক তখনই ওপার বাংলার কুম্ভকার সম্প্রদায় গোপেশ্বর পালকে সম্বর্ধনা দিয়ে তাঁকে বরণ করে নিয়েছিলেন।
দীর্ঘায়ু ছিলেন না গোপেশ্বর পাল। সন্ন্যাসরোগে ভুগছিলেন তিনি। অবশেষে, মাত্র বাহান্ন বছর বয়সেই স্তব্ধ হয়ে যায় তাঁর শিল্পযাত্রা। দিনটা ছিলো ১৯৪৪ সালের ৯ জানুয়ারি।
গোপেশ্বরবাবুর সেই ঘরানা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব চাপে তাঁর একমাত্র পুত্র সিদ্ধেশ্বর পালের ঘাড়ে। এছাড়াও ছিলেন আর একজনা। রক্তের সম্পর্কে তিনি গোপেশ্বরবাবুর ভ্রাতুষ্পুত্র- মণি পাল। জি পাল ঘরানার ঐতিহ্য তিনিও সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যান।
সিদ্ধেশ্বরবাবুর চেয়ে কমবেশি বছর দশেকের বড়ো ছিলেন অগ্রজ মণি পাল। ভাইপোকে নিজের বিদ্যা উজাড় করে দিয়েছিলেন কাকা গোপেশ্বর পাল। বয়স যখন ৫৯, মারা গেলেন তিনি। দিনটা ছিলো ১৯৬৮ সালের ৮ অক্টোবর।
মণি পাল নিঃসন্তান হওয়ায় এবার একা হয়ে গেলেন সিদ্ধেশ্বর পাল। উত্তরাধিকার সূত্রে, জি পাল পরম্পরার ব্যাটন নিয়ে দৌড়নোর দায়িত্ব চেপে বসলো তাঁর ঘাড়ে। কথায় বলে, বাপকা বেটা সিপাহি কা ঘোড়া! শিল্পের সেই ঘোড়দৌড়ের প্রথম দিকটায় খানিকটা দিশাহারা হয়ে পড়লেও, তা কাটতে সময় লাগলো না। হাত তো তৈরি ছিলোই, মনও ধীরে ধীরে তৈরি হয়ে গেলো।
বাবার হাতেগড়া শিল্পধারার মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখলেও, দেবীপ্রতিমা গড়ার দিকে যাননি সিদ্ধেশ্বর পাল। ভাস্কর্যের দুনিয়ার মগ্ন শিল্পী হিসাবেই নিজের পরিচয় গড়ে তোলেন তিনি। হরিদ্বারের কোঙ্খল থেকে নিয়ে রামকৃষ্ণ মিসনের বহু জায়গায় ছড়ানো রয়েছে তার শিল্প নিদর্শন। শিকাগো, মরিশাসের মতো বিদেশেও তাঁর হাতেগড়া ভাস্কর্য জায়গা করে নিয়েছে। সিদ্ধেশ্বর পাল প্রয়াত হওয়ার পরেই জি পাল ঘরানা মুখোমুখী হয় আর এক ছন্দপতনের।
সিদ্ধেশ্বরবাবুর সন্তান না থাকায় আচমকাই যে শূন্যতা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা গেছিলো তা পূরণ করার উত্তরসূরী বলতে ছিলেন একজনই- আশিস পাল। গোপেশ্বর পালের আদরের কন্যা সেই ছোট্ট বুগী, কল্যাণীদেবীর কনিষ্ঠ সন্তান আশিস।
বাবা, দাদার মতো কল্যাণীদেবী হাতে সরাসরি মাটি তুলে নেননি, কোনও রেকর্ডেও তাঁর গান ধরে রাখা হয়নি, তবু তাঁর অনুভূতিপ্রবণ শিল্পীমন নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনও অবকাশ ছিলো না। মায়ের সেই শিল্পসত্তাই প্রকাশ পেয়েছিল তাঁর কনিষ্ঠ সন্তান আশিসের মধ্যে। ছেলের কাছে ক্যাসেটে ধরা আছে মায়ের সেই গান।
'মামার কাছেই হাতেখড়ি,' বলেন আশিস। 'কিছু কাজ করতে বসলেই হলো, মামার মুখে দাদুর কথা লেগেই থাকতো। বাবা এরকম করতেন! বাবা ওরকম বলতেন।'
দাদুকে না পেলেও মামার মধ্যেই যেন দাদুকে খুঁজে পেতেন আশিস। কাজের সময় শিল্পীমামার সহকারী ভাগ্নে। অন্যসময় মামাভাগ্নের সখ্যতা ছিলো চোখে পড়ার মতো।
'রাইটার্স বিল্ডিংয়ে মন্ত্রীর চেম্বারে হোক অথবা মেদিনীপুরের প্রত্যন্ত গ্রামে মূর্তির গায়ে রং চাপানোর কাজ, সবজায়গায় আমিই ছিলাম মামার সঙ্গী,' বলেন আশিস।
বাবা গোপেশ্বর পালের মতোই রসিক মানুষ ছিলেন সিদ্ধেশ্বর পালও। মজার ঘটনাও ঘটতো আকছার। এরকমই এক মজার ঘটনা আজও ভুলতে পারেননি আশিস। সেবার মামাভাগ্নে গেছিলো দিঘার কাছাকাছি সাউরি গ্রামে। সেখানে যাওয়ার উদ্দেশ্য, দাদু গোপেশ্বর পালের গড়া এক মূর্তিতে রং চাপানো।
- 'কাজটাজ সেরে আমরা দুজনে বেরোলাম সমুদ্রদর্শনে। জীবনের প্রথম সমুদ্রদর্শন। দারুণ উত্তেজিত। যতদূর চোখ যায় জল শুধু জল। হঠাত জিজ্ঞেস করে বসলাম- সমুদ্রের ওপারের জায়গাটার নাম কী?
একটুও না ভেবে মামার উত্তর- এই যাহ, ম্যাপটা আনতে ভুলে গেছি তো!'
তবে তারচেয়েও মজার ব্যাপার ছিলো সিদ্ধেশ্বরবাবুর দাড়ি কাটা। অন্ধকার চেপে বসা সমুদ্রের পাড়ে নরসুন্দরের কাছে গাল পেতে দেওয়া। ভাগ্নে আশিস টর্চ ধরে দাঁড়িয়ে। সেই টর্চের আলোতে নরসুন্দর নিজের কাজ করে চলেছেন। সমুদ্রের পারে ফুরফুরে হাওয়া গায়ে লাগিয়ে ডাকাবুকো ভাস্কর্যশিল্পীর দাড়ি কাটা।
এরকম বহু ঘটনার কথা ধরা আছে ভাস্কর আশিস পালের ডায়েরির পাতায় পাতায়। পরে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাস্কর্য নিয়ে পড়াশোনা করে মামা সিদ্ধেশ্বর পালের যোগ্য সহকারী হয়ে ওঠেন আশিস। দাদু, মামার পরম্পরা আজও সযত্নে বাঁচিয়ে রেখেছেন ভাস্কর আশিস পাল।
তবু কথার ফাঁকে কোথাও যেন ভর করে থাকে হতাশা। একদিন যেমন তাঁর নিজের সমাজেই ব্রাত্য হয়ে গেছিলেন গোপেশ্বরবাবু, আজ ঠিক একই অবস্থার শিকার আশিস। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। জি পাল পরম্পরার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন তাঁর দৌহিত্র ভাস্কর আশিস পাল।
বাংলা তার মৃৎশিল্পের গর্ব গোপেশ্বর পালকে মনে রাখলেও ভুলে গেছে, শিল্পীর সেই জলজ্যান্ত দূর্গা বুগীকে। সেই অভিমান বুকে নিয়েই, বুগীও সেই কবেই ফিরে গেছেন তাঁর সৃষ্টিকর্তার কাছে। ২০১৪ সালের ২৫ জুলাই প্রয়াত হন বুগী ওরফে কল্যাণীদেবী। আদরের ছেলে, মেয়ে, ভাইপোকে ফিরে পেয়ে সবার অলক্ষ্যে, ইন্দ্রলোকে আরেক স্বর্গীয় সৃষ্টির উৎসবে মেতেছেন গোপেশ্বরবাবু।
বাবার হাতেগড়া শিল্পধারার মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখলেও, দেবীপ্রতিমা গড়ার দিকে যাননি সিদ্ধেশ্বর পাল। ভাস্কর্যের দুনিয়ার মগ্ন শিল্পী হিসাবেই নিজের পরিচয় গড়ে তোলেন তিনি। হরিদ্বারের কোঙ্খল থেকে নিয়ে রামকৃষ্ণ মিসনের বহু জায়গায় ছড়ানো রয়েছে তার শিল্প নিদর্শন। শিকাগো, মরিশাসের মতো বিদেশেও তাঁর হাতেগড়া ভাস্কর্য জায়গা করে নিয়েছে। সিদ্ধেশ্বর পাল প্রয়াত হওয়ার পরেই জি পাল ঘরানা মুখোমুখী হয় আর এক ছন্দপতনের।
সিদ্ধেশ্বরবাবুর সন্তান না থাকায় আচমকাই যে শূন্যতা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা গেছিলো তা পূরণ করার উত্তরসূরী বলতে ছিলেন একজনই- আশিস পাল। গোপেশ্বর পালের আদরের কন্যা সেই ছোট্ট বুগী, কল্যাণীদেবীর কনিষ্ঠ সন্তান আশিস।
বাবা, দাদার মতো কল্যাণীদেবী হাতে সরাসরি মাটি তুলে নেননি, কোনও রেকর্ডেও তাঁর গান ধরে রাখা হয়নি, তবু তাঁর অনুভূতিপ্রবণ শিল্পীমন নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনও অবকাশ ছিলো না। মায়ের সেই শিল্পসত্তাই প্রকাশ পেয়েছিল তাঁর কনিষ্ঠ সন্তান আশিসের মধ্যে। ছেলের কাছে ক্যাসেটে ধরা আছে মায়ের সেই গান।
'মামার কাছেই হাতেখড়ি,' বলেন আশিস। 'কিছু কাজ করতে বসলেই হলো, মামার মুখে দাদুর কথা লেগেই থাকতো। বাবা এরকম করতেন! বাবা ওরকম বলতেন।'
দাদুকে না পেলেও মামার মধ্যেই যেন দাদুকে খুঁজে পেতেন আশিস। কাজের সময় শিল্পীমামার সহকারী ভাগ্নে। অন্যসময় মামাভাগ্নের সখ্যতা ছিলো চোখে পড়ার মতো।
'রাইটার্স বিল্ডিংয়ে মন্ত্রীর চেম্বারে হোক অথবা মেদিনীপুরের প্রত্যন্ত গ্রামে মূর্তির গায়ে রং চাপানোর কাজ, সবজায়গায় আমিই ছিলাম মামার সঙ্গী,' বলেন আশিস।
বাবা গোপেশ্বর পালের মতোই রসিক মানুষ ছিলেন সিদ্ধেশ্বর পালও। মজার ঘটনাও ঘটতো আকছার। এরকমই এক মজার ঘটনা আজও ভুলতে পারেননি আশিস। সেবার মামাভাগ্নে গেছিলো দিঘার কাছাকাছি সাউরি গ্রামে। সেখানে যাওয়ার উদ্দেশ্য, দাদু গোপেশ্বর পালের গড়া এক মূর্তিতে রং চাপানো।
- 'কাজটাজ সেরে আমরা দুজনে বেরোলাম সমুদ্রদর্শনে। জীবনের প্রথম সমুদ্রদর্শন। দারুণ উত্তেজিত। যতদূর চোখ যায় জল শুধু জল। হঠাত জিজ্ঞেস করে বসলাম- সমুদ্রের ওপারের জায়গাটার নাম কী?
একটুও না ভেবে মামার উত্তর- এই যাহ, ম্যাপটা আনতে ভুলে গেছি তো!'
তবে তারচেয়েও মজার ব্যাপার ছিলো সিদ্ধেশ্বরবাবুর দাড়ি কাটা। অন্ধকার চেপে বসা সমুদ্রের পাড়ে নরসুন্দরের কাছে গাল পেতে দেওয়া। ভাগ্নে আশিস টর্চ ধরে দাঁড়িয়ে। সেই টর্চের আলোতে নরসুন্দর নিজের কাজ করে চলেছেন। সমুদ্রের পারে ফুরফুরে হাওয়া গায়ে লাগিয়ে ডাকাবুকো ভাস্কর্যশিল্পীর দাড়ি কাটা।
এরকম বহু ঘটনার কথা ধরা আছে ভাস্কর আশিস পালের ডায়েরির পাতায় পাতায়। পরে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাস্কর্য নিয়ে পড়াশোনা করে মামা সিদ্ধেশ্বর পালের যোগ্য সহকারী হয়ে ওঠেন আশিস। দাদু, মামার পরম্পরা আজও সযত্নে বাঁচিয়ে রেখেছেন ভাস্কর আশিস পাল।
তবু কথার ফাঁকে কোথাও যেন ভর করে থাকে হতাশা। একদিন যেমন তাঁর নিজের সমাজেই ব্রাত্য হয়ে গেছিলেন গোপেশ্বরবাবু, আজ ঠিক একই অবস্থার শিকার আশিস। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। জি পাল পরম্পরার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন তাঁর দৌহিত্র ভাস্কর আশিস পাল।
বাংলা তার মৃৎশিল্পের গর্ব গোপেশ্বর পালকে মনে রাখলেও ভুলে গেছে, শিল্পীর সেই জলজ্যান্ত দূর্গা বুগীকে। সেই অভিমান বুকে নিয়েই, বুগীও সেই কবেই ফিরে গেছেন তাঁর সৃষ্টিকর্তার কাছে। ২০১৪ সালের ২৫ জুলাই প্রয়াত হন বুগী ওরফে কল্যাণীদেবী। আদরের ছেলে, মেয়ে, ভাইপোকে ফিরে পেয়ে সবার অলক্ষ্যে, ইন্দ্রলোকে আরেক স্বর্গীয় সৃষ্টির উৎসবে মেতেছেন গোপেশ্বরবাবু।
(তথ্য ও ছবি সহযোগিতায় ভাস্কর আশিস পাল।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন