রবিবাসরীয় সাহিত্যের দিন প্রতিদিন - সাহিত্যিক সন্দীপ চক্রবর্তীর অন্য ধারার গল্প গাঁথার ধারাবাহিক " তুহু মম "
রবিবাসরীয় ধারাবাহিক
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের নবীন লেখক সন্দীপ চক্রবর্তী । সন্দীপ লেখেন, নিজের অনুভুতি দিয়ে। সেখানে পাওয়া যাবে নিজেকে খুঁজে। বর্তমানে সন্দীপ একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের অন্যতম ।সন্দীপের প্রতিটি অক্ষরের মাঝে লুকিয়ে থাকে সমাজের চালচিত্র। প্রতিদিন থাকছে এই সমাজের কথকতা। একেবারে নতুন এক আঙ্গিক। একেবারে অন্য রকম আখ্যান গাথা
তুঁহু মম / ১৩
সন্দীপ চক্রবর্তী
সেদিনের পর থেকে বৃষ্টিতে বৃষ্টিতে বেসামাল এক নদী আমার মনের ভেতর ঢুকে পড়ল। তাকে আমার কখনও চেনা লাগে, কখনও অচেনা। তার অনেক কথা শোনার পর মনে হয় যেন বুঝেছি কিন্তু রাতে হোস্টেলের বিছানায় যখন তার কথাগুলো নিয়ে আলতো মনে নাড়াচাড়া করি তখন বুঝতে পারি, বুঝিনি। সে চেনা হয়েও অচেনা। বুঝ আর অবুঝের মাঝখানে দুর্বোধ্য এক কবিতার মতো। তার একফালি হাসি, চোখে-চোখে ক্ষণিকের চাওয়া, পুরুষের মুগ্ধতাকে নিদারুণ অবহেলায় বিদ্ধ করে আপন খেয়ালে এগিয়ে যাওয়া-- আমার ভালো লাগত। কিন্তু ভালো লাগা অনেক দূরের ব্যাপার। মাঝ আকাশের নক্ষত্রের মতো। সে দিকহারানো মাঝির কম্পাস হতে পারে কিন্তু ঘর হবে কী করে! তাকে কি আমি কোনওদিন মাঝরাতের বৃষ্টি থেকে, গোয়ালিয়র মনুমেন্টের সিঁড়ি থেকে ঘরে ফিরিয়ে আনতে পারব? সে কি কোনওদিন মেঘ-রঙা বালুচরি পরে মোমবাতির আলোয় আমার সামনে এসে দাঁড়াবে?
জীবনের প্রথম প্রেম। কিন্তু অনিশ্চয়তায় ভরা। তখনই রুরুর অজস্র প্রেমিক। জেভিয়ার্সের ছেলেরা তো বটেই, প্রেসিডেন্সির ছেলেরাও রুরুকে ঘিরে থাকত। এমনকী অনেক প্রোফেসারও ওকে বিশেষ নজরে দেখতেন। এদের তুলনায় আমি তো কিছুই না। মফস্বল শহর থেকে আসা একটি হাঁ-করা ছেলে। বাবা-মা'র সৌজন্যে চেহারাটি মন্দ নয়। কৃষ্ণনগরের মেয়েরা রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে আমাকে দেখে হঠাৎ উচ্চকিত হাসিতে তাদের দেখাটিকে মুছে দেবার আগে দু'এক কলি মুগ্ধতাও ছড়িয়ে দিয়ে যেত। কিন্তু জেলাশহরের মুগ্ধতা কলকাতায় অচল। তাই ভালোবাসার কথা প্রকাশ করতে না পেরে হীনমন্যতায় ভুগতাম। মাঝে মাঝে রাগও হত। কেন আমি কলকাতার ছেলেদের মতো নয়? কেন আমি ভালো কথা বলতে পারি না? নিজের ওপর সৃষ্টিছাড়া রাগ ছাড়া তখন আমার আর কিছু ছিল না।
আর রুরু? ও যেন আমার অক্ষমতাকে আরও উলঙ্গ করার জন্য আমার আরও কাছে আসার নেশায় মেতে উঠেছিল। কথাটা হয়তো শুনতে খারাপ। কিন্তু একশো শতাংশ সত্যি। অন্তত তখন আমার তাই মনে হত। রুরুর সান্নিধ্য আমার ভালো লাগলেও মনে মনে বলতাম, 'তুমি আর এসো না। আমি তো কোনওদিনই তোমাকে কথাটা বলতে পারব না। আর বলতে না পেরে কষ্ট পাব সারাদিন। এই আমার ডেস্টিনি। ভুলে যাও তুমি আমাকে। আর এসো না।'
আমার এই মন তুমি তো ভালোই বুঝবে কুমুদিনী। কলকাতায় তোমার মুখে একটা গল্প শুনেছিলাম। তোমার প্রথম প্রেমের গল্প। তখন তুমি ক্লাস নাইনে। ইংরিজির টিচার দেবতনুবাবুকে ভালো লেগেছিল তোমার৷ কিন্তু তুমি সে কথা তাকে বলতে পারোনি। আমাদের মতো লাজুক মুখচোরাদের জীবনে এরকমই কি হয় কুমুদিনী? আমাদের কথাগুলো শিউলির মতো সন্ধ্যেবেলায় ফুটে সারারাত গন্ধ ছড়িয়ে ভোরবেলায় ঝরে যায়। তারপর তাদের আর দাম থাকে না।
অথচ তোমার-আমার এই টানাপড়েনের ছিটেফোটাও আমি রুরুর মধ্যে কখনও দেখিনি। জীবনের সবকিছুতেই ওর মজা চাই। সবকিছুই ওর কাছে খেলা। আমার সঙ্গেও এমনই এক খেলা ও খেলত। কীরকম জানো? ওর অসংখ্য গুণমুগ্ধের কথা তো তোমাকে বলেছি। যতক্ষণ রুরু আমার সঙ্গে থাকত ততক্ষণই ওর অন্য পুরুষবন্ধুদের সম্বন্ধে কথা বলে যেত। বিশেষ করে অমল যোগলেকরের কথা। অমল মরাঠী ছেলে। কলকাতার জেভিয়ার্সে পড়ে। রুরু ওর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। অমল ক্লাসে ভালো, ক্যান্টিনে ভালো, কলেজের ড্রামায় ভালো--- এমনকী, বিছানাতেও ভালো! ফাদার গ্যাব্রিয়েলের ক্লাসে অমল যখন রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট থেকে আবৃত্তি করে তখন নাকি রিচার্ড বার্টনের কথা মনে পড়ে যায়। বিছানায় অমল যখন রুরুকে আদর করে তখন ওর নাকি শঁ কোনারির কথা মনে পড়ে যায়। অমলের সম্বন্ধে একটি বিশেষণই উপযুক্ত। হি ইজ ওয়াইল্ড---ওয়াইল্ড---অ্যান্ড ওয়াইল্ড। হি ক্যান স্যাটিসফাই আ উওম্যান অ্যান্ড দ্যাট ইজ দা বেস্ট কোয়ালিটি অফ আ ম্যান৷
আমার অসম্ভব রাগ হত। তুলনা জিনিসটা আমি পছন্দ করি না। আমি আমার মতো। আমার সঙ্গে কেন অন্য কারোর তুলনা করা হবে? কিন্তু যে ছেলে অনুরাগের কথা বলতে পারে না, সে রাগের কথাই বা বলবে কী করে! আমার অভিমান করাই সার। রুরু অবশ্য আমার রাগ-অভিমান নিয়ে মাথা ঘামাত না। শুধু একদিন ছবিটা পালটে গিয়েছিল। সেদিন রুরু একটু গম্ভীর। আমরা পার্ক স্ট্রিট দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সোজা চলে গেছি গিগলসে। তখন গিফট শপ ছাড়াও ওদের একটা রেস্তোরাঁ ছিল। আমরা বসেছি দু'কাপ কফি নিয়ে। হঠাৎ রুরু বলল, 'আমি এত যে তোমাকে অমলের কথা বলি, তোমার ঈর্ষা হয় না? অন্য কেউ হলে এতদিনে হয় আমাকে নয়তো অমলকে খুন করে ফেলত। কিন্তু তুমি তো তুমি! ভদ্রলোক ছাড়া জীবনে কিছু হতেই পারলে না!'
অনেকদিনের চাপা অভিমান একদিন ঠিক তার প্রকাশের পথ খুঁজে নেয়। মানুষ যা আড়াল করতে চায় তা-ই সে কোনও অসতর্ক মুহূর্তে বলে ফেলে। আমিও সেদিন কথাটা বলেই ফেলেছিলাম।--'আমি অন্যরকম হলে তোমার ভালো লাগবে?'
'অফকোর্স। আই ওয়ান্ট টু সি ইউ লাইক মি। ওয়াইল্ড অ্যান্ড ডেনজারাস। অর্জুন ইফ ইউ ক্যান কিল রুরু--দেন হোয়াই ইউ বদার টু লাভ হার?'
এমন অদ্ভুত কথা কখনও শুনিনি। কিন্তু কথাটা বুকের এমন জায়গায় এসে বাজল যে মনে হল আমি পারি। আমি পারব। মনে পড়ে গেল নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতার দুটো লাইন।--'একদিন ঠিক পালটে যাব/দেখে রাখিস তোরা/বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়ল/অশ্বমেধের ঘোড়া।'
রুরুকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আমি হোস্টেলে ফিরে গেলাম। সেই রাতটা এখনও আমার মনে আছে। সারারাত দু'চোখের পাতা এক করতে পারিনি। বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল মায়ের মুখ। মা জিজ্ঞাসা করছিল, 'তুই পালটে যাবি অজু? তুই আর আমার অজু থাকবি না?' সে বড়ো কষ্টের সময় কুমুদিনী। কারণ সত্যি কথা বললে মা দুঃখ পাবে আর মিথ্যে কথা বললে রুরু দুঃখ পাবে। না, কোনওটাই আমি পারব না। তার চেয়ে এই টানাপড়েন ভালো। এই আত্মদহন ভালো। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে মা চলে গেল। মনে হল আমি দ্বিতীয়বার মাতৃহারা হলাম।
(ক্রমশ)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন