বেহালার দিন প্রতিদিন বিশেষ - সাংবাদিক কাজল ভট্টাচার্যের ক্যানভাসে " শিল্প শহরের শিল্পচর্চাঃআসানসোল "

 
শিল্পশহরের শিল্পচর্চা ২: আসানসোল 

আসানসোলের রংরসের ধারক বাহকরা 

শিল্পীঃ দেবব্রত ঘোষ 

  - কাজল ভট্টাচার্য 

(বর্ণময় আসানসোল। সত্যেনদার পূর্বসূরিরা যেমন রং তুলির ওস্তাদ কারিগর ছিলেন, উত্তরসূরিরাও কিছু কম যায় না। আজ তাদের কথা।)

একটুকরো ছেঁড়া কাগজ। আঁকিবুকি কাটা। সাদাকালো হোক বা রঙিন। এক দেখাতেই বলে দেওয়া যায়- এতো নীলুর ছবি।
কিন্তু সেই চোখ কোথায়? ছবি দেখার এই চোখটাই তৈরি হলো না আসানসোলে।
হবেটাই বা কীভাবে? কালচার কাকুদের চশমা এঁটে যে যার মতো আসানসোলটাকে দেখলেন। হইচই বাঁধালেন। ধাঁই কিরি কিরি নাচ জুড়ে দিলেন। জয় শিল্পের জয়। জয় শিল্পীর জয়। কে শিল্পী, শিল্পটাই বা কোন ধাঁচের? কিছুই বোঝা গেলো না। মুড়ি মুড়কি সব গুলিয়ে দেওয়া হলো। আলটিমেটলি ব্যাপারটা দাঁড়ালো অন্ধের হস্তিদর্শন। নিজের শহরের গুণী শিল্পীদের চেনা হলো না আসানসোলের। 
যার খেসারত দিতে মানুষের এমন প্রশ্নের মুখেও পড়তে হয়- দেবব্রতবাবু ছবিও আঁকেন নাকি?
আবার অনেকেই প্রিয়দর্শী বসুর নাম শুনেছেন। মানুষটা নাকি ছবিটবি আঁকে, এমনটাও শুনেছেন। কিন্তু সেছবি কেমন, তা আর দেখা হয়ে ওঠেনি।
সত্যেন গাঙ্গুলি, বিকাশ সেনগুপ্তর উত্তরসূরি বলতে এই দেবব্রত ঘোষ, প্রিয়দর্শী বসু আর নীলোৎপল ভট্টাচার্যরাই। এঁদের মধ্যেই আবার সিনিয়র বলতে এখন দেবব্রত ঘোষ। 

- ছবিও আঁকেন নাকি? 
ওই একটি কথার মধ্যেই ঠিকঠাক ধরা পড়ে আপকার গার্ডেনের দেবুদা। শিক্ষায়- দীক্ষায় পেন্টার, কলকাতার নামজাদা শিল্পীদের সংগঠন 'কনট্রাইভেন্স'- এর মেম্বার। অ্যাকাডেমির প্রদর্শনীতে ছবি দেখানো। এরই পাশাপাশি আরও অনেক ব্যাপারেই তার ব্যাপক উৎসাহ। খেলার মাঠ থেকে নিয়ে আদিবাসী ছেলেমেয়েদের নিয়ে কাজকর্ম। আবার কলকাতার এক বাংলা দৈনিকের সাংবাদিকতার পাশাপাশি নিজের এক ছোট্ট সাপ্তাহিক পত্রিকা বার করা গত বিয়াল্লিশ বছর ধরে। সবেতেই দেবুদা। 

মেজাজে রং লাগলে ক্যানভাসে রামধনুর বর্ণ সমাহার। আবার মগজে শব্দেরা ভিড় জমালে বসে যান গল্প লিখতে। এরইমধ্যে ফোন বেজে উঠলে, খবরের নোট টুকে ফেলেন। আর তারপরেই যদি কানে আসে- দেবুদা আছো নাকি? তাহলে তো সোনায় সোহাগা! জমিয়ে আড্ডা।
ভালবাসেন ছবি নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে। প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়ে ছবির ফর্ম, রংয়ের ব্যবহার। তবে ঝোঁকটা বোধহয় 'রিয়ালিস্টিক'- এর দিকেই ঝোঁকা। জলরং তেলরং প্যাস্টেল ছাড়াও শুধু বর্ণনা শুনে পেন্সিল স্কেচে ক্যানভাসে অজানা মানুষটির মুখ ধরে ফেলা। ছবির ভাষায় 'পোর্ট্রেট পার্লার'। তবে আমার প্রিয় দেবুদার কোলাজ। বড্ড বেশি আধুনিক। টানটান কাজ। চোখ বড়ো বড়ো করে দেখতে হয়।

শিল্পীঃ  প্রিয়দর্শী বসু 

প্রিয়দর্শী বসুর ছবি দেখেছেন? 
স্বভাবেও মিষ্টি, হাতখানাও তেমনই মিষ্টি। প্রিয়র ছবি যেন জীবনানন্দের কবিতা। আবার কখনও বাঙ্ময় গভীর জীবনদর্শনে। আসানসোলের 'কালচার কাকুরা' বলতে পারেন- প্রিয়দর্শী কোন ঘরানার ছবি আঁকেন? তাঁর মাধ্যমটাই বা কী?
ওগুলো না জেনে প্রিয়দর্শীকে নিয়ে নাচানাচি করা অর্থহীন। অর্থহীন ভালো বলে তো কিছু হয় না। 
মাধ্যমটাও বেশ রেয়ার- টেম্পারা। ইন্ডিয়ান পেন্টিংসের সঙ্গে যায়ও বেশ ভালো। আসানসোলের ঠিক কজন শিল্পরসিক প্রিয়দর্শীর ছবির রসে মজেছেন? মোটামুটিভাবে ইসমাইল অঞ্চলেই আটকে থেকে গেলো প্রিয়। আসানসোলে এমন অনেককেই দেখেছি প্রিয়র নামটা শুনেছেন। প্রিয় ভালো ছবি আঁকে তাও শুনেছেন। ব্যাস, ওই পর্যন্তই। 
বহুদিন ধরেই অসুস্থ প্রিয়দর্শী। চিরকুমার। ভরসা ওই ছাত্রছাত্রীরাই। তারাই আগলে রেখেছে তাদের বাপীদাকে। নাকি বাপীদাই আগলে রেখেছে ওই একপাল সবুজ নবীনকে? বোঝা দুষ্কর। আসানসোল প্রিয়র খবর রাখে না।

শিল্পীঃ নীলোৎপল ভট্টাচার্য

নীলোৎপল ভট্টাচার্যের কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, তার কথাতেই ফিরে আসি। বাস কল্যাণপুর হাউজিংয়ে। খানিকটা সব্যসাচী টাইপের মানুষ। একহাতে লেখে অন্যহাতে আঁকে। তবে লেখালেখির জগতে মূলত কবি। আবার সাংবাদিক হওয়ার সুবাদে ফিচার লেখার হাতটাও বেশ। দুহাতের রোজগারে সংসার চললেও, মানুষটার জীবন কাটলো সহস্র চাপেই। টাকাপয়সায় বেহিসাবি হওয়ার সুযোগ না থাকলেও, জীবনের গোটাটাই বেহিসাবি। বাউল জীবন। ছবিতেও ছড়িয়ে সেই বাউলের উচ্ছলতা। নীলুর ছবিতেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাউলিয়া বর্ণের ছটা। ভীষণ চোখ টানে। রঙিন নির্মল আনন্দ। ক্যানভাস জুড়ে রংরেখার উৎসব।
আবার সাদাকালোতেও অসম্ভব সুন্দর ছবির বুনোট। রেখার চলন- বলনে মুক্তছন্দ। নীলুর ছবির মতোই, কোলাজও এক স্বতন্ত্র ঘরানার। ছবি থেকে কোলাজ, সবেতেই এক 'সিগনেচার স্টাইল'। আর তাই খড়ের গাদা থেকে একটুকরো কাগজের আঁকিবুকি দেখেও অনায়াসে বলে ফেলা যায়- আরে, এতো নীলুর আঁকা!

শিল্পী: শিবাজি বসু

 'সিলভার প্যালেট আর্টিস্টস' গ্রুপ'- এর এই শিল্পীদের সঙ্গে চুটিয়ে কাজ করতো আরও দুই কনিষ্ঠ। শিবাজি বসু আর গৌতম দত্ত। প্রকৃতিকে নানা আঙ্গিকে ধরতো শিবাজি। তেলরংয়ের কাজে সাবলীল। কোথাও কোনও জটিলতা ছিলো না। নান্দনিক পরিবেশন। তবে ওস্তাদ কারিগর ফেব্রিক রংয়ের কাজে। আস্ত একটা দেওয়ালই তখন ক্যানভাস। এক সাধারণ শাড়ি বা বিছানার চাদর অসাধারণ হয়ে ওঠে শিবাজির রং তুলির ছোঁয়ায়। কখনও মনোক্রোম তো কখনও ডাইক্রোম। খুব বেশি রংয়ের দরকার পড়ে না নজর কাড়তে। নক্সায় ধরা পড়ে মহারাষ্ট্রের আদি ঘরানার ওয়ার্লি পেন্টিংস। আবার কখনও বিষ্ণুপুরি সিল্কের গায়ে হাজির গুহাচিত্র বা মিশরের পিরামিডের গায়ে আঁকা আদি চরিত্ররা। 
একদেখাতেই বোঝা যায়, শিল্পীর এলেম আছে।

শিল্পীঃ গৌতম দত্ত 

সর্বকনিষ্ঠ গৌতম দত্ত স্বভাবেও ছটফটে। ছবিও সেরকম। রংয়ে রেখায় গতিময়। ভাবনাচিন্তার তেমন ধার ধারে না। মনের আনন্দে এঁকে যাওয়া। তবে কখনোই যে সিরিয়াস মুডে ছবি আঁকে না, এমনটাও নয়। আসলে জীবনটাকে দেখার চোখটাই সহজ। আর তাই মগজ হাতের যোগাযোগে ছবির বিষয়ে নানা বৈচিত্র্য। 
চিন্তা ভাবনার জগতটা যেমন ছড়ানো ছিটানো, শশীভূষণ গড়াই রোডের গৌতমের ছবিও তাই। তেলরং জলরংয়ের পাশাপাশি প্যাস্টেলের ব্যবহার। সবমিলিয়ে বেশ এক চমক। ছবি কখনও উঁচু স্বরে বাঁধা তো পরমুহূর্তেই মধ্যমে। বেশ মজার কাজ। তখন বয়সেও কম, ছবিতে জটিলতাও কম। বেশ খোলামেলা, বড় পরিসরে ছবি আঁকতে ভালবাসতো। এখন গোটা দেওয়ালটাই তার ক্যানভাস। মিউরালের কাজ করে চলেছে মনের আনন্দে।

আসানসোলের বুকেই সবুজ যৌবন কাটিয়ে এই শিল্পীদের জীবনে আজ হলুদ বসন্ত। বয়স বেড়েছে শিবাজি, গৌতমেরও। আসানসোল থেকে শেকড় উপড়ে শিবাজি আজ মেমারিতে। বয়স বেড়েছে দেবুদার। চলাফেরা করতে অসুবিধা প্রিয়দর্শীর। সংসারের ঘানি টেনে আজ যেন অনেকটাই ক্লান্ত নীলু। স্বাভাবিকভাবেই অক্সিজেনে টান পড়েছে 'সিলভার প্যালেট আর্টিস্টস' গ্রুপ'- এর। নয়া প্রজন্মের কোনও শিল্পী উঠে আসেনি গ্রুপের হাল ধরতে।
অথচ যতদূর জানি, প্রিয়দর্শী নীলুর হাতেগড়া বেশকিছু এমন ছেলেমেয়ে আছে, যারা অনায়াসে ছবি আঁকার এই ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। মুশকিলটা হয়তো অন্যখানে। পেশাদার শিল্পী হওয়ার সামান্যতম সুযোগ তৈরি করে দিতে পারেনি আসানসোল। এর বাইরেও অনেকেই আছেন। সবার কথা জানতেও পারি না। 

সিলভার প্যালেটের শিল্পীরা আরেকবার একটু হাত- পা নেড়েচেড়ে উঠে দাঁড়ানোর কথা ভাববেন নাকি? তাহলেই আসানসোল ফের বর্ণময় হয়ে উঠতো। ঠিক যেমনটা আগে হয়েছিল। ছবি, কোলাজের আধুনিক ধারা দুচোখ ভরে দেখতেন শিল্পরসিকরা। স্রষ্টা হওয়ায় সৃষ্টির ধারা বাঁচিয়ে রাখার মতো পরিবেশ তৈরির প্রথম দায়ভার কিন্তু আপনাদের ওপরেই বর্তায়। ছবি যেন সেই গল্পের 'সেলফিশ জায়ান্ট'- এর বাগানের ফুল হয়ে না থেকে যায়।
মজার কথা, প্রদর্শনী হোক না হোক, এই শিল্পীরা নিজেদের সৃষ্টির কাজে বিরাম নেননি। আপনমনে তাঁদের কাজ করেই চলেছেন। এযেন এক অনন্ত যাত্রা। কোনও গন্তব্যে পৌঁছনোর তাড়া নেই। কোথায় চলেছেন, কেন চলেছেন, কিছুই জানেন না। তবু চলেছেন। চলাটাই জীবন। সেখানে বিন্দুমাত্র শিথিলতা নেই। 
ছবির সংখ্যা বাড়ছে। শিল্পসম্পদ জমছে ঘরের কোণে। সেই সম্পদের ভার এতটাই যে এঁরা প্রত্যেকেই যে কোনও সময় এককভাবে একটা এক্সিবিসন নামিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা ধরেন। ধূলোর আস্তরণে শিল্পসম্ভার ঢেকে দিচ্ছে শিল্পশহর। 'কালচার কাকুরা' শিল্পটিল্পের বুলি আওড়ে বাজার গরম করছেন। আসানসোল শিল্পশহর শিল্প বলতে শুধুই কয়লা, লোহা, ইস্পাত বোঝে। তারমধ্যে দেবুদা, প্রিয়, নীলুদের ছবি কোলাজের জায়গা হয় না।



(আগামী সংখ্যায় ভাস্কর আশিস পাল)

মন্তব্যসমূহ