রবিবাসরীয় সাহিত্যের দিন প্রতিদিন - সাহিত্যিক সন্দীপ চক্রবর্তীর অন্য ধারার গল্প গাঁথার ধারাবাহিক " তুহু মম "
রবিবাসরীয় ধারাবাহিক
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের নবীন লেখক সন্দীপ চক্রবর্তী । সন্দীপ লেখেন, নিজের অনুভুতি দিয়ে। সেখানে পাওয়া যাবে নিজেকে খুঁজে। বর্তমানে সন্দীপ একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের অন্যতম ।সন্দীপের প্রতিটি অক্ষরের মাঝে লুকিয়ে থাকে সমাজের চালচিত্র। প্রতিদিন থাকছে এই সমাজের কথকতা। একেবারে নতুন এক আঙ্গিক। একেবারে অন্য রকম আখ্যান গাথা
তুঁহু মম / ১৬
সন্দীপ চক্রবর্তী
বুঝতেই পারছ কুমুদুনী, যার মাসিক রোজগার কুড়িয়ে-বাড়িয়ে বারোশো টাকার মতো আর বাবার পাঠানো পাঁচশো টাকা-- তার পক্ষে মাত্র দু'দিনের নোটিশে তিন হাজার টাকা বের করে দেওয়া সম্ভব নয়। সাতশো টাকাই আমি দিতে পেরেছিলাম। বাকিটা ধার করতে হয়েছিল। তাও আমার ভাগ্য ভালো, যে গাড়িতে আমরা রায়চক গিয়েছিলাম তার খরচ রুরু আমাকে দিতে দেয়নি। নয়তো আমার হাল আরও খারাপ হত।
কিন্তু একরাতের নিধুবনে আমি কি নতুন কিছু পেয়েছিলাম? হ্যাঁ কুমুদিনী পেয়েছিলাম। সবটাই নতুন। আমার কাছে র্যাডিসন ফোর্ট নতুন। তিনশো তিপ্পান্ন নম্বর ঘরটা নতুন। মেঝের ইটালিয়ান টাইলস নতুন। দেওয়ালের প্যারিস পেইন্ট নতুন। সেগুন কাঠের খাট নতুন। ম্যঞ্চেস্টার প্রিন্টের বেডকভার নতুন। বাথরুমের গোলাপি বাথটব নতুন। চার দেওয়ালের মধ্যে দু'জন দলছুটের একাকিত্ব নতুন।
সব থেকে বড়ো কথা রুরুও নতুন। সেদিনের আগে আমি কি কখনও রুরুকে নীল রংয়ের মুর্শিদাবাদ সিল্কের শাড়িতে দেখেছি? মনে পড়ে না। কিংবা খোলা চুলের রুরুকে? তাও মনে পড়ে না। যাওয়ার সময় গাড়িতে উঠেই আমি বলেছিলাম, 'রুরু ইউ লুক র্যাভিশিং টুডে!'
'থ্যাঙ্কস আ টন। বাট ডোন্ট ডু এনিথিং সিলি ইনসাইড দা কার। আ কাপল অফ আইজ ওয়াচিং আস।'
ইঙ্গিত ড্রাইভারের দিকে। লোকটা মাঝে মাঝে মিররে চোখ রেখে আমাদের দেখছে বটে। কিন্তু রুরু কবে থেকে অহেতুক কৌতূহলী চোখের নজর এড়াতে এমন সংযত হতে শিখল? এও এক নতুন অভিজ্ঞতা। যা মন চায় রুরু তাই করে। একবার রুরু ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে সবার চোখের সামনে আমার ঠোঁটে চুমু খেয়েছিল। আমি আড়ষ্ঠ। লজ্জায় জড়োসড়ো। রুরু নির্বিকার। যেন কিছুই হয়নি এমনই ভঙ্গিতে বলেছিল, 'ইয়োর লিপস আর ভেরি হট। আই লেফট আ মার্ক অন দেম বিফোর সামবডি এলস ডাজ। নাও, এবার ঠোঁটটা মুছে নাও। লিপস্টিকের দাগ লেগে আছে।'
'কী করলে বলো তো! সবাই দেখছে।'
রুরু অবাক, 'সো হোয়াট অর্জুন! আই ওয়ান্টেড, সো আই ডিড। কে দেখল কে শুনল, তাতে আমার কী আসে যায়!'
রুরু এরকম বলেই জানি। কিন্তু সেদিন রুরু সম্পূর্ণ অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল। এতদিন পর যখন ভাবি তখন মনে হয় সেদিন রুরু হয়তো আমার ভালো লাগবে বলেই আমার মনের মতন হতে চেয়েছিল। অন্য পুরুষবন্ধুদের সঙ্গে থাকার সময় ওকে কখনও নিজেকে বদলাতে দেখিনি। কিন্তু সেদিন রুরু নিজেকে বদলেছিল।
যাক সে কথা। আমি ভেবেছিলাম রিসর্টের রেজিস্টারে নিজেদের আসল নাম দেব না। কিন্তু চেক ইন করার ঠিক আগে রুরু বলল, 'ডোন্ট রাইট ফলস নেমস। উই আর নট ডুইং এনিথিং রং।
আমি ইতস্তত করছিলাম। শুনেছি রিসর্টে অনেক সময় পুলিশ রেইড হয়। যদিও র্যাডিসন ফোর্ট সেরকম রিসর্ট নয়। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে রুরু বলল, 'আয়াম নট আ হোর, অর্জুন। আ ফলস নেম মেকস মি ফিল লাইক দ্যাট। ফুর্তি করার ইচ্ছে থাকলে আমি অমলকে নিয়েই আসতে পারতাম৷ তোমাকে নিয়ে এসেছি মানে আই ওয়ান্ট টু ফিল দা টুগেদারনেস, ইনস্টেড অফ ডুইং সেক্স ওনলি।'
আমি আবারও অবাক হলাম। আমার দ্বিধাও কেটে গেল। রেজিস্টারে লিখলাম অর্জুন দাশগুপ্ত অ্যান্ড রুরু ঘোষ। সই করার সময় পুলিশ রেইডের কথা আমার মনেই পড়ল না। পোর্টারকে অনুসরণ করে এগিয়ে গেলাম তিনশো তিপ্পান্ন নম্বর ঘরের দিকে।
তারপর?
জানো কুমুদিনী, নব্বইয়ের দশক সারা পৃথিবীর রাজনীতি এবং অর্থনীতির ইতিহাসে একটা ল্যান্ডমার্ক। একদিকে কাশ্মীর থেকে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের তাড়ানো হচ্ছে, অন্যদিকে ইউরোপে পতন হচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়নের। পৃথিবীর কানে বাজছে একটা নতুন শব্দ, টেররিজম, সন্ত্রাসবাদ। আর অ্যামেরিকান মর্ডানিজমের হাত ধরে ভারতবর্ষে হৈ হৈ করে ঢুকে পড়ছে ভোগবাদ। দেশি-বিদেশি ব্যাঙ্কগুলো তখন ক্রেডিট কার্ডের পসরা সাজিয়ে লোকের পিছনে পিছনে ঘুরছে। আমাদের মতো ছাত্রদের হাতেও তখন ক্রেডিট কার্ডের সৌজন্যে অনেক টাকা। সেই বিপুল টাকার একটা বড়ো অংশ খরচ হয় জোকার আশেপাশের রিসর্টগুলোতে। রাতবিরেতে ফুর্তির ফোয়ারা ওঠে। আমার আফশোস কোথায় জানো, হয়তো অজান্তে কিন্তু আমিও একদিন এই ফুর্তির কালচারে গা ভাসিয়েছিলাম। আবার এটাও ঠিক, সেদিন গা না ভাসালে আমি রুরুর চরিত্রের চোখে-না-পড়া দিকটার হদিশ পেতাম না।
হ্যাঁ হদিশ। কেমন হদিশ এবার সেই কথা বলি।
তিনশো তিপ্পান্ন নম্বর ঘরটা অসাধারণ। ছোট্ট ব্যালকনিটায় দাঁড়ালে গঙ্গা দেখা যায়। দূর থেকে ঝলকে ঝলকে ছুটে আসে পাগল করা হাওয়া। ঘরে ফিরতে আর ইচ্ছে করে না। কফি খেয়ে আমরা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ছিলাম৷ গঙ্গায় ভেসে যাওয়া নৌকো দেখছিলাম। রুরু বলল, 'এখানে খাওয়া-দাওয়ার জন্য যা খরচ হবে সব আমি দেব।'
গঙ্গার অমলিন সৌন্দর্যে ডুবে থাকলেও এই চিন্তাটা আমার ছিল। কারণ র্যাডিসন ফোর্টের খাবার-দাবারের দাম খুবই চড়া। অথচ দু'দিনের ভাড়া মেটানোর পর আমার কাছে সামান্যই অবশিষ্ট থাকবে। সুতরাং রুরুর কথায় আপত্তি করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। রুরু বলল, 'ওই তিন হাজার টাকাও আমি তোমাকে দিতে দিতাম না। কিন্তু একটা জিনিস দেখার খুব ইচ্ছে হল। তুমি আমার জন্য কতটা রিস্ক নিতে পারো? চিন্তা করো না, টাকাটা আমি তোমায় দিয়ে দেব।'
এবার আমার অহংবোধে আঘাত লাগল। বললাম, 'ওই নিয়ে আমি চিন্তা করছি না রুরু। নিজের ক্যাপাসিটি বুঝেই আমি রিস্ক নিয়েছি।'
রুরু আমার খুব কাছে এসে বলল, 'রাগ করলে? প্লিজ রাগ করো না। আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু ক্রিয়েট এনি প্রবলেম ফর ইউ। আফটার অল, ইয়োর প্রবলেম ইজ মাই প্রবলেম। আমার বাবার অনেক ব্ল্যাক মানি আছে। তার কিছুটা খরচ হলে কিচ্ছু যায় আসে না। কিন্তু ধার শোধ করার চাপে তোমার পড়াশোনার যদি ক্ষতি হয় তা হলে আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। আমি অনেক ছেলের সঙ্গে রিসর্টে গিয়ে রাত কাটিয়েছি। বাট আই নেভার ফেল্ট সাচ আ ব্লিস হোয়াট আই ডু টুডে। ইজ ইট লাভ অর্জুন? বলো না--'
মনে হল রুরু আর রুরু নেই। আলো হয়ে গেছে। যে আলোয় জীবনের মুখ দেখা যায়। যদিও আমার সেদিনের মনে হওয়া পরবর্তীতে মেলেনি। কিন্তু সেদিনের কথা বলতে বসে আমি পরের কথা বলব না কুমুদিনী। কারণ সেদিন তিনশো তিপ্পান্ন নম্বর ঘরে স্বপ্নের চিত্রনাট্ট লেখা হয়েছিল। কবিতাও বলতে পারো। আমার কবিবন্ধু ধ্রুব চক্রবর্তী সেই কবিতার ভাষারূপ দিয়েছিলেন--
ভেতরে ঘুম পাড়িয়ে রাখি যাকে
সে কি আমার, সে কি আমার ডাকে
কখনও দেয় সাড়া?
রাত্রি জানে আকাশময় ছড়িয়ে আছে তারা
স্বপ্নে সেতু বেঁধে
চলেছি পথ ভেতরে কেউ ডুকরে ওঠে কেঁদে
সে কি আমার, সে কি আমার নয়
কোথায় যেন হয়েছিল প্রথম পরিচয়?
বাড়িয়ে রাখি হাত
সারা জীবন ভাঙাগড়ায় মেলেনি সাক্ষাৎ
সে কি আমার, সে কি আমার
বুকের খুব কাছে
রক্তপাতে রক্তপাতে দুঃখ হয়ে আছে
(ক্রমশ)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন