রবিবাসরীয় বেহালার দিন প্রতিদিন বিশেষ - লিখছেন কাজল ভট্টাচার্য - ভালো থেকো

 বেহালার দিন প্রতিদিন বিশেষ 

ভালো থেকো




- কাজল ভট্টাচার্য 

(এক বন্ধুর সুস্থতা কামনায় লিখলাম।)

মহানগর স্মৃতির নগরী।
মিছিল নগরী না, মৃতের নগরীও না। স্মৃতির নগরী।
শহরটা কেমন যেন ধীরে ধীরে বদলে গেলো। ছিলো যৌবনের বারাণসী। হয়ে গেলো প্রবীণের
নালন্দা। জাদুনগরী।
নাকি আমিই বদলে গেলাম? সেই আয়ুব বাচ্চুর গানের মতো- কীভাবে এতো বদলে গেছি এই আমি!

শহরের কত জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে কত নাম।
নামগুলোই আছে। মানুষগুলো নেই।
এই শহরটার বুকও বোধহয় ছাপ্পান্ন ইঞ্চির। সুবিশাল। সেই বুকের কোথায় কে লুকিয়ে পড়েছে কে জানে। আগে সবার কথা এতবেশি মনে পড়তো না। আজকাল পড়ে।

বয়স হলেই বোধহয় এমনটা হয়। জীবনের স্রোতে ভাটির টান। জল পেছন দিকে সরছে। পলি বেরিয়ে পড়ছে। আগে জলের স্রোত ছিলো। যাওয়া ছিলো আসাও ছিলো। স্রোতে ভাসাও ছিলো। এখন ডিঙা ভাসাতেও কেমন যেন এক অনিচ্ছা। 

খুঁজে বেড়াই সেই চেনা মুখগুলো। সিগন্যাল দেখে ধীর পায়ে রাস্তা পেরোই। কতোই না রাস্তা পেরিয়ে এলাম। শীত গ্রীষ্ম বর্ষা বসন্ত সব। আচমকাই থেমে গেছি কোনও মুখ দেখে। মনের ভেতর টুং টাং। আমায় দেখে সেই মুখ থামেনি। বুঝতে পারি মনও আজকাল ভুল করে বসছে।
আর ঠিকটাই বা করলো কবে? মুখ দেখে মানুষ চিনতে বরাবরই ভুলভাল করে ফেলেছে মন। অতিথির মুখ দেখে ভেবে বসেছে আত্মীয়। যেদিন সেই আত্মীয় চলে যাওয়ার জন্য ব্যাগ গোছালো, সেদিন সন্দেহ হলো। হুড়মুড়িয়ে মাথার ওপর ভেঙে পড়লো গোটা ছাদটাই। নিমেষে ছত্রখান সংসার। ভেঙে খানখান স্বপ্নের ডেরা। যাওয়ার আগে বলে গেলো- অতিথিরা চলে যাওয়ার জন্যই আসে। 

এরপর আর কোনও অতিথিকে আমন্ত্রণ জানাইনি। ভয় পেয়েছি। পেয়ে হারানোর মতো যন্ত্রণা সইবার শক্তি আজ আর একটুও নেই। অতিথির থেকে দূরে থেকেছি, আত্মীয়ের থেকেও দূরে রয়েছি। কেউ নেই। একেবারে একা রয়ে গেছি। এত বিশাল শহরটাতে আমি একা।

মন ছটফট করলেই বেরিয়ে পড়েছি। শুধু ঘুরে বেরিয়েছি শহরের রাস্তা থেকে রাস্তায়। হাত ধরে কতো জুটির আনাগোনা। লোভির মতো তাকিয়ে থেকেছি তাদের দিকে? চোখে চোখ পড়তেই মাথা নীচু করে পালিয়ে বেঁচেছি। হাত দিয়ে খামচে ধরেছি বাঁ দিকের বুকটা। বুকের ভেতরে কী অসহ্য এক টনটন। কেউ তার খবর রাখেনি।



পালিয়েই বা যাবোটা কোথায়? ময়দানে চিৎ হয়ে শুয়ে থেকেছি। ওপরে আকাশ সামিয়ানা। আচমকাই যেনো মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে তহমিনা। 
- কী দেখছো, অমন একমনে?
- আকাশ। কী গভীর দেখেছো তহমিনা?
- আমার চোখে তোমার আকাশ ধরা দেয় না নীলাঞ্জন?
- দেয় তহমিনা। দেয়।
এরপর এক আকাশ শুধুই তহমিনা। ময়দান থেকে সোজা চোঁচাঁ দৌড়। ভিক্টোরিয়ার গেট ছুঁয়ে সেন্ট পল'স ক্যাথিড্রাল চার্চ। সেখানে দাঁড়িয়ে কঙ্কনা।
- কীরে অমন ছুটছিলি কেন?
হাঁপিয়ে গেছি। শ্বাসের ওপর শ্বাস উঠছে। গলাটা শুকিয়ে কাঠ। 
- জলের বোতলটা দিবি? 
বলত গিয়েই দেখি কঙ্কনা নেই। কোথায় যেন হারিয়ে গেলো সেই বড়োবড়ো চোখের রোগা মেয়েটা কঙ্কনা।
ধপ করে বসে পড়ি। আশপাশের মানুষজন দেখছে। কারুর চোখে জিজ্ঞাসা, কারুর কৌতূহল। আবার অনেকেই এগিয়ে যায়। ফিরেও তাকায় না। ভাবলেশহীন মুখ।

- দেবো নাকি চা? 
জিজ্ঞেস করে মুক্তমঞ্চের সামনের চা দোকানি। কানে শোনে কম। তবে সবকিছুই ধরে ফেলে ঠোঁট নাড়া দেখে।
আরে একোথায় এলাম? চার্চটা কোথায় গেলো? চোখ ঘোরাতেই চোখে পড়লো গুরুদোয়ারা। চেতলার মোড়ের মাথায়। এবার সাফ হয়ে এলো মাথাটা। আরে, এতো রাসবিহারী। রেলিং ধরে উঠে দাঁড়ালাম। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম গুরুদোয়ারার ওপরের আকাশের দিকে। সাদা মেঘের সাম্রাজ্য। কেউ প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াচ্ছে। আবার কেউ শুঁয়োপোকার মতো গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে চলেছে। ওদিকে একখণ্ড মেঘ দুরন্ত এক্সপ্রেসের মতো উড়ে চলেছে। কেমন যেন বেতালা। 

- বল তো, ওই মেঘটা কোথায় উড়ে চলেছে? 
বিচিত্রা জিজ্ঞেস করতো। 
আমি বলতাম- ছাতিমতলা হয়ে কোপাইয়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে। 
সেরাতে মেঘ হয়ে বিচিত্রা ঝরে পড়েছিল আমার বুকে।
চা নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে দোকানি।
চায়ে চুমুক মারতেই প্রশ্ন- চিনি ঠিক আছে তো?
মাথা ঝাঁকিয়ে জানালাম ঠিক আছে।
- এত মনে রাখেন কীভাবে? কতো লোককেই তো রোজ চা খাওয়ান। তবু ভুল করেন না, কার চায়ে ক'চামচ চিনি?
- মনে রাখতে হয় না। মুখ দেখলেই মনে পড়ে যায়।
লাখকথার এক কথা- মনে রাখতে হয় না। মনে পড়ে যায়।
ছোপলাগা দাঁতের হাসিও যে এতো নিষ্পাপ হয়, সেদিন ওই চা দোকানির হাসি না দেখলে জানা হতো না।

চা খেয়েই একটা সিগারেট ধরাই। সিগারেটে টান মাড়তেই বুঝতে পারি, বুকের ভেতরটা তখনও মুণ্ডুহীন পাঁঠার মতো ধড়ফড় করছে। কষ্ট হচ্ছে কলকাতার বাতাস থেকে বুকে অক্সিজেন ভরে নিতে। 
'এই পথেই জীবন। এই পথেই মরণ আমাদের।' 
কে যেন গানটা গেয়েছিলো? ভাবতে ভাবতেই হাঁটা শুরু করি। ধীর পায়ে। গন্তব্যে পৌঁছতেই হবে। এবার কোথায়? টলিগঞ্জ। সাবওয়ের মুখে সিঁড়িতে বসবো। অপেক্ষা করবো নুপূরের। জানি, ও আসবে না। আসার কথাও দেয়নি। তবু পথ চেয়ে থাকবো। নুপূর না এলেও, ওর স্মৃতি তো আমার জন্য অপেক্ষা করছেই। চশমার ভেতর দিয়ে ওর সেই হিমশীতল চোখের চাওয়া। আমি যতোই রেগে যেতাম, ও ততোই শান্ত হয়ে যেতো। এখনও তাড়া করে বেড়ায় ওর সেই চোখ। 
এই টলিগঞ্জ মেট্রো স্টেশন থেকে বেরনোর সময় নুপূর বলে গেছিলো- অতিথিরা আসেই চলে যাওয়ার জন্য।


কার অপেক্ষায় আজও টলিগঞ্জ মেট্রো চত্বরে ঘুরে বেড়াই? অনেকেই চিনে ফেলেছে আমাকে। জিজ্ঞাসু চোখে তাকায়। আমিও আমাকে জিজ্ঞেস করে বসি। কাকে খুঁজে বেড়াই উন্মাদের মতো? নুপূরকে, নাকি আমাকেই। 
নুপূর, বিচিত্রা, শম্পা, এণাক্ষী, ময়ূরী- ওরা সবাই গায়ে গা লাগিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। জ্বলে ওঠে ওদের চোখ । মুচকি হাসে। নুপূর চশমাটা নামিয়ে একবার মুছে নেয়। চোখে চোখ মিলিয়ে তাকিয়ে থাকে। যেন চির অচেনা কেউ।
- কিরে কিছু বলবি?

জীবনে এতো মুখের ভিড় বাড়াতে নেই। স্মৃতির ভার বড্ড বেড়ে যায়। মুখের ভিড়ে মুখগুলো কেমন যেন সব ঝাপসা হয়ে আসে। বদলে যায় মুখগুলো। ভীষণ অচেনা লাগে একেক সময়।
- 'কেমন করে এতো অচেনা হলে তুমি!' 
আবার চোখ বুজলেই সব স্পষ্ট। মোবাইল ফোনের রিস্টার্টের মতো। 
মধ্যেমধ্যে মনে হয়, হয়তো ওদের কাউকেই আমি খুঁজি না। আসলে ওদের মধ্যেই খুঁজে বেড়াই আমার সেই ফেলে আসা আমিকে?

শহরটা আজ স্মৃতির শহর। জলে স্থলে আকাশে বাতাসে ময়দানে স্মৃতির চরে বেড়ানো।
আমার মহানগর জুড়ে আজ শুধুই আমার স্মৃতির সমাধি। যেখানেই যাই, আজ সমাধি আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে।
বেলা ঘনালো। এবার আমিও হয়তো এই শহরটার স্মৃতিতে একচিলতে জায়গা করে নেবো।



চিত্র সৌজন্যঃ সংগৃহীত 

মন্তব্যসমূহ