রবিবাসরীয় সাহিত্যের দিন প্রতিদিন - সাহিত্যিক সন্দীপ চক্রবর্তীর অন্য ধারার গল্প গাঁথার ধারাবাহিক - " তুহু মম "

 রবিবাসরীয়   ধারাবাহিক 


 আধুনিক বাংলা সাহিত্যের নবীন লেখক সন্দীপ চক্রবর্তী । সন্দীপ লেখেন, নিজের অনুভুতি দিয়ে। সেখানে পাওয়া যাবে নিজেকে খুঁজে। বর্তমানে সন্দীপ একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের অন্যতম ।সন্দীপের  প্রতিটি অক্ষরের মাঝে লুকিয়ে থাকে সমাজের চালচিত্র। প্রতিদিন থাকছে  এই সমাজের কথকতা। একেবারে নতুন এক আঙ্গিক। একেবারে অন্য রকম আখ্যান গাথা  

                 তুঁহু মম / ১৬    


সন্দীপ চক্রবর্তী


প্রকৃতি যখন ঘরের ভেতর চলে আসে তখন চার দেওয়ালের সাজানো নিরাপত্তা অনেকটাই ফিকে হয়ে যায়। মনে হয় একটা পাখি যতটা প্রাকৃতিক, নাগরিক মানুষও তাই। সেদিন এমনটাই হয়েছিল।
আমরা অনেকক্ষণ ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ছিলাম। গঙ্গা এমনিতেই ফুরোয় না। সেদিন যেন আরও অফুরান হয়ে উঠেছিল। কিন্তু গঙ্গা না ফুরোলেও ব্যালকনি ফুরোয়। আর নিজে ফুরিয়ে ফিরিয়ে আনে প্রকৃতির পেলব ছোঁয়ায় মনে মনে বন্য হয়ে ওঠা দুটি মানুষকে।
আমি উড়ন্ত একঝাঁক গাঙশালিখের দিকে চেয়েছিলাম। ওরা গঙ্গার এপার থেকে ওপারের দিকে যাচ্ছিল। রুরু বলল, 'অর্জুন ডু ইউ ওয়ান্ট টু হ্যাভ আ বাথ? আমি কিন্তু স্নান করব।'
'বেশ তো, তুমি আগে সেরে নাও। তারপর আমি যাব।'
রুরু বাথরুমের দিকে চলে গেল। আমি সিগারেট ধরালাম। বোধহয় পাঁচ মিনিটও হয়নি, রুরু ডাকল, অর্জুন, একবার শোনো।'
বাথরুমের সামনে গিয়ে দেখলাম দরজা অর্ধেক বন্ধ। ভেতরে আলো জ্বলছে। জল পড়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছি। মনে হল বাথটবে জল ভর্তি করছে রুরু। জিজ্ঞাসা করলাম, 'কী হল! ডাকছ কেন?'
'ভেতরে এসো৷ আজ আমরা একসঙ্গে স্নান করব।'
কথাটা শুনে একেবারে হতবাক হয়ে গেলাম। রুরুকে স্পর্শ করার, ওকে আদর করার ইচ্ছে আমার যত তীব্রই হোক, একসঙ্গে স্নান করার ভাবনা কখনও কল্পনাতেও আসেনি। হলিউডের ইংরিজি ছবিতে দু'একবার এরকম দৃশ্য দেখেছি বটে, দুটি কবোষ্ণ শরীরের নরম-সরম ভালোবাসা কাশ্মীরি শালের মতো আমাকে অনেকক্ষণ জড়িয়েও রেখেছে হয়তো-- কিন্তু ওই পর্যন্তই। বাবার সৌজন্যে লম্বা আর দোহারা গড়ন পেলেও সেইসময় নিজের শরীর নিয়ে আমার চূড়ান্ত সংকোচ ছিল। বিশেষ করে কারোর সামনে আমাকে নগ্ন হতে হবে, এ কথা ভাবলেই আমি লজ্জায় মরে যেতাম।
কিন্তু সেদিন তো আর জানতাম না যে রুরুও আমার এই লজ্জার কথা জানে। অন্তত অনুমান করতে পারে। আর সেই কারণেই আমার গোপন ইচ্ছেকে নিঃসংকোচ করার জন্য তার এই আয়োজন।
কিছুক্ষণ পর বাথরুমের দরজা পুরোপুরি খুলে গেল। দেখলাম রুরুকে। না কুমুদিনী, রুরুর নগ্নতার বর্ণনা দেওয়ার মতো সুললিত ভাষা আমার জানা নেই। সে বোধহয় কোনও উচ্চমার্গের কবি দিতে পারেন। আমি শুধু এইটুকু বলতে পারি, যে-মেনকাকে দেখে বিশ্বামিত্রের তপস্যাভঙ্গ হয়েছিল, রুরু তার থেকে কোনও অংশে কম নয়। বহুবল্লভা হয়েও রুরু আশ্চর্য রকমের সুন্দর।
মুগ্ধতা কি প্রেমিককে পাথর করে দেয়? ঠিক জানি না। কথাটা বললাম কারণ সেদিন রুরুকে দেখার পর আমি পাথরের মতো হয়ে গিয়াছিলাম। বুকের ভেতর শুনতে পাচ্ছিলাম ঢেউ ভাঙার শব্দ। কতক্ষণ এইভাবে কেটে গিয়েছিল জানি না। সংবিৎ ফিরল রুরুর কথায়, 'কাম অন ইন অর্জুন। টেক মি ইন ইয়োর হ্যান্ড।'
'এখন থাক না রুরু। পরে না হয়--'
'ডোন্ট বি শাই। ইয়োর ম্যাজেস্টি, প্লিজ স্টেপ ইন টু দি হেভেন। আয়াম অল ইয়োরস। ফর টুডে, ফর এভার।'
ভেতরে গেলাম। রুরু নিজের হাতে আমাকে পোশাকের বন্ধন থেকে মুক্ত করল। তারপর আমার বুকে মাথা রেখে ফিসফিস করে বলল, 'মাই বাউন্টি ইজ অ্যাজ বাউন্ডলেস অ্যাজ দা সি, মাই লাভ অ্যাজ ডিপ/ দা মোর আই গিভ টু দি, দা মোর আই হ্যাভ, ফর বোথ আর ইনফাইনাইট।'
শেক্সপিয়ারের রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট। লাইনগুলো আমার বড়ো প্রিয়। যখনই শুনি বা পড়ি মনে হয় আকাশ থেকে গোলাপের পাপড়ি ঝরে পড়ছে। ভালো লাগছিল আমার। বুকের ভেতর ঢেউ ভাঙার শব্দ ক্ষীণ হয়ে আসছিল। চোখের সামনে ভেসে উঠছিল আদিগন্ত এক সমুদ্র। আমার আর কোনও লজ্জা ছিল না। রুরুর মুখটা তুলে ওর ঠোঁটে চুমু খেলাম। আবিষ্ট রুরু চোখ বন্ধ করল। ওর কানে কানে বললাম, 'দোহাই তোদের একটুকু চুপ কর/ ভালোবাসিবারে দে আমারে অবসর।'
তারপর শুরু হল গোলাপি বাথটবের গল্প। তিনটে শাওয়ারই খোলা। বাথটব থেকে উপচে পড়ছে জল। টবের একদিকে মারমেডের মতো হাতদুটো ছড়িয়ে বসে আছে রুরু। আর অন্যদিকে গ্রিক রূপকথার প্রেমিক অর্ফিয়ুসের মতো আমি--মুগ্ধ এবং একা। রুরুর বুকের আগুনরঙা দুই রাজহংসী তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কী যেন বলতে চাইছে ওরা। আমি ওদের মুঠোয় নিলাম। তিরতির করে কেঁপে উঠল ওরা। যেন ওরা এরকম স্পর্শ আগে কখনও পায়নি। যেন ওরা আমার জন্যেই অপেক্ষা করছিল। যেন আমার আঙুলের ফাঁকেই বন্দি ছিল ওদের আকাশ। আকাশ পেয়ে তাই ওরা এখন আমার মুঠোর ভেতর উড়ছে। উড়ে যাচ্ছে আরও দূর কোনও আকাশে।
তীব্র ভালোলাগায় মাখনের মতো গলে যাচ্ছিল রুরু। বললাম, 'আজ থেকে এরা আমার রাজহংসী!'
'রাজহংসী! সোয়ানস? নাইস নেম। বাট সোয়ানস ওয়ান্ট ইয়োর স্মুচেস অর্জুন। টেক দেম ইনটু ইয়োর মাউথ।'
আমার অনভিজ্ঞ মন চমকে উঠল। বললাম, 'না না, তাতে তোমার ব্যথা লাগতে পারে।'
রুরু হেসে বলল, 'মেয়েদের আনন্দ ওই ব্যথাতেই। তুমি ওসব বুঝবে না। ইউ জাস্ট কান ইনসাইড মি অ্যান্ড ডেসট্রয়।'
সেদিন রুরুর মুখে ডেসট্রয় শব্দটা শুনে আমি চমকে উঠিনি। কারণ আমি সেদিন আটকে গিয়েছিলাম রুরুর শরীরী মূর্চ্ছনায়। আটকে গিয়েছিলাম আরবান হয়ে ওঠার উচ্চাকাঙ্ক্ষায়। ধরেই নিয়েছিলাম র্যাডিসন ফোর্টের তিনশো তিপ্পান্ন নম্বর ঘরে যা হচ্ছে সেটাই সত্যি। ব্যালকনি সত্যি। শেক্সপিয়ার সত্যি। রবীন্দ্রনাথ সত্যি। গোলাপি বাথটব সত্যি। কিন্তু না কুমুদিনী। এসব কিছুই সত্যি নয়। সিনেমার ড্রিম সিকোয়েন্সের মতো এগুলো প্রত্যেকটা ইলিউশন। ইউটোপিয়াও বলতে পারো। সত্যি ছিল ওই ডেসট্রয় শব্দটার মধ্যে। কারণ যে ডেসট্রয় হতে চায় সে ডেসট্রয় করতেও পারে। আর তার প্রমাণ রুরু পরবর্তীকালে অনেকবার দিয়েছে। গোলাপি বাথটবের কথা ও বেশিদিন মনে রাখেনি। আমাকেও মনে রাখতে দেয়নি।
(ক্রমশ)
May be an image of nature and tree

মন্তব্যসমূহ