আজ মহানায়কের প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি বেহালার দিন প্রতিদিনের বিশেষ কাজল ভট্টাচার্যের কলমে

 

ভরা থাক স্মৃতিসুধায় 



- কাজল ভট্টাচার্য, কলকাতাঃ

( বাঙালির 'গুরু'র আজ পূণ্যতিথি। তাঁরই স্মৃতিতর্পণে গঙ্গাজলে গঙ্গাপূজা।) 


- "বুঝলে নয়না, এটাই বোধহয় আমার পাওনা ছিলো।" বলেছিলেন ঘণাদা।

'যদুবংশ'- এর ঘণাদা। নাক, বাঁদিকের কষ বেয়ে রক্ত। ছেঁড়াফাটা পাঞ্জাবি। চার ইয়ারের গণপ্রহারে চোখের চশমাটাও ভেঙেছিল। চুরির অপবাদ। ক্যামেরা ক্লোজ আপ থেকে বিগ ক্লোজ আপে মুখ ধরলো গণাদার- গণনাথ বসু। 

আঘাতে আহত না, জখমটা অপমানের। আঘাতের চিহ্ন তো মেক আপের কারসাজি। কিন্তু অপমানের জ্বালা ফুটে ওঠে কোন জাদুতে? কেন, উত্তম জাদুতে। সেই জ্বালা ফোটাতে দরকার এক আবেগ, তীব্র অনুভূতির। তবে ক্যামেরার সামনে যখন উত্তমকুমার, তখন আর চিন্তা কী? 

পর্দা জুড়ে শুধু একজোড়া চোখ, নাক আর ঠোঁটেই কাটা পড়েছে ফ্রেম। ওটুকুই যথেষ্ট। 'যদুবংশ' ধ্বংসের পূর্বছবিটা গণাদার মুখ জুড়ে। 

বণিকদের সঙ্গে লড়াইয়ে হেরে গেছিলেন ছোটপূঁজির ব্যবসায়ী ইউনিভার্সাল এজেন্সির মালিক গণনাথ বসু। 'যদুবংশ'- এ পার্থপ্রতিম চৌধুরি পর্দায় সেই উপাখ্যানই হাজির করেছিলেন। বাস্তবের গণনাথ বসু, উত্তমকুমারও সেদিন পর্দায় হেরে গেছিলেন। কিন্তু বাঙালি বাস্তবের ঘণাদাকে জিতিয়ে দিয়েছে।

তাতে কীই বা যায় আসে মহানায়কের? বুকের ভেতরে তো কোথাও লুকিয়ে ঘাপটি মেরে বসে এক সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী। নইলে 'সন্ন্যাসী রাজা'র রূপের ওই খোলতাই হয় কোন জাদুতে? লম্বা চুল। সন্ন্যাসীর পরিধান। মাথাটা একটু হেলিয়ে বসা। ঠোঁটে সেই স্বর্গীয় হাসি। সবই যেন অনায়াসে সংক্রমিত হয়ে যায় দর্শকের মধ্যে। 

তবে শেষযাত্রায় এক ট্র্যাজেডির সাক্ষী হয়েছিলেন বাঙালির গুরু। তাঁর কর্মকাণ্ডের অনেকটাই যে বাড়ি জুড়ে, সেই বাড়ি ছুঁয়ে যেতে পারেননি তিনি।

তিন নাম্বার ময়রা স্ট্রিট।



আশির দশক পর্যন্ত এই ফ্ল্যাটই গমগম করতো। রাজেশ খান্না থেকে কিশোর কুমার, কলকাতায় এলে উত্তম কুমারের সঙ্গে এবাড়িতে দেখা না করে মুম্বই ফিরতেন না। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, শিল্প জগতের মানুষদের আনাগোনায় তখন জমজমাট তিন নাম্বার ময়রা স্ট্রিট। কলকাতা আগলে রাখেনি তার মহানায়কের স্মৃতি। সেই বাড়ি এখন ধনীর বাংলোবাড়ি। সমাজটার ভেতরে পচন ধরেছিল বহু আগেই। 'যদুবংশ'-এ সেই কাহিনিই শুনিয়েছিলেন প্রয়াত পরিচালক পার্থপ্রতিম চৌধুরী।

ভেতরে ভেতরে সত্যিই কি কোথাও একেবারে নিঃস্ব ছিলেন মহানায়ক?

দুচোখ বন্ধ করে একবার 'নগর দর্পণ'- এর শেষ দৃশ্যটা দেখুন। কবির ভাষায়- 'অন্তরে আজ দেখব যখন আলোক নাহি রে।' সেই অন্তরের চোখ মেলে দেখুন।

লোহার গেটের দিকে পিঠ করে বসে অনুপম চক্রবর্তীর সাজে উত্তমকুমার। গেট দিয়ে ঢুকে সামনের মানুষটার কাছে নিজের ভুলের কথা স্বীকার করলেন স্ত্রী, শ্রীলেখারূপী কাবেরী বসু। শ্রীলেখার কথাগুলো যেন সেরেফ হাওয়ায় ভেসে গেল। শ্রোতা সমাধিস্থ। একবারের জন্যও মুখ ফেরালেন না। এবার স্বামীর পিঠে আলতো করে হাত রাখলেন স্ত্রী। হাতের ছোঁয়াতে সুপ্ত অনুভূতিগুলি যেন ফের একবার আড়মোড়া ভাঙলো শরীরের ভেতর। এবার অতি ধীরে মুখ ঘুরিয়ে তাকালেন নায়ক। আর সেই সঙ্গেই বুঝিয়ে দিলেন কেন তিনি মহানায়ক। ততক্ষণে সব চাওয়া- পাওয়া, মান অপমান, অভিমান সবকিছুর বাইরে চলে গেছেন তিনি।

সেদিন অনুপম ছিলেন এক মানসিক বিপর্যস্ত সুস্থ মানুষ। কিন্তু তাঁকে পাগল ভেবে, ধরেবেঁধে পাচার করার চেষ্টা হচ্ছিল বেলেঘাটা মেনটাল হসপিটালে। ছটফট করছিলেন অনুপম, প্রবল আপত্তি তাঁর। কিছুতেই যাবেন না। সামনে পুলিস অফিসার ভাই। তাঁর দিকে ছুটে গেলেন বাঁচার আশায়। ভাইয়ের হাতে মার খেয়েই একেবারে চুপ মেরে গেলেন দাদা। সেদিন গোটা ঘটনাটা ঘটে গেছিলো শ্রীলেখার চোখের সামনেই। একবারের জন্যও তিনি স্বামীর কথায় পাত্তা দেননি। ভুল ভাঙতে দেরি হয়ে গেলো। স্ত্রী ছুটে গেলেন স্বামীকে ফিরিয়ে আনতে। বিবেকের দংশন ভাইদের মধ্যেও। কিন্তু পিঠে হাত ছোঁয়াতেই যিনি ফিরে তাকালেন সে কে?

শূন্য দুচোখের বোবা দৃষ্টি। প্রাণহীন চোখের তারা। ঠোঁট কেপে উঠলো। গালের পেশির কেমন অবাধ্য আচরণ। অপরিচিতর দৃষ্টিতে তাকালেন স্ত্রীর দিকে। না, একটিও আবেগভরা ডায়লগ না। এগিয়ে এলো ক্যামেরা। মিড ক্লোজ আপ থেকে ক্লোজ আপ। "স্ক্রিন পার্সোনালিটির অগ্নিপরীক্ষা ক্লোজ আপে," বলেছিলেন বার্গম্যান। তিনি ওই দৃশ্য দেখলে একশোই দিয়ে দিতেন উত্তমকুমারকে।

পর্দা জুড়ে তখন শুধুই এক উন্মাদের মুখ। মুহূর্তের মধ্যেই নায়ক হয়ে গেলেন মহানায়ক। বাস্তবের সঙ্গে সংঘাতে হেরে যাওয়া এক মানুষ। অতিদক্ষ পরিচালক উত্তমকুমারের আবেগ নিংড়ে নিয়ে তাঁকে নিঃস্ব করে দেবেন বলেই, দৃশ্যে ওই চরিত্রের মুখে কোনও সংলাপ রাখেননি। জীবনে এরচেয়ে 'উত্তম' পাগল আর দেখলাম না।

ভেতরে কোথাও একটা পাগলামি কাজ করেই চলে। তাই শিল্পীরাই বোধহয় নির্ভেজাল সর্বহারা। বাড়িঘর জমিজমা গ্ল্যামার এমনকি সাধের সংসারও টেকে না। ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখাও মানা। ময়রা স্ট্রিটের ফ্ল্যাটের কথা ছাড়ুন, মুম্বইয়ে আরব সাগরের তীরের ওই ঝাঁ চকচকে ফ্ল্যাট। এয়ার হোস্টেস সুজাতার চরিত্রে অঞ্জনা ভৌমিক। চাবি গুঁজে দিলো স্যাটা বোসের মেকআপে উত্তমকুমারের হাতে। ফ্লাইট থেকে ফিরেই দুজনে সংসার পাতবে। আকাশে উড়তেই স্যাটা বোসের চোখের সামনে আগুনে ছারখার হয়ে গেল প্লেন।

আরব সাগরের তীরে দাঁড়িয়ে স্যাটা বোস। একেবারে একা। নিঃসঙ্গ। পেছন থেকে ক্যামেরা ধরলো। যেন এক ছায়ামানুষ। সূর্য তখন পাটে চলেছে। স্যাটার মনে বেজে চলেছে 'আমি যে গান গেয়েছিলাম। মনে রেখো।' ক্যামেরা সাইড থেকে ধীরে ধীরে রোল করে ধরলো স্যাটা বোসকে। বিধ্বস্ত। 

কোনও মেলোড্রামায় গেলেন না নায়ক। মন উঠে আসলো মুখে। ফের একা হয়ে গেল স্যাটা। মন ভারী করে হল থেকে বেরোলেন দর্শকরা। সেধে সেধে পকেটের টাকা খসিয়ে তবুও বারেবারে 'চৌরঙ্গি' দেখতে ভিড় করা। সম্ভবত স্যাটা বোসের যন্ত্রণা শেয়ার করতেই উত্তমদর্শন।

শিল্পীর সংসার বুঝি এমনতরোই হয়। টেকে না। তা সে হোটেল শাজাহান, মুম্বইয়ের ফ্ল্যাট হোক অথবা ময়রা স্ট্রিট। 

না পাওয়ার বেদনাতো আছেই। কিন্তু পেয়ে হারানোর ব্যথা বড় বুকে বাজে।

স্যাটা বোসের মতোই, পেয়েও মনের মানুষকে হারিয়েছিলেন ডাক্তারবাবু। বড্ড একা হয়ে গেছিলেন। তবু তিনি 'অগ্নীশ্বর' মুখুজ্জে, ষোলটাকা ভিজিটের সরকারি ডাক্তার। একটু টেনে টেনে ডায়লগ বলা। চশমার ওপর দিয়ে তাকানো। ওই চাউনিতে যে কত সুন্দরী বধ হতেন, কোন লালবাজার তার হিসেব রাখে? ওই পর্যন্ত না হয় ঠিক ছিলো। কিন্তু তারপর কী করলেন? 

"আমার স্ত্রী আজ মারা গেলেন। তাঁকে দাহ করে আসতে, একটু দেরি হয়ে গেল।" গাড়িতে স্টার্ট দিতে দিতে ঠোঁটের ডগায় হাসি ঝুলিয়ে বললেন মহানায়ক। এমনও হাসি আছে যা বেদনার চেয়েও মারাত্মক। হৃদয়ে মুহূর্তেই ক্ষত তৈরি করে দেয়।



কথা ছিল ব্যথা উপশমের। কিন্তু 'অগ্নীশ্বর'- এর উত্তমকুমারকে দেখে দর্শক ফিরলেন একবুক যন্ত্রণা নিয়েই।

শুধু ব্যথা কেন, বাঙালিকে অনাবিল আনন্দও দিয়েছেন মুঠো ভরে ভরে। 'মৌচাক'। মনে আছে তো, মিঠু মুখার্জি তার বয়ফ্রেন্ড রঞ্জিত মল্লিককে কী বলেছিলো?

"আপনার দাদা আপনার চেয়ে অনেক বেশি স্মার্ট। যে কোনও মেয়ে দেখলেই প্রেমে পড়ে যাবে।"

শুধু মেয়েরাই না, পুরুষরাও উত্তমপ্রেমে মজেছিল।

কিছুতেই অস্বীকার করা যেতো না উত্তমকুমার নামের ওই ব্যক্তিত্বকে। 'সব্যসাচী'। নামভূমিকায় উত্তমকুমার। সুপ্রিয়াদেবীর চুটিয়ে অভিনয় এক সেক্সি মাফিয়া গার্ল রোজের ভূমিকায়। রোজ এসে হাজির ডক্টর সব্যসাচীর চেম্বারে। রোজের খোঁচামারা কথায় শেষ পর্যন্ত ধৈর্যচ্যূতি ডাক্তারের। বাঁ হাতে কলম তুলে একনিঃশ্বাসে লম্বা সংলাপ। উদ্ধত রোজকে এক লহমায় এক অনন্ত প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেন ডাক্তার - "কোনদিন কোনওভাবে কোনওকথা মনে হয়নি?" সংলাপের তীব্রতায় অর্জুনের বাণের ধার। একরাশ জিজ্ঞাসা নিয়ে বিস্ফারিত চোখ। ছোট্ট পজ। কপালে হালকা ভাঁজ সব্যসাচীর।

ওই চোখের সামনে কুঁকড়ে গেলো রোজ। দৃশ্য ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছলো। গলা নেমে এলো। "দেশ হলো মা। মাতৃভূমি।" অঢেল নাটকীয়তার সুযোগ। কিন্তু একদম মাপা অভিনয়। স্ট্রাইপড শার্ট। ফুল স্লিভ। গুঁজে পরা। চোখে সরু ফ্রেমের চশমা। রোজকে সুমিত্রা বানিয়ে ছাড়লেন সব্যসাচী।

'নায়ক' অরিন্দম মুখোপাধ্যায় মুঠো পাকিয়ে কথা দিয়েছিলেন- "আই উইল গো টু দ্য টপ..দ্য টপ..দ্য টপ!" কথা রেখেছিলেন তিনি। নায়ক থেকে মহানায়ক হয়েছিলেন। "উত্তমকুমার সেরিব্রাল না, ইনস্টিংকটিভ শিল্পী!" স্বীকৃতি দিয়েছিলেন প্রয়াত পরিচালক সত্যজিত রায়।

তাঁকে দেখে আজও ক্রাশ খায় বংতনয়া, সুন্দরী হোক বা অসুন্দরী। আঠারো হোক কী আশি। আর খাবেই বা না কেন? প্রেমিকার কাছে তো তিনি 'ভোলা ময়রা' হয়ে ফিরে আসেন। বাহারি গোঁফ, ধুতি পাঞ্জাবির উত্তমকুমার তো আজও লেডিকিলার। হাত বাড়িয়ে ডাক দেন- "আমি তোকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছি কালী!"

এক বৃষ্টি ভেজা রাত ডাক দিলো সব্যসাচীকে। পা বাড়ালেন এক অজানা পথে। তাঁর অপেক্ষায় রইলো সুমিত্রা। আজও সে অপেক্ষার প্রহর ফুরলো না।

তবে ঘণাদার সেই আক্ষেপ মিটিয়ে দিয়েছে বাঙালি। তাঁর পাওনাগণ্ডা দুহাত ভরে মিটিয়ে চলেছে ভক্তরা। সেখানে তিলমাত্র কার্পণ্য নেই।

হারিয়েও হারান না মহানায়ক।

মন্তব্যসমূহ