রবিবাসরীয় সাহিত্যের দিন প্রতিদিন - সাহিত্যিক সন্দীপ চক্রবর্তীর অন্য ধারার গল্প গাঁথার ধারাবাহিক - " তুহু মম "

 

রবিবাসরীয়   ধারাবাহিক 


 আধুনিক বাংলা সাহিত্যের নবীন লেখক সন্দীপ চক্রবর্তী । সন্দীপ লেখেন, নিজের অনুভুতি দিয়ে। সেখানে পাওয়া যাবে নিজেকে খুঁজে। বর্তমানে সন্দীপ একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের অন্যতম ।সন্দীপের  প্রতিটি অক্ষরের মাঝে লুকিয়ে থাকে সমাজের চালচিত্র। প্রতিদিন থাকছে  এই সমাজের কথকতা। একেবারে নতুন এক আঙ্গিক। একেবারে অন্য রকম আখ্যান গাথা  

                 তুঁহু মম / ১৮     


সন্দীপ চক্রবর্তী
বিমলেন্দু ঘোষের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎপর্ব ভালোভাবেই সম্পন্ন হল। পরে যতবার এই ঘটনাটা নিয়ে ভেবেছি, মনে হয়েছে আমি বোধহয় নেহাতই অকারণে ভদ্রলোককে খুব অহংকারী আর উন্নাসিক ধরে নিয়েছিলাম। আমার এই ধারণার কারণ অবশ্যই রুরুর প্রথমদিকের অ্যাটিটিউড। আর একটা কারণ আমার সেইসময়কার এক অদ্ভুত মানসিকতা। একে তুমি ইগোও বলতে পারো। আমার মনে হত রুরুর পরিবর্তনের জন্য আমি দায়ী। বিমলেন্দু আঙ্কলের জীবনে তো কোনও অর্জুন দাশগুপ্ত নেই, তাই তিনি নিশ্চয়ই প্রথম দিকের রুরুর মতোই হবেন। আমার এই ইগো যে আমারই প্রকৃতি বিরুদ্ধ, সেটা বোঝার ক্ষমতা আমার তখন হয়নি। আদতে বিমলেন্দু আঙ্কল খুবই হ্যান্ডসাম, সদাশয়, সদালাপী একজন মানুষ। ওর ইংরিজি শুনলে যে কোনও ব্রিটিশ ধন্দে পড়ে যাবে। শেক্সপিয়ার থেকে ইংলিশ কান্ট্রিসাইড ফোক, রবীন্দ্রনাথ থেকে সত্যজিৎ রায়--বিষয় যাই হোক বিমলেন্দু আঙ্কল তাই নিয়ে অনর্গল কথা বলে যেতে পারেন। আবার গড়িয়াহাটে বাঙালি মেয়েদের দোকানদারের সঙ্গে দরদস্তুর করা বা ইতালিয়ান মেয়েদের লঁজারির প্রতি দুর্বলতা নিয়ে রসিকতা করতেও ওর বাধে না।
সেদিন ওর সঙ্গে আমার অনেক কথাই হয়েছিল। সব কথা এখানে প্রাসঙ্গিক হবে না। সুতরাং সংক্ষেপেই বলব। আমার পড়াশোনা এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে সবই প্রায় রুরু আগেই বলে রেখেছিল। ইন্দাস স্ক্রিপ্ট নিয়ে গবেষণা করছি তাও বিমলেন্দু আঙ্কল জানেন। সেই সূত্রে বললেন, 'ডোনট টেক মি আদারওয়াইজ অর্জুন। আই থট রুরু উইল ম্যারি সামওয়ান ফ্রম বিজনেস ব্যাকগ্রাউন্ড। হি উইল টেক চার্জ অফ দিস বিজনেস এমপায়ার ইন মাই অ্যবসেন্স। কিন্তু তুমি এত ভালো ছাত্র যে তোমাকে আমি সে কথা বলতেই পারব না।'
মনে হল আঙ্কলের গলায় আক্ষেপের সুর শুনলাম। কিন্তু এ ব্যাপারে আমি কীই বা করতে পারি! বিজনেস আমাকে দিয়ে হবে না। আমার ভাগ্য ভালো সেদিন আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল রুরু।--'নো ড্যাড। ডোনট গেট হিম ইন ইয়োর বিজনেস। আই ওয়ান্ট হিম টু ডু হোয়াট হি লাইকস।'
'আমিও তাই চাই রে। কিন্তু এতগুলো লোকের ভবিষ্যৎ যে সিস্টেমটার সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার ভবিষ্যতের কথাটাও তো ভাবতে হবে।'
'আমি তো তোমাকে বলেছি, ইফ রিকোয়ার্ড, আই উইল লুক আফটার।'
বিমলেন্দু আঙ্কল অবাক হয়ে বললেন 'তুই! বাট ইউ হ্যাভ নেভার শোন এনি ইন্টারেস্ট ইন বিজনেস।'
'আগে ইন্টারেস্ট দেখাইনি কারণ তখন অর্জুন ছিল না। এখন দেখাব। আই প্রমিস।'
'ওকে। লেটস সি। আই উইল বি গ্রেটফুল টু ইউ অর্জুন, ইফ শি শোজ এনি ইন্টারেস্ট ইন মাই বিজনেস। এনিওয়ে, তোমাদের বিয়েতে আমার কোনও আপত্তি নেই। অ্যাজ আ সন ইন ল ইউ আর হাইলি অ্যাকসেপ্টেবল। যতদূর জানি রুরুর মায়েরও একই মত। আজ সন্ধ্যেবেলায় বেরনোর আগে কথাটা তিনি একবার বলেও গেছেন। বাট আই হ্যাভ আ কোয়েশ্চেন।'
'বলুন'
'রুরু আমার একমাত্র সন্তান। খুবই ল্যাভিশলি বড়ো হয়েছে ও। শি ইজ সামটাইমস ভেরি ইমপালসিভ অ্যান্ড অ্যারোগ্যান্ট। আর ইউ শিওর, ইউ উইল বি এবল টু ম্যানেজ হার?'
হেসে ফেললাম, 'আই থিংক প্রপার আনডারস্ট্যান্ডিং বিটুইন আ কাপল ক্যান ম্যানেজ এভরিথিং।'
'কী জানি! আমার আর রুরুর মায়ের মধ্যে তো ওই আনডারস্ট্যানডিংটাই কোনওদিন গড়ে উঠল না। আমিও ওকে বুঝলাম না, উনিও আমাকে বুঝলেন না। তাই ভয় হয়।'
রুরু অনেকক্ষণ থেকেই ছটফট করছিল। এবার বলল,' অর্জুন আমাকে খুব ভালো বোঝে ড্যাড। আমিও ওকে বুঝি। তুমি এসব নিয়ে কিচ্ছু ভেবো না। অর্জুন উইল মেক মি দা হ্যাপিয়েস্ট উওম্যান।
এবার তুমি একটু ওপরে যাও। আই ওয়ান্ট টু স্পেন্ড সাম কোয়ালিটি টাইম উইথ হিম।'
আঙ্কলকে একরকম জোর করেই ঘর থেকে বের করে দিল রুরু। মেঘের মতো ঘন সেই নির্জনতায় আমরা বসে রইলাম। কারোর মুখে টু শব্দটি নেই। যেন আমাদের সাবেক যত কথা ছিল সব বলা হয়ে গেছে। এবার নতুন কথা বলার পালা।
মানুষের জীবনে এই মুহূর্তটা কতটা বিস্ময়কর আমি তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না কুমুদিনী। এতদিন যা ছিল আমার আর রুরুর দু'জনের রিয়ালিটি, অভিভাবকদের সম্মতিতে সেটাই সকলের হয়ে গেল। আমরা ব্যক্তিগত থেকে সামাজিক হলাম। বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটির উদ্দেশ্য তো সেটাই। ভালোবাসার বাঁধনে বাঁধা বা ভালোবাসার বাঁধনে বাঁধা পড়তে চাওয়া মানুষদুটিকে সমাজের মূলস্রোতে নিয়ে আসা। তাদের দুয়ের থেকে দশের করে তোলা।
অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকার পর রুরু বলল,'আমি তোমাকে সুখী করতে পারব তো অর্জুন?'
অবাক হলাম।--'আজ হঠাৎ এই প্রশ্ন?'
'বলো না--'
'পারবে।'
রুরু কেমন যেন দূরমনস্ক গলায় বলল,' ভয় হয় জানো। মম যেমন ড্যাডের অরবিট থেকে ছিঁটকে গেছে, আমিও যদি কোনওদিন ছিঁটকে যাই--তুমি আমাকে শক্ত করে ধরে রাখবে তো?'
দেখলাম রুরুর চোখে জল। কাঁদার দিনে সব মানুষই কাঁদে। কিন্তু রুরু কোনওদিন কাঁদতে পারে স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। তাই কী বলে ওকে সান্ত্বনা দেব বুঝতে না পেরে বললাম,'আজ তো আমাদের আনন্দের দিন রুরু। কেন মিছিমিছি মন খারাপ করছ?'
'পুরনো রুরু যদি কোনওদিন ফিরে আসে আর আমি যদি তোমাকে হারিয়ে ফেলি?'
'আসবে না। আমি আসতে দেব না।'
রুরু নিশ্চিন্ত হয়ে আমার বুকে আশ্রয় নিল। আমি প্রসঙ্গ পাল্টাতে চাইছিলাম। রুরুর চোখে জল আমার ভালো লাগছিল না। ওর মুখটা দু'হাতে তুলে ঠোঁটে চুমু খেয়ে বললাম,'আমার রাজহংসিনীরা কেমন আছে রুরু? ওরা আমার কথা বলে?'
'হুঁ'
'কী বলে?'
'জানি না'
'বেশ৷ আমি তা হলে ওদের মুখ থেকেই শুনি ওরা কী বলে।'
রুরু চোখ পাকিয়ে বলল, 'সাহস তো খুব! ড্যাড ইজ অ্যাট হোম!'
'উঁহু। একটু আগে গাড়ির শব্দ পেয়েছি। উনি বেরিয়ে গেছেন।'
(ক্রমশ)



Share

মন্তব্যসমূহ