রবিবাসরীয় সাহিত্যের দিন প্রতিদিন - সাহিত্যিক সন্দীপ চক্রবর্তীর অন্য ধারার গল্প গাঁথার ধারাবাহিক - " তুহু মম "
রবিবাসরীয় ধারাবাহিক
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের নবীন লেখক সন্দীপ চক্রবর্তী । সন্দীপ লেখেন, নিজের অনুভুতি দিয়ে। সেখানে পাওয়া যাবে নিজেকে খুঁজে। বর্তমানে সন্দীপ একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের অন্যতম ।সন্দীপের প্রতিটি অক্ষরের মাঝে লুকিয়ে থাকে সমাজের চালচিত্র। প্রতিদিন থাকছে এই সমাজের কথকতা। একেবারে নতুন এক আঙ্গিক। একেবারে অন্য রকম আখ্যান গাথা
তুঁহু মম / ১৮
সন্দীপ চক্রবর্তী
আমার এমএ পড়ার দিনগুলো ছিল আশ্চর্য এক মাধুর্যে ভরা। একদিকে ভারতবর্ষের প্রাচীন ইতিহাসের বেলোয়ারি ঝাড়লণ্ঠনের আলোয় আলোকিত রাজপ্রাসাদের দরজা যেমন খুলছিল ঠিক তেমনই অন্যদিকে আমার ব্যক্তিগত জীবনে যে খুব তাড়াতাড়ি একটা পটপরিবর্তন হতে চলেছে, তারও স্পষ্ট ইঙ্গিত পাচ্ছিলাম। অবশ্যই রুরুর সৌজন্যে। কিন্তু শুধু প্রেম করলে তো আর ভালো রেজাল্ট করা যায় না। বিশেষ করে রুরু যেখানে সুযোগ পেলেই মনে করিয়ে দিচ্ছে, ' ওনলি আ ফার্স্ট ক্লাস ইজ নট এনাফ অর্জুন। তোমাকে সেরাদের মধ্যে সেরা হতে হবে।' সুতরাং বুঝতেই পারছ পড়াশোনার চাপ যথেষ্টই ছিল। ইউনিভার্সিটির অধ্যাপকেরাও আমাকে আশকারা দিতেন। দিন নেই, রাত নেই যখনই ঠেকায় পড়েছি, ওদের কাছে দৌড়ে গেছি। ওরাও আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ পেরিয়ে সারস্বত সমাজে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার উপযুক্ত করে তুলেছেন। ওরা না থাকলে আমি আজকের অর্জুন দাশগুপ্ত হতাম না কুমুদিনী। ওদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। কৃতজ্ঞ আমি রুরুর প্রতিও। ও না থাকলেও তো আমি এই উচ্চতায় পৌঁছতে পারতাম না।
নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি মেয়েরা রাজতিলক পরিয়ে দিলে পুরুষের ভাগ্য সোনা ফলাতে পারে। ভাগ্য আমি মানি কুমুদিনী। জীবনের যেসব উত্থান-পতন যুক্তি দিয়ে মেলানো যায় না তার পিছনে কোনও না কোনও শক্তি তো কাজ করেই। গায়ের জোরে সেই শক্তিকে অস্বীকার করলে গোঁজামিল দিয়েই জীবনের ব্যালান্স শিট মেলাতে হবে। তাতে আমার বিন্দুমাত্র আস্থা নেই।
পরীক্ষার্থী হিসেবে আমার ভাগ্য চিরকালই ভালো। এমএ পরীক্ষাতেও তার ব্যতিক্রম হল না। শেষপর্যন্ত ফার্স্ট ক্লাস পেয়েই গেলাম। শুধু তাই নয়, সেরাদের মধ্যে সেরা হবার বিড়ম্বনাও এসে জুটল। কিন্তু এবার কী করব? এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে মফস্বলের কোনও স্কুলে ইতিহাস পড়াব, নাকি, পার্টির কোনও কেষ্টবিষ্টুকে ধরে কলকাতার কাছেপিঠে কলেজগুলোয় চেষ্টা করব? বাবাকে চিঠি লিখলাম। বাবা লিখল, 'চাকরি করার কথা এখনই ভাববি না অজু। তুই গবেষণা করবি।' রুরুরও সেরকম ইচ্ছে। বলাবাহুল্য, চাকরি করতে আমিও চাইনি। তার দরকারও ছিল না। ছাত্র পড়িয়ে রোজগার মন্দ হচ্ছিল না। বাবাকেও মাসে মাসে কিছু টাকা পাঠাতাম। সুতরাং আমার জীবনের দু'জন গুরুত্বপূর্ণ মানুষের সংকেত পাওয়া মাত্র দৌড়লাম এএনএম অর্থাৎ অধ্যাপক অমরনাথ মুখোপাধ্যায়ের কাছে৷ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সব শিক্ষকই আমার প্রিয়। কিন্তু এএনএম, ওই যাকে বলে সেরাদের মধ্যে সেরা। এএনএম বললেন, 'তোমার মতো ছাত্র গবেষণা না করলে সেটা ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে ব্ল্যাক স্পট হিসেবে কনসিডার্ড হবে।' আমার ইচ্ছে ছিল ওর আনডারে গবেষণা করার। কিন্তু এএনএম বললেন, 'আমার বয়েস হয়েছে অর্জুন। কবে আছি কবে নেই কিছু কি বলা যায়? তোমার গাইড হবার জন্য অনিরুদ্ধ সেনই উপযুক্ত লোক। তুমি কালই ওর সঙ্গে দেখা করো।'
পরের দিনই দেখা করলাম। এএস সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন। আমার গবেষণাও শুরু হয়ে গেল। বিষয় কী ছিল জানো? সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতার প্রাচীন লিপির উৎস সন্ধান। একেবারে ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি দশা। কারণ সেইসময়ে হরপ্পান স্ক্রিপ্টের সোর্স নিয়ে কেউ মাথা ঘামাত না। ইতিহাসে পণ্ডিত এবং মূর্খ সবাই একযোগে বলত, ধুর ও তো সবাই জানে। দ্রাবিড়রা হরপ্পা আর মহেঞ্জোদারো নামে দুটো শহর বানিয়েছিল। সুতরাং প্রাচীন তামিল স্ক্রিপ্টই হরপ্পান স্ক্রিপ্টের সোর্স। কথাটা কোনওদিনই আমার যুক্তিসংগত বলে মনে হয়নি। এমএ পড়ার সময় যত এইসব কথা শুনতাম ততই আমার মন খচখচ করত। তখন নিজের মনের কথাটা বললে কেউ শুনত না। তাই কাউকে বলতেও পারতাম না। প্রথম বলেছিলাম এএনএম-কে, 'স্যার, এখনও পর্যন্ত প্রাচীনতম যে তামিল স্ক্রিপ্টের সন্ধান পাওয়া গেছে তার বয়েস দু'হাজার বছর আর হরপ্পান সিভিলাইজেশনের বয়েস প্রায় পাঁচ হাজার বছর। তা হলে হরপ্পান স্ক্রিপ্টের সোর্স কীভাবে প্রাচীন তামিলে থাকতে পারে? আমার মনে হয় ওটা আমাদের সংস্কৃততেই খুঁজতে হবে। ভেবে দেখুন স্যার, সংস্কার না হলে একটা ভাষার নাম সংস্কৃত হয় কী করে? অর্থাৎ সংস্কৃতের একটা প্রাচীনতম রূপ ছিল। প্রশ্ন উঠতে পারে ভাষার সংস্কার কে করেছিলেন? পাণিনি। সেইজন্যেই ভারতবর্ষের বহু টোল-চতুষ্পাঠীতে আজও পাণিনির ব্যাকরণ পড়ানো হয়।'
জানো কুমুদিনী, আমার ব্যাখ্যা শুনে স্যার আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন,'তুমি পারবে অর্জুন। গভরনমেন্ট স্পনসর্ড কিছু হিসটোরিয়ান আমাদের ইতিহাসের বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছে। রমেশচন্দ্র মজুমদার সারা ভারত ঘুরে যেসব তথ্য জোগাড় করেছিলেন তার কিছুই নেওয়া হয়নি। কারণ নেওয়া হলে ব্রিটিশরা আমাদের ইতিহাসের যে মডিউল তৈরি করে দিয়ে গিয়েছিল তার সবটাই মিথ্যে হয়ে যেত। তোমাকে আমাদের ইতিহাসের মিসিং লিংক খুঁজে বের করতে হবে অর্জুন। অ্যান্ড ইউ ক্যান ডু দ্যাট।'
স্যারকে সেদিন কথা দিয়েছিলাম। এবং সেই চেষ্টা আজও করে যাচ্ছি। সফল হয়েছি বলব না। তবে আশার আলো দেখা যাচ্ছে। একদিন হয়তো বলতে পারব, আমি পেরেছি।
কিন্তু এই নিয়ে আর একটি কথাও নয়। বুঝতে পারছি তুমি হাঁপিয়ে উঠেছ। সত্যি, তোমার ধৈর্যের যে পরীক্ষা আমি নিচ্ছি তা বোধহয় মানব সভ্যতার ইতিহাসে কেউ কোনওদিন নেয়নি।
আমার গবেষণা যখন মধ্যগগনে, রুরু একদিন বলল, 'গ্রেট নিউজ অর্জুন! মাই ড্যাড ওয়ান্টস টু সি ইউ অন স্যাটারডে। অর্থাৎ পরশু। ওইদিন আমাদের বাড়িতে তোমার চায়ের নিমন্ত্রণ।'
কয়েকদিন ধরেই রুরু বলছিল এবার ও আমার কথা ওর বাবাকে বলবে। বললাম, 'কবে বললে আমার কথা?'
'কাল।'
'কী বললে?'
'বললাম আই লাভ অর্জুন। হি ইজ দা ম্যান, আই ওয়ান্ট টু ম্যারি।'
আমার খুবই কৌতূহল হচ্ছিল। একটু একটু ভয়ও পাচ্ছিলাম। রুরুর বাবার নাম বিমলেন্দু ঘোষ বলেই ভয়। ওর অর্থ, আভিজাত্য আর কৌলিন্যের কাছে আমি এবং আমার বাবা কিছু নই। আমরা খুব সাধারণ। আমাকে এককথায় তিনি নাকচ করে দিতেই পারেন। কিন্তু নাকচ করে দেবার ইচ্ছে থাকলে বাড়িতে ডাকতেন কি? কী জানি! হয়তো বাড়িতে ডেকেই ওদের সঙ্গে আমাদের পার্থক্যটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবেন। এইসব কথাই আমার মনে হচ্ছিল। তাই কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, 'উনি কী বললেন?'
'বললেন, শনিবার ওকে আসতে বলো। আমি কথা বলব।'
বুঝলাম রুরুর বাবা নিজে আমায় পরখ করতে চান। মেয়ের ওপর ওর আস্থা নেই। টেনশন বেড়ে গেল। বললাম, 'যদি উনি আমায় রিজেক্ট করেন? মানে আমি তো তেমন---'
রুরু অবাক হয়ে বলল, 'মাই গড! তুমি কি এখনও আমায় চিনতে পারোনি? হোয়াট দা হেল উইল হ্যাপেন ইফ হি রিজেক্টস ইউ? অর্জুন তুমি যেদিন বলবে, যখন বলবে--আমি বেরিয়ে আসব। একবারও পিছন ফিরে দেখব না। ইউ আর মাই চয়েস। মাই ডিসিশন। আই অলওয়েজ রেসপেক্ট মাই ডিসিশনস।'
'বাবা-মাকে রিজেক্ট করবে রুরু?'
সেদিন আমরা পার্ক স্ট্রিটের মেট্রো স্টেশনে বসেছিলাম। ট্রেন আসছিল আর চলে যাচ্ছিল। আমাদের সেদিকে হুঁশ ছিল না। দুটি দলছুট কপোত-কপোতী ব্যস্ত স্টেশনের দূরতম প্রান্তে একটি ফোকর খুঁজে স্বপ্ন দেখছিল ভবিষ্যতের। আমার কাঁধে মাথাটা হেলিয়ে দিয়ে রুরু বলল, 'আমি এরকমই অর্জুন। নেভার লাইক টু লুক ব্যাক। সামনে এগিয়ে যাওয়ার সময় আমি পিছনের সুতোটা ছিঁড়ে ফেলতে ভালোবাসি। বিয়ের পর যদি কখনও মনে হয় তুমি আর আগের মতো আমায় ভালোবাসো না, কিংবা, আমার থেকে কেরিয়ার তোমার কাছে বেশি ইমপর্ট্যান্ট হয়ে গেছে, কিংবা ধরো, যেভাবে আমি বাঁচতে চাই তুমি আমাকে সেই স্পেস দিচ্ছ না--- তা হলে তোমাকেও একদিন রিজেক্ট করব। অর্জুন বিয়ের পরেও এমন বন্ধু হয়ে থেকো, আমার হাজব্যান্ড হবার চেষ্টা করো না।'
না কুমুদিনী, সেদিন রুরুর কথার মর্মান্তিক গভীরতা আমি বুঝতে পারিনি। একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। মনে হয়েছিল নতুন জীবনে প্রবেশ করার আগে বুঝি সব মেয়েই এই কথা বলে। মনে হয়েছিল খুব বেশি কিছু তো চাইছে না রুরু। সম্পর্কের মধ্যে স্পেস থাকাটা জরুরি। নয়তো আজ যা আমাদের প্রিয় কাল তা আমাদের গলাতেই ফাঁসের মতো চেপে বসবে। আমরা শ্বাস নেওয়ার জন্য বাতাস পাব না, চার দেওয়ালের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে আকাশে-আকাশে আমাদের মনের মুক্তি হবে না-- অচিরেই সম্পর্কটা হয়ে দাঁড়াবে কয়েকটা অভ্যেসের বন্ধন। না কুমুদিনী তা আমিও চাইনি। সেদিন তাই কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়েই বলেছিলাম, 'ভয় নেই রুরু। আমি চিরকাল তোমার বন্ধু হয়েই থাকব। তোমার হাজব্যান্ড হবার সাধ আমারও নেই।'
(ক্রমশ)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন