বেহালার দিন প্রতিদিন আফগানিস্তান বিশেষ - ৬ সাংবাদিক কাজল ভট্টাচার্যের কলমে

 আফগানিস্তান আপডেট 

আফগানিস্তানে বিস্ফোরণের পর নীরবতাও সমান ভয়ঙ্কর 



- কাজল ভট্টাচার্য 

'হামলার মূল্য চোকাতে হবে জঙ্গিদের।'
১৫ অগাস্ট তালিবান জঙ্গিদের আফগানিস্তান দখলের পর সম্ভবত এই প্রথম হুমকি দিলেন জো বাইডেন। আইএসআইএস জঙ্গিদের ওপর জবাবী হামলা চালানোর জন্য প্রস্তুত হতে সেনাকে নির্দেশ দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।

চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে। 
কিন্তু চোর যখন জঙ্গি, তার পালানোর জন্য অপেক্ষা করে কেন বসে রইলেন বাইডেন? গুপ্তচর সংস্থার রিপোর্টে তিনি তো আগেভাগেই জেনে ফেলেছিলেন, জঙ্গি হামলার ছক কষা হচ্ছিলো। বারেবারে আফগানিস্তানে বসবাসকারী মার্কিন নাগরিকদের সতর্ক করেই তিনি কীভাবে গালে হাত দিয়ে বসে থাকলেন? নাকি তাঁর ভরসা ছিলো তালিবান শাসকরূপী জঙ্গিবাহিনী? মৃত কমান্ডার, নাগরিকরা প্রেসিডেন্টকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেলেন, তালিবান জঙ্গিদের ওপর ভরসা করা যায় না। জঙ্গিরা জঙ্গিপনায় ওস্তাদ। সুরক্ষা দেওয়ার বিদ্যা তাদের আয়ত্তে নেই। 

বধ্যভূমি আফগানিস্তান।
এক তালিবানেই প্রাণ ওষ্ঠাগত, তার ওপর এবার আইএসআইএস। দুই জঙ্গি গোষ্ঠীর সম্মুখসমরেই বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়, তীব্র বিস্ফোরণে জঙ্গি নৃশংসতার সাক্ষী হলো আফগানিস্তান।
প্রাণ গেলো তেরোজন মার্কিন মেরিন কমান্ডারের। নিহতের সংখ্যা এখন পর্যন্ত কমবেশি একশো। জখম দেড়শো। যারমধ্যে মার্কিন সেনাও আছে বলে খবর।

আইএসআইএস বিস্ফোরণের তীব্রতায় কেঁপে উঠেছে আমেরিকাও। মুখ খুলতে বাধ্য হয়েছেন জো বাইডেন। আমেরিকার ওপরেও তীব্র বিদ্বেষ জমে আছে আইএসআইএস জঙ্গি গোষ্ঠির। দুই শত্রুর থেকে বদলা নিতেই কাবুল এয়ারপোর্টে বিস্ফোরণের ছক কষেছিল আইএসআইএস- এর খুরাসান গ্রুপ। বৃহস্পতিবারের ওই ঘটনাই যে শেষ নয়, তার আশঙ্কা ইতিমধ্যেই প্রকাশ করেছে আমেরিকার প্রতিরক্ষা বিভাগের সদর দপ্তর পেন্টাগন। বিস্ফোরণের পাশাপাশি হামলার ছক পাল্টে ফের ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে আইএসআইএস।

বিস্ফোরণের জন্য কাবুল এয়ারপোর্টের গেট, ব্যারন হোটেল সংলগ্ন জায়গাকেই কেন বেছে নিলো আইএসআইএস জঙ্গিরা?
কারণ একঢিলে দুই পাখি মারতে চেয়েছিলো আইএসআইএস। নৃশংসতায় এই জঙ্গিরা তালিবানদেরও টেক্কা দেয়। কাবুল এয়ারপোর্টের ভেতরের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলো মার্কিন সেনা। বাইরের নজরদারিতে ছিলো তালিবান বাহিনী। তারওপর ওই চত্বরের উপচে পড়া ভিড়। মৃতের সংখ্যা যতো বেশি, আইএসআইএস হামলার গুরুত্বও ততো বাড়ে। একইসঙ্গে দুই চিরশত্রু আমেরিকা আর তালিবানের থেকে বদলা নেওয়ার এমন সুবর্ণসুযোগ হাতছাড়া করতে চায়নি আইএসআইএস। তাই তাদের নিশানায় চলে এসেছিলো কাবুল এয়ারপোর্ট।


ওই সমীকরণেই প্রথম বিস্ফোরণের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল কাবুল এয়ারপোর্টের পূর্ব দিকের 'অ্যাবে' গেটের সামনে উপচে পড়া ভিড়। সন্ধ্যা ছ'টা পাঁচ নাগাদ তীব্র বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে গোটা এলাকা। তারপর পনেরো মিনিট কাটতে না কাটতেই দ্বিতীয় বিস্ফোরণ। বিমানবন্দরের সামনেই ব্যারন হোটেলের সামনে। ওই হোটেলেই ব্রিটিশ আর্মির জওয়ানরা ডেরা গেড়েছিল বলে খবর। রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ ফের তৃতীয় বিস্ফোরণ ওই চত্বরেই।
নিরীহ মানুষের রক্তে হোলি খেলে তালিবান শাসকের গায়ে রক্তের ছেঁটা লাগাতে চাইলো আইএসআইএসের নৃশংস জঙ্গিরা। টার্গেট তালিবান শাসক। প্রাণ গেলো নিরীহ নাগরিকের। একইসঙ্গে বিস্ফোরণের আড়ালে শোনা গেলো তীব্র আমেরিকা বিদ্বেষের গর্জন। তালিবানের মতোই আইএসআইএস জঙ্গিদের পুরনো শত্রুতা আমেরিকার সঙ্গেও।

সময় থাকতেই বাইডেনকে সতর্ক করেছিল গুপ্তচর সংস্থা। বাইডেন সেই সতর্কবাণী নাগরিকদের শুনিয়েই নিজের কর্তব্য সমাধা করেছিলেন। একই রাস্তায় হেঁটেছিলেন ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, ইতালির মতো আমেরিকা ঘনিষ্ঠ জি৭ রাষ্ট্রনায়করা। নিজেদের দেশের নাগরিকদের নিরাপদে রাখার দায়িত্ব ছেড়ে রেখেছিলেন 'গুড' তালিবানের হাতে। 

শুধুমাত্র কাবুল ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের ভেতরের অংশই ন্যাটো সেনা জওয়ানদের দখলে। সেখানে জঙ্গিরা ঢুকতে পারেনি। বাইরে গোটা আফগানিস্তানের দখল তালিবানের হাতে। জঙ্গিরা জঙ্গি আক্রমণ চালাতেই দক্ষ। সুরক্ষার কাজ যে তাদের হাতে তুলে দিলে চলে না, বৃহস্পতিবারের বিস্ফোরণের ঘটনা তারই প্রমাণ।
বাইডেন বা জি৭ কর্তারা এই সহজ সত্যটাও বুঝেও না বোঝার ভান করেছিলেন। আর তাই আমেরিকা, ব্রিটেনের অ্যালার্ট জারির পরেও আইএসআইএসের হামলাবাজি থেকে নিরীহ নাগরিকদের বাঁচাতে পারলো না আফগানিস্তান জুড়ে দাপিয়ে বেড়ানো তালিবানের বন্দুকবাজরা। তাদের যতো গর্জনতর্জন সব নিরীহ নাগরিকদের ওপরেই। যার পরিণামে বিস্ফোরণের বলি হতে হলো নিরীহ নাগরিকদের। যারমধ্যে আছেন তেরোজন মার্কিন মেরিন কমান্ডার। এবার কী জবাব দেবেন প্রেসিডেন্ট?
পাক্কা রাজনীতিবিদরা যা করেন, বাইডেনও তাই করেছেন। আইএসআইএসকে শায়েস্তা করতে কসুর করবেন না বলে কথা দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে যা হলো সেই প্রশ্নের কী জবাব দেবেন প্রেসিডেন্ট? 

আইএসআইএস, তালিবান দুই জঙ্গি গোষ্ঠির জঙ্গিপনায় মিল থাকলেও, জঙ্গি মতাদর্শের অমিলটাও ব্যাপক। মূলত সুন্নি সম্প্রদায়ের এই জঙ্গিদের মধ্যে ফারাক আছে শরিয়ত আইনের ব্যাখ্যাতেও। মহিলারা নিছকই যৌনকাজে ব্যবহৃত এক বস্তু ছাড়া আরকিছুই না। এমনটাই ভাবে আইএসআইএস। অতীতে মহিলা হাসপাতাল গুড়িয়ে দেওয়ার মতো নারকীয় ঘটনার নজির রেখেছিল এই জঙ্গিগোষ্ঠি।

এই নারকীয় ঘটনার পর বিদেশি নাগরিকদের আফগানিস্তান থেকে বার করে আনার কাজটা যে আরও জটিল হয়ে দাঁড়ালো, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। বিদেশীরা সবাই কাবুলে আছেন এমনটাও নয়। তাঁদের অনেকেই কাবুল থেকে দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। সেখান থেকে কাবুল এয়ারপোর্টে পৌঁছনো সহজ কথা নয়। রাস্তায় গাড়ি চলাচল বন্ধ। আবার যদি গাড়ির বন্দোবস্ত করা গেলো তো রাস্তায় প্রতি পদে তালিবানের খবরদারি। বিদেশি নাগরিকরা আদৌ বিমানবন্দরের দিকে এগোতে পারবেন কিনা তার গোটাটাই নির্ভর করছে তালিবান জঙ্গিদের মর্জির ওপর। 

কয়েকদিন ধরেই আবার আমেরিকা, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলো তাদের নাগরিকদের বারবার বলছিলো কাবুল এয়ারপোর্ট থেকে দূরে থাকতে। এতদিন যা ছিলো আশঙ্কা, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তিনটি বিস্ফোরণের পর তা সত্য বলে প্রমাণিত হলো। সবমিলিয়ে পরিস্থিতি যেন শাঁখের করাত। এগোলে আইএসআইএসের বিস্ফোরণ পেছোলে তালিবানের বন্দুকের ভয়। আর সবশেষে ৩১ অগাস্টের ডেডলাইন।


ওদিকে কাবুল এয়ারপোর্টের বিকল্প হতে পারতো কন্দাহার। কিন্তু সে গুড়ে বালি। কারণ কন্দাহার এয়ারপোর্ট তালিবানের দখলে।
এবার কী করবেন বাইডেন? জঙ্গি হামলার বলি মেরিন কমান্ডোর ঘটনায় কোন তত্ত্বের অবতারণা করবেন মার্কিনিদের কাছে? আফগানিস্তান ক্রমেই গলার ফাঁস হয়ে চেপে বসছে আমেরিকার।

এতকিছু ঘটার পরেও শুক্রবার সকাল পর্যন্ত মুখে কুলুপ তালিবানের পরমমিত্র পাকিস্তানের মুখে। আফগানিস্তানকে কোনও মতেই জঙ্গিঘাঁটি করে তোলা যাবে না। সতর্ক করেছিলেন বেজিং কর্তারা। 
তথাকথিত আন্তর্জাতিক সমুদায়, মানবাধিকার কর্মীরাই বা কী বলেন?
আফগানিস্তানে বিস্ফোরণের পর বিশ্ব জুড়ে এই অখণ্ড নীরবতাও কিন্তু মারাত্মক রকমের ভয়ঙ্কর।

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন