রবিবাসরীয় সাহিত্যের বেহালার দিন প্রতিদিন - বর্তমানের সাহিত্য সাধনা চারণ ভূমি হালহকিকত ঘুরে দেখলেন সাংবাদিক কাজল ভট্টাচার্য - " দুয়োরানি লিটলম্যাগ "
- কাজল ভট্টাচার্য
(লিটল ম্যাগাজিন বনাম কর্পোরেট হাউসের বাজারচলতি ম্যাগাজিন। দু'পক্ষই একে অন্যকে দেখে নাক সিঁটকোয়। মলিনবসন লিটল ম্যাগাজিনের। কর্পোরেটের ঝাঁ চকচকে দুনিয়া। তবু কর্পোরেট হাউসের কলমচি আউটসোর্সিংয়ের উৎস ওই মলিনবসনরাই। আবার মলিনবসন ছেড়ে শরীরে হালফ্যাশনের পোশাক তোলার উচ্চাশা পূরণের জাদুকাঠি ওই কর্পোরেটের সিন্দুকেই। কজনের স্পর্ধা আছে সেই জাদুকাঠি উপেক্ষার?)
শাশুড়ি বউয়ের খেয়োখেয়ি। আবার দুই সতীনের ঝগড়াও বলা যায়।
লিট্ল ম্যাগাজিনের প্রকাশক যা শাশুড়িও তা। আর কবি বা লেখকের হাল নববধূর মতো। ছেলেবউকে অষ্টপ্রহর নামকীর্তনের মতো একটাই মন্ত্র জপান সেই শাশুড়ি- 'আমার ছেলেটা ছিলো বলেই বর পেয়েছিস।'
- 'আমার লিটল ম্যাগাজিনটা ছিলো বলেই তোর বাড়বাড়ন্ত।' পারলে নবীন কবিলেখককে উঠতে বসতে, শয়নে স্বপনে সেকথা মনে করিয়ে দেন প্রকাশক।
শাশুড়ির গর্ভজাত ছেলেটি ছিলো বলেই তার গলায় মালার লাগাম পরিয়ে ছেলেবউ হওয়া। ঠিক সেভাবেই কারুর গর্ভজাত ওই লিটল ম্যাগাজিন ছিলো বলেই, তার পাতায় শব্দ সাজিয়ে কবি বা গল্পকার হওয়া। হাত মকশো করা। ধীরে ধীরে পরিণতির দিকে এগিয়ে যাওয়া।
আর তাই প্রকাশক চান, উঠতি লেখকটির লাগাম তাঁর হাতেই থাক। শাশুড়িও চান না ছেলের ওপর থেকে তাঁর দখলদারি একটুও কমুক। গোটা লড়াইটা আসলে ক্ষমতা দখলের।
কিন্তু নববধূ কী চায়? নবীন লেখকের স্বপ্নটাই বা কী? শাশুড়ি বা প্রকাশকের সেসব নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই।
সত্যিই তো, কেই বা চিনতো ওই টাটকা গোঁফদাড়িওয়ালা ছেলেটাকে? জিনস প্যান্টের সঙ্গে লম্বা পাঞ্জাবি আর কাঁধে শান্তিনিকেতনি ঝোলা। কবির ট্রেডমার্ক নিয়ে ঘুরে বেড়াতো। তারপর একদিন বত্রিশ পাতার এক লিটল ম্যাগাজিনে তার কবিতা ছাপা হলো। সেতো এক হইহই ব্যাপার। বাউন্ডুলে, আঁতেল, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর অপবাদগুলো ঘুঁচলো কিনা জানা নেই, তবে ওই দলের অনেকেই জেনে গেলো ছেলেটার কবিতা ছাপা হয়েছে। সেটা আরেকটু বেশি জানাজানি হলো, পাড়ার দুর্গাপুজোর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মঞ্চে উঠে কবিতা পড়ার পর। স্টেজ থেকে নামতেই নগদানগদি এক প্যাকেট মিষ্টি কবির মজদুরিবাবদ।
ঠিক একবছর পর, ছবিটা পাল্টে গেলো। সেই একই লেখক মঞ্চে উঠতেই হাতজোড় করে এগিয়ে এলেন পুজোর কর্মকর্তারা। গলায় জড়িয়ে দিলেন উত্তরীয়। এক সুন্দরী বালিকা হাতে তুলে দিয়ে গেলো একগুচ্ছ ফুল।
- 'আমরা গর্বিত,' বললেন পুজো কমিটির কালচারাল প্রেসিডেন্ট। 'আজ পাড়ার ছেলের সাফল্যে আমরা নিজেরাও ধন্য।'
বাংলার প্রথম শ্রেণীর পুজোবার্ষিকী বইয়ের একশো আঠারো নাম্বার পাতায় তমুকবাবুর কবিতার নীচেই জায়গা করে নিয়েছে পাড়ার ছেলের কবিতা। তাও পুরো আট লাইনের। আনএডিটেড।
রেগে আগুন লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক প্রকাশক। রাগ চেপে না রাখতে পেরে নিজের মনেই বলে উঠলেন- 'বেইমান। মিরজাফর। ইয়ের বাচ্চা।'
- 'কী হচ্ছেটা কী?' পাশের সিটে বসা মানুষটা ধমকের সুরে বললো। 'কাকে খিস্তি করছেন মশাই? চেনেন ও কে?'
- 'খুব চিনি। আমার ম্যাগাজিনে লিখতে না দিলে, আজ ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াতো।'
- 'আপনার আবার কোন ম্যাগাজিন?'
- 'অমুক ম্যাগাজিন। আটবছর ধরে চালাচ্ছি।'
- 'নাম শুনিনি তো। কোথা থেকে বেরোয়?'
পাড়ার বিয়েবাড়িতে বউমার গুণকীর্তন হচ্ছে। আর শাশুড়িকে যদি বলা হয় আপনার ছেলের নাম শুনিনি তো, তাহলে কোন দেবতুল্যা শাশুড়িই বা মেজাজ হারাবেন না? কীভাবে তিনি মেনে নেবেন, মহল্লায় তাঁর সুপুত্রটির খবর কেউ রাখে না। আর সবাই নাচানাচি করছে তাঁর পুত্রবধূটিকে নিয়ে।
অগত্যা বউমার নিন্দা করা ছাড়া আর উপায় কী? খিস্তিখাস্তা তো করতে পারেন না ওই লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশকের মতো। নইলে ওই প্রকাশক আর শাশুড়িকে একসুরে বলতে হতো- 'এলেম আছে বটে!'
লিটল ম্যাগাজিন নামের পাঠশালার পড়ুয়াদের কেউ কেউ আখেরে কর্পোরেট হাউসের ম্যাগাজিনের 'করণিক লিখিয়ে' হন। তবে ব্যাপারটা খুব সহজ সরল নয়। যতোই বলুন না কেন অমুক দাদা তমুক দিদির পেছনে তেল লাগিয়ে ঢুকে পড়েছে। আসলে 'এলেম' লাগে। কলমের ধার থাকা চাই। তবেই নগদ সাম্মানিকভোগী কবিলেখক।
কথায় আছে, বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়া। সেরকমই সাম্মানিকভোগী কবি লেখকদের মধ্যে বরাতজোরে, কেউ করণিক কবিলেখকও হলে হতে পারেন। মফস্বলবাস থেকে নগরবাজারে উত্তরণ। সবশেষে ওই দাদাদিদির গপ্প। তাঁদের কৃপাদৃষ্টি থাকলে অনেকসময় দুহাতে দুই লাড্ডুও জুটে যায়।
তবে কলমের খোঁচায় ধার থাকলেও কর্পোরেট হাউসের লৌহকপাট ভেদ করা মুখের কথা না। চটির সোল, হাফসোল খইয়েও দরজা থেকে ফিরে ফিরে আসা। ব্যাপারটা যেন, শরীরের সব কলকব্জা ঠিকঠাক। অথচ দাম্পত্যের ছ'বছর পরেও সন্তান না আসার মতো। তখন চিকিৎসা চললেও, বাঁজা নামধারী মহিলা মন্দিরে মাথাকুটে মরেন।
ওদিকে কর্পোরেটের সিংহদ্বারে মাথাকুটে, মাথায় গোল আলু গজিয়ে ফেলেন কবি। অনেকেই আলুর যন্ত্রণায় হাল ছেড়ে, ঘরের ছেলে ঘরেই ফিরে যান। লেখালেখি চলতে থাকে সেই লিটল ম্যাগাজিনেই। গোটা ব্যাপারটাই চেপে যান নববধূর পরকীয়ার মতো, লোকলজ্জার ভয়ে। আর এব্যাপারে যাঁরা একটু বেশিই জানেন, তাঁরা মফস্বলের কবি সাহিত্যিক।
মহানগর থেকে তাঁদের বাস অনেক দূরে। তাঁরা স্পর্ধা করেছিলেন রামধনুর স্বপ্ন দেখার। চেষ্টা করেছিলেন হাতের কলম দিয়ে আকাশটাকে ছুঁয়ে ফেলার।
সবমিলিয়ে লিটল ম্যাগাজিনকে সিঁড়ি বানিয়ে কর্পোরেট হাউসের অলিন্দ ছুঁয়ে অন্দরমহলে ঢুকে পড়া খুব চাট্টিখানি কথা নয়। ওই কাজটি যাঁরা পেরেছেন, তাঁরাই হাড়ে হাড়ে টের পান। আর যাঁরা পারেননি, তাঁদের কাছে আঙুর ফল টক।
কর্পোরেট হাউসে ঢুকে পড়া যতটা না কঠিন, তারচেয়েও কঠিন সেখানে টিঁকে থাকা।
তারপর আছে হাউস পলিটিক্স। ওই আবর্তেও ভেসে থাকার কৌশলটি রপ্ত করে ফেলতে হয়। নইলে ঘাড়ের ওপর খাড়া ঝুলবেই।
কলমের ধারেও কাটতে হবে, ভারেও কাটতে হবে। এলেমের ধারাবাহিকতা চাই। শব্দের মালা গাঁথার দক্ষতায় এতটুকু ছন্দপতন মানেই পত্রপাঠ বিদায়। কবিতা গল্প তখন আর বিলাসিতা নয়। আবার শুকনো খটখটে বাস্তব জীবনদর্শনও নয়। যা শুধুমাত্র গম্ভীর চিন্তার খোরাক জোগায়। গোটাটাই তখন নাগরিকমুখী। পাঠকের বাড়ির দরজা খুলে বেডরুম ছুঁয়ে সোজা হেঁসেলে ঢুকে যাওয়া। পাক করার অবসরে গিন্নি পাতা উল্টে লেখার স্বাদ চেখে দেখে নেন। নুন লঙ্কা মশলার ঠিকঠাক কম্বিনেশন। সেই গিন্নি নিজে যেমনই রান্না করুন না কেন, অন্যের রান্নায় খুঁত ধরেই ছাড়বেন। তাঁকেও সন্তুষ্ট করার কাজটা খুব সোজা না।
লিটল ম্যাগাজিনের ঘরের রান্নায় নুনে টান পড়লেও সবাই মানিয়ে নেন। কেউ কাউকে মুখ ঝামটা দেন না, বা রাঁধুনিকেও ত্যাজ্য করেন না। সবাই নিঃশুল্ক স্বেচ্ছাসেবী। গোটা ব্যাপারটাই ঘরোয়া। শৌখিন মজদুরি। কিন্তু রান্নাটা যখন কর্পোরেট পত্রিকার হোম ডেলিভারির, তখন ওসব চলবে না। পারফেক্ট রাঁধুনির পারফেক্ট রেসিপি। চমকদার। মশলার পরিমাণ ঠিকঠাক। বেশ মাখোমাখো ব্যঞ্জন। পকেটের টাকা খসিয়ে হকারের থেকে সাপ্তাহিক, পাক্ষিক কী মাসিক পত্রিকার হোম ডেলিভারি নেবেন পাঠক। সেই পাঠকের মন ভরাতে পারার শর্তেই কবিলেখকের পেটভরার সংস্থান।
কবি হোন বা লেখক, লিখে টাকা পান। তাদের সেই লেখা বেচেই শ্রীবৃদ্ধি প্রকাশকের। গোটা ব্যাপারটা সাহিত্যরসে যতোই সমৃদ্ধ হোক না কেন, গোটাটাই পেশাদারি। ওই সোনার গয়নাগাটির মতো। খাঁটি সোনা হলেই চলবে না। তারসঙ্গে সোহাগার মিশেলটা দিতে হবে অঙ্কের হিসেবে। তবেই সোনার কলমে সোনার আখর। ওই কেরামতি রপ্ত করতে পারলেই বাজিমাত। লিটল ম্যাগাজিনের গণ্ডি ডিঙিয়ে কর্পোরেট হাউসের জগতে ঢুকে পড়ার ছাড়পত্র।
লিটল ম্যাগাজিন বাস্তবে কবি লেখকের পাঠশালা। সাহিত্যের স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণের হাতেখড়ি সেখানেই। কিন্তু এই পাঠশালার হেডমাস্টারমশাই কে? অনেকেই মনে করেন, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ১৮৭২ সালে তাঁর 'বঙ্গদর্শন' দিয়েই বাংলায় লিটল ম্যাগাজিনের যাত্রা শুরু।
আবার আরেকদলের দাবি, কভভি নেহি। আজকের লিটল ম্যাগাজিনের যে চরিত্র তা প্রথম দেখা গেছিলো ১৯১৪ সালে, প্রমথ চৌধুরীর 'সবুজপত্র'তে। এর পরের জমানায় সাহিত্যের এই স্বতন্ত্র ধারাকে আরও মজবুত করে তোলে কল্লোল, পূর্বাশা, শনিবারের চিঠির মতো একের পর আরেক লিটল ম্যাগাজিন।
যশ অর্থ খ্যাতি এসবের কোনটাই না। লিটল ম্যাগাজিনের আকর্ষণ অন্যখানে। বেশ একটা বিপ্লবের সোঁদা গন্ধ। নিয়ম ভাঙার উত্তেজনা। রবীন্দ্রযুগের লিটল ম্যাগগুলির প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো, রবীন্দ্রনাথের প্রভাব মুক্ত হয়ে সাহিত্য রচনা। সেই রাস্তাতেই পা বাড়িয়েছিল 'কৃত্তিবাস'। ১৯৫২ সালে প্রকাশিত হওয়ার পর আন্দোলন তীব্র করে তুলতে কলম ধরেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, কমলকুমার মজুমদারের মতো দিকপালরা।
তবে লিটল ম্যাগাজিনের সেই আদি চরিত্র ঠিক কতখানি অবশিষ্ট রয়েছে, তা পাঠকরাই ভেবে দেখুন। নাকি কবি হিসেবে নাম ছাপানোর সহজতম উপায় লিটল ম্যাগাজিনে দু'কলম লিখে ফেলা।
কারুর তাঁবেদারি না। একদল তরুণের শুধুই লিখে যাওয়া। সেই লেখা কাউকে ভালো লাগানোর দায় অস্বীকার করে। আর তাই বাজারের কৃপাদৃষ্টি থেকেও বঞ্চিত থেকে যায় লিটল ম্যাগাজিন। এপর্যন্ত না হয় ঠিক আছে। কিন্তু যাঁরা কলমকেই পেশা করতে চান? নিজেদের কবিতা গল্প প্রবন্ধ নিয়ে পৌঁছে যেতে চান সহস্র পাঠকের দরবারে। তাঁদের সঙ্গে ক্রমেই দূরত্ব বেড়ে চলে লিটল ম্যাগাজিনের পাঠশালার। যে কোনও সৃষ্টিশীল মানুষকে বারেবারে ঘরছাড়া করেছে বাইরের হাতছানি। গ্রামগঞ্জ থেকে মফস্বল শহর। শহর থেকে মহানগর।
এক নির্দিষ্ট শ্রেনীর পাঠকও আছে লিটল ম্যাগাজিনের। তাঁদের জন্যই ফিবছর নিয়ম করে বসে, এক স্বতন্ত্র ম্যাগাজিন মেলা। ওদিকে ২০২০ কলকাতা বইমেলায় লিটল ম্যাগাজিনের বেচাকেনা ছিলো বেশ চোখে পড়ার মতো। কমবেশি দুশোটি টেবিল সাজিয়ে বসেছিলেন সাহিত্যের তরুণ তুর্কিরা। শুধু বাংলা না, অনেকেই ছুটে এসেছিলেন ত্রিপুরা অসমের মতো ভিনরাজ্য থেকেও।
আসলে লিটল ম্যাগাজিনের গোটাটাই এক নিখাদ আবেগ। নতুন সৃষ্টির নেশায় বুঁদ। দলাদলি খেয়োখেয়ি সবই আছে। তবু স্বপ্নের সংসার। স্বপ্নের পেছনে ছুটে চলা। ছুটতে ছুটতে একসময় বাস্তবের দুনিয়ায় পৌঁছে যাওয়া। আর ঠিক সেখানেই হাত বাড়িয়ে অপেক্ষায় কর্পোরেট হাউস। ঠিক কজনের স্পর্ধা থাকে সেই হাতছানিকে অস্বীকার করার?
লিটল ম্যাগাজিনের লক্ষণগন্ডি ডিঙিয়ে শব্দের জাদুগরদের অনেকেই হাত ধরেন কর্পোরেট হাউসের। আর তাতেই গোঁসা হন লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশক। ঠিক সেই শাশুড়ির মতো। তাঁকেই বা দোষ দিই কি করে? কোলের সন্তান স্বাবলম্বী হয়ে, ঘরছেড়ে নববধূকে নিয়ে বিদেশ বিভুঁয়ের কর্মস্থলে চলে গেলে, মায়ের তো অভিমান হবেই।
চিত্রঃ কাজল ভট্টাচার্য
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন