আফগানিস্তান আপডেট
মারের বদলা মার, আফগানিস্তানে
ঠিক কতো জঙ্গিকে মারলে আফগানিস্তানের বুকে উপত্যকার শান্তি কায়েম হবে? কিন্তু সেক্ষেত্রে ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হওয়া নিশ্চিত। কারণ আফগানিস্তানে শাসকের কুর্সিতেও একদল জঙ্গি।তালিবান, আইএসআইএস- এই দুই জঙ্গি গোষ্ঠির রেষারেষিতেই বৃহস্পতিবার, কাবুল এয়ারপোর্টে প্রাণ গেছিলো, এপর্যন্ত পাওয়া খবরে একশো তিয়াত্তরজনের। তারমধ্যে ছিলেন তেরোজন মার্কিন মেরিন কমান্ডোর। শুক্রবার তার বদলা নিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। এখানেই যে ঘটনার শেষ নয়, তা স্পষ্ট বাইডেনের কথাতেই। ফের জঙ্গি হামলা চালাতে পারে আইএসআইএস খুরাসান জঙ্গিরা।
জলে কুমির ডাঙায় বাঘ।
অন্তত আফগানিরা তাই বলছেন। আর তাই বৃহস্পতিবার কাবুল এয়ারপোর্টে আইএসআইএস হানার পরেও ভিড় কমার কোনও লক্ষণ নেই। এয়ারপোর্টের ভিড় সরাতে আকাশের দিকে তাক করে থেকে থেকেই গুলিবর্ষণ করে চলেছে তালিবান প্রহরীরা। পথ রুখে দিয়েছে এয়ারপোর্টের। তবু ভারতের সেই অগ্নিযুগের 'দিল্লি চলো'র মতো আফগানিদের মুখেও এখন একটাই শ্লোগান- কাবুল এয়ারপোর্ট চলো। না হয় লাশের স্তূপ ডিঙিয়েই যাবো! তবু যেতে হবেই, তা সে জান কবুল করে হলেও হোক।
ভিড় জমছে একদিকে এয়ারপোর্টে, অন্যদিকে পাক- আফগান সীমান্তের পাকপ্রবেশ পথে। সামনে দুজায়গারই দরজা বন্ধ। কিন্তু পিছোনোর রাস্তা নেই। পিছোলেই তালিবান শাসকের খপ্পরে।
বিশ্ব রাজনীতিতে ইসলামাবাদ আসলে বরাবরই এক 'পাপেট' শক্তিধর রাষ্ট্র। কখনও আমেরিকা কখনও চীন, যেমন নাচায় তেমন নাচে। আবার এই পাকিস্তানের ইশারাতেই নাচে বিশ্বের তাবড় জঙ্গি সংগঠনগুলো।
তালিবানের 'গুরু' পাকিস্তান। টুইটবার্তায় এমনটাই দাবি আফগানিস্তানের স্বঘোষিত ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি আমরুল্লা সালেহর।
শক্তিধর রাষ্ট্রদের শংসাপত্রে তালিবানরা অবশ্য এখন আর জঙ্গি নয়। 'গুড' তালিবান। আফগানিস্তানের নয়া শাসক। কিন্তু নিউটনের তৃতীয় সূত্রের মতোই আফগানিস্তানে তালিবান রাজ কায়েম করার চেষ্টা শুরু হতেই নড়েচড়ে বসেছিল আইএসআইএস। কারণ তাদের পুরনো শত্রুতা। এলাকা দখল নিয়ে দুই মাস্তানের এমনতরো গ্যাং ওয়ার তো আকছার হয়েই চলেছে।
আসলে গতবছর দোহায় যেদিন আমেরিকার সঙ্গে তালিবানরা চুক্তিতে সইসাবুদ করেছিল, সেদিন থেকেই আইএসআইএসের টার্গেট হয়ে গেছিলো তালিবানরা। তাই আফগানিস্তানের তালিবানের ক্ষমতা দখলের পর অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনগুলো যেমন উদ্বাহু নাচ জুড়েছিলো, আইএসআইএস তাতে খুশি হতে পারেনি।
বিশ্ব জুড়ে ইসলামিক স্টেট গঠনের জেহাদ থেকে ক্রমেই সরে আসছে তালিবান। আর তাতে ইন্ধন জোগানোর মূল হোতা আমেরিকা। সঙ্গে পশ্চিমের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো। ঠিক এই কারণেই আইএসআইএস জঙ্গিদের নিশানায় আমেরিকা রাশিয়ার পাশাপাশি তালিবানরাও।
তবে একোনও নতুন কথা নয়। সাল ২০১৫। তখন ইরাক সিরিয়াতে ক্রমেই শক্তি বাড়িয়ে চলেছে আইএসআইএস। ওদিকে ঠিক তখনই আলাদা আলাদা ফ্রন্টে আইএসআইএসের ডানা ছাঁটার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে চলেছিলো আমেরিকা, রাশিয়া। সেসময়েই অনেক আফগান আর পাকজঙ্গিই তালিবানের হাত ছেড়ে, হাত ধরেছিলো আইএসআইএসের। তালিবান দলছুট জঙ্গিদের অভিযোগ ছিলো তালিবানরা প্রকৃত জেহাদি নয়। এরপরেই নিজেদের উৎকৃষ্ট জেহাদি প্রমাণ করতে আইএস জঙ্গিরা বর্বর হামলা চালায় আফগানিস্তানের প্রসূতি সদন, মেয়েদের স্কুলে। গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেয় কয়েকঘণ্টার মধ্যে মা হওয়ার অপেক্ষায় থাকা মহিলাদের।
২০১০ সালেই আমরা ওদের প্রায় নিকেশ করে ফেলেছিলাম। তাঁর বই 'এম্পায়ার অফ ফিয়ার: ইনসাইড দ্য ইসলামিক স্টেট'- এ লিখেছেন বিবিসির সংবাদদাতা অ্যানড্রিউ হস্কেন। ইসলামিক স্টেটের প্রবক্তা আইএস জঙ্গিদের নিয়ে তাঁর আক্ষেপ- '২০১০ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে গড়পরতায় ওই জঙ্গিগোষ্ঠির একশোজন নেতার মধ্যে আশিজনকেই নিকেশ করে ফেলা গেছিলো। কিন্তু আমরা বাদবাকিদের ছেড়ে দিই। আজ তারাই ফিরে এসেছে ক্যান্সারের মতো।'
তবে হক্কানি নেটওয়ার্ক সূত্রে তালিবান আর আইএসআইএসের মধ্যে এক বন্ধনহীন গ্রন্থি আজও বিরাজমান। আমরুল্লা সালেহর টুইটেও তার স্পষ্ট ইঙ্গিত। তাঁর দাবি, খুরাসানের আইএসের সঙ্গে তালিবান যোগের তথ্যপ্রমাণ আছে।
কাবুলের ভেতরে এবং বাইরে যে আইএস শক্তি বাড়িয়ে চলেছে তা কিন্তু আগেভাগেই জানিয়েছিল ইউএন অ্যানালিটিক্যাল সাপোর্ট অ্যান্ড স্যাংসনস মনিটরিং টিম। সতর্ক করা হয়েছিল আফগানিস্তানের বিভিন্ন প্রান্তে আইএসের স্লিপিং সেল তৈরি করা নিয়েও। সুতরাং বৃহস্পতিবারের জোড়া বিস্ফোরণকে কোনও মতেই অপ্রত্যাশিত বলা যথাযথ নয়।
কোনও চুক্তি আপোস নয়। জেহাদই একমাত্র রাস্তা। বিশ্ব জুড়ে এক ইসলামিক স্টেট তৈরি করাই আইএসআইএসের লক্ষ্য। ওই স্টেটের ম্যাপে ঢুকে পড়েছে ভারতের বেশকিছু অংশও। এছাড়াও ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকার পাশাপাশি আছে মধ্যপ্রাচ্যের বেশকিছু জায়গা।
হস্কেন লিখছেন, পৃথিবীর যেখানে যা কিছুতে ইসলামের গন্ধ খুঁজে পাবে, তার সবকিছুই হরপ করাই লক্ষ্য আইএসের।
আইএসের ওই স্বপ্ন বানচাল করতে আলাদা আলাদা ফ্রন্টে নেমে পড়েছিলো আমেরিকা, রাশিয়াও। ২০১৯ সালের মার্চের মধ্যে, আইএস জঙ্গিদের খপ্পর থেকে মার্কিন জোট সেনারা কেড়ে নিয়েছিল মোট বিয়াল্লিশ হাজার বর্গ মাইল ভূখণ্ড। তথ্য আমেরিকার প্রতিরক্ষা বিভাগের সদর দপ্তর পেন্টাগনের।
শুক্রবার মাঝরাতে ড্রোন হামলায় প্রাণ গেছে দুই আইএস জঙ্গির। তবে পেন্টাগনের দেওয়া তথ্য বলছে, ২০১৯ সালের অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় আশিহাজার জঙ্গি নিধন করেছে মার্কিন জোটের সেনা। আরও ষাট হাজার তিনশো আঠারোজন জঙ্গির প্রাণ যায় ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত রাশিয়ার সেনা অভিযানে। তবে ওই জঙ্গিদের সবাই আইএসের ছিলো কিনা তা স্পষ্টভাবে জানানো হয়নি। এতকিছুর পরেও যে আইএসআইএস খুরাসান গ্রুপ জঙ্গিদের দমানো যায়নি, বৃহস্পতিবারের বিস্ফোরণ সেই সত্যই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো।
সেন্ট্রাল কমান্ডের ক্যাপ্টেন বিল আর্বান জানান শুক্রবার মাঝরাতে নাঙ্গরহারে আইএসআইএস জঙ্গির গোপন ডেরায় লক্ষ্যভেদ করেছে আমেরিকার রিপার ড্রোন। মধ্যপ্রাচ্য থেকে উৎক্ষেপন করা ওই ড্রোনের নিশানায় ছিল কাবুল এয়ারপোর্ট বিস্ফোরণের মাস্টারমাইন্ড। হামলার সময় গাড়িতে তার সঙ্গে ছিলো আর এক জঙ্গি। ওই দুজন ছাড়া অন্যকারও মৃত্যু হয়নি।
শনিবার মধ্যরাতের ওই ঘটনার বদলা নিতে আইএস জঙ্গিরা ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে কাবুলে। এই আশঙ্কায় আফগানিস্তানের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নিজেদের জঙ্গিদের কাবুলে সরিয়ে আনছে তালিবান। একদিকে আইএসআইএসের হামলা অন্যদিকে পঞ্জশিরে আহমেদ মাসুদের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আপাতত কপালে চিন্তার ভাঁজ তালিবান জঙ্গি শাসকের।
ওদিকে তালিবান, আইএসআইএস দুই জঙ্গিগোষ্ঠির লড়াইয়ে ঘটনা যেদিকে গড়াচ্ছে, তাতে ভীত সন্ত্রস্ত আফগান নাগরিকরা। আমেরিকা সমেত জি৭ জোটের কর্ণধাররা তালিবান শাসকদের পিঠে হাত রাখলেও, ভরসা রাখতে পারছেন না আফগানিরা। দেশ ছেড়ে পালানোর হিড়িক যতোই বাড়ছে, ততোই বন্দুক উঁচিয়ে পথ আগলে দাঁড়াচ্ছে তালিবান জঙ্গিরা। প্রায় একপক্ষকাল কাটতে চললেও জঙ্গির তকমা ছেড়ে শাসকের ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে পারেনি আফগানিস্তানের তালিবানরা। অগাস্ট ৩১ এর পর আফগানিস্তানের হাল কী দাঁড়ায়, গোটা বিশ্ব এখন সেদিকেই তাকিয়ে।
(কৃতজ্ঞতা স্বীকার: দ্য টেলিগ্রাফ(ইউকে), বিবিসি, হিন্দুস্তান টাইমস)
ছবি সৌজন্যঃ সংবাদ মাধ্যম
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন