রবিবাসরীয় সাহিত্যের দিন প্রতিদিন - সাহিত্যিক সন্দীপ চক্রবর্তীর অন্য ধারার গল্প গাঁথার ধারাবাহিক " তুহু মম "

 রবিবাসরীয়   ধারাবাহিক 


 আধুনিক বাংলা সাহিত্যের নবীন লেখক সন্দীপ চক্রবর্তী । সন্দীপ লেখেন, নিজের অনুভুতি দিয়ে। সেখানে পাওয়া যাবে নিজেকে খুঁজে। বর্তমানে সন্দীপ একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের অন্যতম ।সন্দীপের  প্রতিটি অক্ষরের মাঝে লুকিয়ে থাকে সমাজের চালচিত্র। প্রতিদিন থাকছে  এই সমাজের কথকতা। একেবারে নতুন এক আঙ্গিক। একেবারে অন্য রকম আখ্যান গাথা  

                 তুঁহু মম / ১২   


সন্দীপ চক্রবর্তী

ছোটবেলা থেকেই জীবন আমার কাছে অগুনতি বিস্ময়ের এক উৎস। বড়ো হই, বুড়ো হই-- কিন্তু বেঁচে থাকার বিস্ময় আমার ফুরোয় না। সেদিন রুরুর মুখে 'মার্ডারার' কথাটাও ছিল আমার কাছে চরম বিস্ময়কর। আমি মফস্বলের ছেলে। কৃষ্ণনগরের মেয়েদের সঙ্গে সেভাবে মেলামেশা না করলেও দু'একজনের সঙ্গে পরিচয় তো ছিল। তাদের কারোর কারোর চোখে আমাকে ঘিরে কৌতূহলও দেখেছি। কিন্তু তারা কেউ কোনওদিন আমাকে মার্ডারার বলেনি। রুরুর মতো আমার মনের কোণে ঘুমিয়ে থাকা পুরুষমানুষটিকে জাগিয়ে দেবার চেষ্টাও করেনি। সুতরাং, কথাটি আমার ধূলি-ধূসরিত তানপুরায় কেবলমাত্র একবার আঙুল ছুঁইয়েই দায় সারেনি, রীতিমতো ঝংকার তুলেছিল। আমিও সেই ঝংকার থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারিনি। আরও এক বিস্ময়কর ঘটনা হল রুরুর মধ্যে রানুদিকে দেখতে না পাওয়া। সেই সময় আমি প্রায় সব মেয়ের মধ্যে কমবেশি রানুদিকে দেখতাম। কিন্তু রুরুর মধ্যে দেখিনি। অথচ পরবর্তীকালের অনেক ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে রুরু রানুদির থেকেও ভয়ংকর। তফাৎ এইটুকুই, রানুদির মতো মানুষেরা ভোগের উপকরণটি কুক্ষিগত করার জন্য ভালোবাসার ভান করতে পারে। রুরু তা করবে না। সে আজ যাকে নিজের সঙ্গে জুড়ে নিল, ভালো না লাগলে কাল তাকে ছিঁড়ে ফেলে দেবে। তোমার মুখের ওপর বলে দেবে, 'ওয়র্ল্ড ইজ ইয়োর প্লে গ্রাউন্ড কুমু। সো মেনি প্লেয়ার্স আর ওয়েটিং। কল দেম আপ অ্যান্ড প্লে । জেতা হারা কোনও ব্যাপার নয়। জাস্ট প্লে ফর ফান৷ মেক ইট লার্জার দ্যান লাইফ।'
যাক সে কথা। এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ সেদিনের পর রুরুর সঙ্গে আমার ঘনিষ্টতা বেড়ে গিয়েছিল। অনির্বাণও রোজ থাকত না। রুরু চলে আসত আমার কলেজে। তারপর আমরা কলকাতা শহরের আনাচেকানাচে টহল দিতে বেরোতাম। মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে রুরু কথায় কথায় ওর অনেক কথাই আমাকে বলল। জানলাম ও বিশাল বড়োলোকের মেয়ে। ওর বাবা বিমলেন্দু ঘোষ সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হলেও চাকরি করেন না। ওর হাউজিং ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি রোজলিন কনস্ট্রাকশনের তখন বিরাট নামডাক। রুরুর মা অবশ্য হাউজওয়াইফ। বাবা মা আর একমাত্র মেয়েকে নিয়ে গড়া পরিবারের ছবিটা আমার বেশ সম্পূর্ণ বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু আমার সেই ধারণাকে একদিন ভেঙে চুরমার করে দিল রুরুই। কলকাতার এক নামি কাফেটেরিয়রে বসে কফি খেতে খেতে বলল, 'তোমাদের মফস্বলের ছেলেদের নানারকম ছুঁচিবাই থাকে। তোমার সেরকম কিছু নেই তো?'
আমি অবাক হয়ে বললাম, 'মানে!'
আমার বিস্ময়কে বিন্দুনাত্র পাত্তা না দিয়ে রুরু বলল, 'দেখো অর্জুন, আমার চোখে আমি বিন্দাস। কিন্তু লোকে বলবে আমি খারাপ মেয়ে। মদ খাই। বন্ধুদের সঙ্গে লং ড্রাইভে চলে যাই। কাউকে ভালো লাগলে রিসর্ট-টিসটে থেকেও যাই। হোয়াট সোসাইটি সেজ আই ওয়ন্ট বদার। কিন্তু আজ হোক বা কাল কেউ না কেউ তোমাকে এসব কথা বলবেই। তাই নিজেই সব বলে দিলাম।'
আমি চুপ। এমন অকপট স্বীকারোক্তির জবাবে কী বলতে হয় আমার জানা নেই। অস্বস্তি যেমন হচ্ছে, একটা সমীহের ভাবও জেগে উঠছে। কিছুক্ষণ পর রুরুই আবার শুরু করল, 'আমার বাবা-মাও আমার মতো। বাবার একজন কেপ্ট আছে। আর মায়ের-- মা যদিও তাকে বন্ধু বলে কিন্তু আসলে তিনি মায়ের সেক্স টয়। অ্যাট হোম আয়াম লাইক আ হাইফেন। রাখলেও চলে, না রাখলেও চলে। এসব জানার পর যদি মনে করো আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখা যায় তবেই রাখবে।'
জানো কুমুদিনী, সেদিন আমার মনে হয়েছিল রুরু অন্য গ্রহের জীব। ওকে আমি কোনওদিনই বুঝতে পারব না। কিন্তু আমার মনের কথা মুখে আনতে যুগ কেটে যায়৷ আর সময় সেই অবকাশে মনের সুখে ভেঙে রেখে যায় আমার আশা-আকাঙ্ক্ষা। আমার স্বপ্ন। আয়নায় ফুটে ওঠে এক বহুরূপীর মুখ। শুধুমাত্র জেন্ডারে সে পুরুষ, শিরদাঁড়ায় কাপুরুষ। সেদিন আমার যা বলা উচিত ছিল আমি তা বলতে পারিনি। বলেছিলাম, 'তোমার যদি মনে হয়, যা করছ ঠিক করছ তা হলে আমি কী বলতে পারি! আমি তো আর তোমার কাজের
বিচারক নই।'
হ্যাঁ, এই কথাই সেদিন বলেছিলাম। আজ কী মনে হয় জানো? আমি সেদিন শুধু নিজের সঙ্গেই প্রতারণা করিনি, রুরুর সঙ্গেও করেছিলাম। আমার বলা উচিত ছিল ব্যক্তির কল্যাণের জন্যই সমাজের সৃষ্টি। সুতরাং কোনও ব্যক্তির বিরুদ্ধে সমাজ যদি আঙুল তোলে তা হলে পর্যাপ্ত আত্মবিশ্লেষণ না করে সেই আঙুল কেটে ফেলার ভাবনা একেবারেই অযৌক্তিক।
দিন কাটছিল বুকের ভেতর ঝড়ের শব্দ শুনে। কথাটা অদ্ভুত শোনালেও আমি নাচার। রুরুর আগুনে ভয় পেয়ে যারা সরে যেতে পারে তারা একদিক থেকে সৌভাগ্যবান। কিন্তু যারা আগুন থেকে আলো জ্বালার কথা ভাবে তাদের ভাগ্যের চিন্তা না করে আগুনে ঝাঁপ দিতেই হয়। একে নেশা বলো তো নেশা, ভালোবাসা বলো তো ভালোবাসা।
দেখতে দেখতে মাস ছয়েক কেটে গেল। তারপর এলো সেই দিনটা। সেদিন সন্ধ্যে থেকেই তুমুল বৃষ্টি। কলকাতা এক হাঁটু জলের তলায়। তখন মোবাইল নেই। রাত দশটা নাগাদ রুরু কোন এক এসটিডি বুথ থেকে ফোন করল, 'বৃষ্টিভেজা রাতের কলকাতাকে কখনও দেখেছ? না দেখলে চলে এস। আমি ওয়েট করছি।'
না গেলেও পারতাম। কিন্তু ফিরতে চাইলেই ফেরা যায় নাকি! জীবনে সেই প্রথম হোস্টেল সুপারকে এক ঝুড়ি মিথ্যে কথা বলে বেরিয়ে পড়লাম। হোস্টেলের গেটের সামনেই একটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়েছিল। আমাকে দেখে রুরু ট্যাক্সির ভেতর থেকে ডাকল, 'এই যে এখানে---উঠে পড়ো।'
শুরু হল আমাদের কলকাতা দেখা। রাতের কলকাতা এমনিতেই খুব সুন্দর। কিন্তু রাতের বৃষ্টিতে বেসামাল কলকাতা আরও মোহময়ী। মনে হয় এ শহর বুঝি পৃথিবীর নয়। এলিয়েনদের কোনও গ্রহে এর স্থান। এক্ষুনি মেঘ সরে গিয়ে ফুটে উঠবে এই শহরের হলুদ আকাশ। আর সেই আকাশে জ্বলজ্বল করবে একটি-দুটি গাঢ় নীল রংয়ের তারা।
রাত দুটোর সময় আমাদের বাবুঘাটে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল হলুদ-কালো ট্যাক্সি। আমরা এ শহরের দুই দলছুট গিয়ে বসলাম গোয়ালিয়র মনুমেন্টের সিঁড়িতে। বৃষ্টি তখনও পড়ছে। সামনে আদিগন্ত গঙ্গা। ধূসর আকাশে জলভরা মেঘের সাঁতার। জোয়ার এসেছে গঙ্গায়। ঢেউ ভাঙার শব্দ শুনছি অবিশ্রাম। আমাদের দুজনেরই চোখ তলিয়ে গেছে চোরাস্রোতের টানে। সময় ভেসে যাচ্ছে খড়কুটোর মতো। হঠাৎ রুরু ফিসফিস করে বলল, 'হ্যাভ ইউ এভার থট টু কমিট সুইসাইড?'
আমি অবাক। এমন অপার্থিব মুহূর্তে এসব কী আবোলতাবোল কথা বলছে রুরু! আত্মহত্যার কথা কেন ভাবব? এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে কেউ এত তাড়াতাড়ি যায় নাকি? কিন্তু আমাকে তো তুমি চেনো কুমুদিনী। কথা খুঁজতে আমার জীবন কেটে যায়। খুঁজে পেলেও সব সময় বলে উঠতে পারি না। সেদিনও পারিনি। আমার সৌভাগ্য রুরু এই নৈঃশব্দকে পাহাড়ের মতো ভারী হয়ে উঠতে দেয়নি। আমার কাঁধে মাথাটা হেলিয়ে দিয়ে বলেছিল, 'মাঝে মাঝে কী মনে হয় বলো তো? মনে হয় ডেথ উইল বি ফানি টু। কিন্তু আজ এসব কথা নয়। হোল্ড মি অর্জুন। হাগ মি টাইট। ডোন্ট বি শাই। মাঝরাতে এই বৃষ্টির মধ্যে তোমাকে কেউ বাধা দেবে না।'
না, আমি তাও পারিনি সেদিন। কোনও মেয়েকে আদর করার সাহস আমার তখন ছিল না। শুধু ওর বৃষ্টিতে ভেজা চুলগুলো কপাল থেকে সরিয়ে দিয়ে বলেছিলাম, 'এবার বাড়ি চলো রুরু। রাত প্রায় ভোর হয়ে এল।'

(ক্রমশ)

মন্তব্যসমূহ