রবিবাসরীয় সাহিত্যের দিন প্রতিদিন - সাহিত্যিক সন্দীপ চক্রবর্তীর অন্য ধারার গল্প গাঁথার ধারাবাহিক " তুহু মম "
রবিবাসরীয় ধারাবাহিক
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের নবীন লেখক সন্দীপ চক্রবর্তী । সন্দীপ লেখেন, নিজের অনুভুতি দিয়ে। সেখানে পাওয়া যাবে নিজেকে খুঁজে। বর্তমানে সন্দীপ একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের অন্যতম ।সন্দীপের প্রতিটি অক্ষরের মাঝে লুকিয়ে থাকে সমাজের চালচিত্র। প্রতিদিন থাকছে এই সমাজের কথকতা। একেবারে নতুন এক আঙ্গিক। একেবারে অন্য রকম আখ্যান গাথা
তুঁহু মম / ৯
সন্দীপ চক্রবর্তী
হ্যাঁ কুমুদিনী, তোমার সঙ্গে দেখা হওয়া আমার জীবনে একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তোমাকে দেখার পরেই বুঝেছিলাম সব মেয়ে রানুদি নয়। এর আগে কলকাতার ছাত্রজীবনে যখন মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশা করতাম তখন তাদের প্রত্যেকের মুখেই রানুদির মুখের আদল ফুটে উঠত। আর আমি মেয়েদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠার তীব্র বাসনায় প্রায় গায়ের জোরে নিজেকে বোঝাতাম, এসব আমার মনের ভুল। রানুদিকে আমি অনেক পিছনে ফেলে এসেছি। এই মেয়েরা আমার বন্ধু। এরা কোনওদিন রানুদি হবে না। কিন্তু জোর করে কিছু চাপিয়ে দিলেই তো আর সেটা সত্যি হয়ে যায় না। আমার মন তখন দ্বিখণ্ডিত। মনের একদিকে রানুদির অবাধ পরিক্রমা আর অন্যদিকে সেই রানুদিকেই অস্বীকার করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। টানাপড়েনের মাঝে পড়ে আমি ঘুরে মরছি এক গোলকধাঁধায়। তুমি এসে আমাকে উদ্ধার করলে। এ জীবনে তোমার ঋণ আমি কোনওদিন শোধ করতে পারব না। তবে তোমার কথা এখন নয়। সে হবে পরে। যখন হবে তখন হতেই থাকবে। চাইলেও আমি থামাতে পারব না। সুতরাং আবার আমরা প্রসঙ্গে ফিরব।
গুরুজনদের বাক্যি শিরোধার্য করে আমি প্রেসেডেন্সিতে ভর্তি হলাম। হোস্টেলে জায়গা পাওয়া খুব সহজ ছিল না। কিন্তু আমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন। হোস্টেলে থাকার জায়গাও পেয়ে গেলাম। প্রথম দিকে আমি যে কৃষ্ণনগর থেকে কলকাতায় এসেছি সেটা তেমন বুঝতে পারিনি। ওখানেও আমার কোনও বন্ধু ছিল না, এখানেও নেই। ক্লাসে শেষের দিকে বসি। ক্লাস শেষ হলে সোজা হোস্টেলে ফিরে আসি। তখন মনে হত এইভাবেই প্রেসিডেন্সির জীবন কেটে যাবে বোধহয়। কিন্তু কাটল না।
যে হোস্টেলে থাকতাম সেটা প্রাইভেট হোস্টেল। সেখানে শুধু প্রেসিডেন্সি নয়, অন্য কলেজের ছাত্ররাও থাকত। জেভিয়ার্সের অনির্বাণ ঘোষ তেমনই একজন। ইংরিজি অনার্সের ছাত্র। অনির্বাণ একদিন আমাকে ডেকে বলল, 'শোনো। তোমার নাম অর্জুন, না?'
সবে কলেজ থেকে ফিরেছি। চা খেয়ে প্রোফেসরদের দেওয়া নোট ফেয়ার করতে বসব। এই সময় সাধারণত আমি কারোর সঙ্গে কথা বলি না। এমনকী অন্য কোনও কাজও করি না। কারণ তাতে নোট নেওয়ার সময় আমি যে সব পয়েন্ট মিস করেছি সেগুলো মাথা থেকে বেরিয়ে যায়। তাই মুখে কিছু না বলে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম।
অনির্বাণ বলল, 'কী ব্যাপার বলো তো! তুমি কারোর সঙ্গে কথা বলো না কেন? একা থাকতে তোমার বোর লাগে না?'
এতগুলো প্রশ্নের উত্তর মাথা নেড়ে দেওয়া সম্ভব নয়। তাই হেসে বলেছিলাম, 'বোর লাগবে কেন! আমি ছোটবেলা থেকেই একা থেকে অভ্যস্ত। আমার খারাপ লাগে না।'
'তোমার খারাপ না লাগতে পারে কিন্তু তোমাকে দেখে আমার খারাপ লাগে। তোমার মতো একটা ইয়ং হ্যান্ডসাম ছেলে বিকেলবেলায় এরকম ঘরে বসে থাকে নাকি? শোনো অর্জুন, কাল থেকে কলেজ থেকে ফিরে রোজ আমার সঙ্গে বেরোবে।'
অনির্বাণের বলার মধ্যে একটা কর্তৃত্ব ফলাবার চেষ্টা ছিল, যেটা আমার ভালো লাগেনি। সেদিনই ওকে আমার বলে দেওয়া উচিত ছিল, 'তা হয় না অনির্বাণ। মাঝে মাঝে বেরোতে পারি কিন্তু রোজ সম্ভব নয়। কারণ তাতে আমার পড়াশোনার ক্ষতি হবে।' কিন্তু বলতে পারিনি। কারোর মুখের ওপর না বলতে পারি না বলেই বলতে পারিনি। পরের দিন থেকে শুরু হয়েছিল আমাদের বৈকালিক ভ্রমণ। কোনওদিন হেদুয়ায়, কোনও শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়ে, আবার কোনওদিন দূরে কোথাও।
তুমি যদি জিজ্ঞাসা করো, অনির্বাণের সঙ্গ আমি পছন্দ করতাম কিনা, তা হলে বলব, করতাম। কিন্তু কেন করতাম সেটাই সবথেকে জরুরি প্রশ্ন। অনির্বাণের একটা বিশেষ ক্ষমতা ছিল। কয়েক মিনিটের মধ্যে ও যে-কোনও অজানা অচেনা লোকের সঙ্গে ভাব জমাতে পারত। তাদের সঙ্গে এমন অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে কথা বলত তুমি দেখে বুঝতেও পারবে না যে ওরা দু'মিনিট আগেও কেউ কাউকে চিনত না। একটা উদাহরণ দিই। একদিন আমরা হেদুয়ায় বসে আছি। হঠাৎ অনির্বাণ বলল, 'তুমি ওই কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে বেঞ্চে বসে থাকা লোকটাকে দেখেছ? বেশ ইন্টারেস্টিং না?'
ভালো করে দেখলাম লোকটিকে। সাধারণ চেহারার একজন মাঝবয়েসি প্রৌঢ়। মনে হয় কোনও গভীর চিন্তায় মগ্ন। বললাম, 'আমি তো ইন্টারেস্টিং কিছু দেখতে পাচ্ছি না।'
'একবার দেখলে কিছু বোঝা যাবে না। আমি লাস্ট দশ মিনিট ধরে দেখছি। ভদ্রলোক স্ট্রেট জলের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। মুহূর্তের জন্যেও ঘাড় ঘোরাননি। অথচ দেখো ওর পাশের বেঞ্চেই দুটো ছেলে রীতিমতো চিৎকার করে কথা বলছে। ওদের হাসির আওয়াজ তো আমরাও শুনতে পাচ্ছি।--দাঁড়াও, জেনে আসি ব্যাপারটা কী?'
অনির্বাণ ক্যাজুয়ালি চলে গেল। আমি অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম। কারণ একজন অচেনা লোকের সঙ্গে এভাবে কথা বলা আমার কাছে অ্যামাজনের জঙ্গলে হারিয়ে যাওয়ার মতো ভয়াবহ ব্যাপার। কিছুক্ষণ পর অনির্বাণ ফিরে এসে বলল, 'ভদ্রলোকের নাম পরিমল বিশ্বাস। দাবায় চ্যাম্পিয়ন। এখানে মাঝে মাঝে আসেন। চুপচাপ বসে দাবার বিভিন্ন কম্বিমেশনের কথা ভাবেন। ভাবার সময় পাশে বাঘ ডাকলেও ওর কনসেনট্রেশন নষ্ট হয় না।'
হয়তো সেদিন পরিমল বিশ্বাসকে নিয়ে আমার কোনও কৌতূহল ছিল না। কিন্তু অনির্বাণের সম্মোহনী ক্ষমতায় আকৃষ্ট হয়েছিলাম। আমার মতো অমিশুক আর ঘরকুনো মানুষের কাছে অনির্বাণের সম্মোহন ছিল ইন্দ্রজালের মতো। আসলে আমরা যা করতে চাই কিন্তু যে-কোনও কারণেই হোক করতে পারি না--সেই কাজ যখন অন্য কেউ খুব সহজেই করে দেখিয়ে দেয় তখন তার প্রতি এক আনুগত্য তৈরি হয় বই কী! আমারও হয়েছিল। এই ঘটনার কিছুদিন পর বোধ করি সেই আনুগত্যের টানেই কার্যত বাধ্য হয়েছিলাম অনির্বাণের একটি অনুরোধ মানতে। যা না মানলে আজ আমার জীবন অন্যরকম হত এবং তোমাকে এত কথা লেখারও প্রয়োজন হত না।
(ক্রমশ)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন