রবিবাসরীয় বেহালার দিন প্রতিদিনে সম্পর্কের ইতিবৃত্ত বিশেষ সাংবাদিক কাজল ভট্টাচার্যের লেখনীতে - ' প্রাক্তনীকে বান্ধবী? নেভার '
প্রাক্তনীকে বান্ধবী? নেভার
কী ভাবছো, দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাবে?
উইকেটে না হলে, ফিল্ডিংয়ে টিকে থাকলেও চলবে। যদি সাইড লাইনে দাঁড় করিয়ে রাখে? তাহলেও চলবে।
আগে রাত হলেই ইনবক্স প্রেমালাপ। আজকাল ভাষা বদলে গেছে।
- বলতো কী রোদ উঠেছে! ঘেমে মরছি।
- ছাতা নিয়ে বেরোসনি?
- দেখিস বিকেল হলেই বৃষ্টি নামবে।
ভাষা বদলেছে মানে সম্পর্কের রং বদলের পূর্বাভাস। প্রেমিক থেকে সোজা বন্ধু? প্রোমোসন নাকি ডিমোসন, তুমিই ভেবে দেখো। তবে যাই বলো না কেন, প্রেমিকার এই রংবদল তোমাকে একেবারে মুরগি করে ছাড়লো বস।
- 'শোন না, ক্যানিংয়ে ঘুরতে যাচ্ছি অয়নের সঙ্গে। ওখানে থাকার হোটেল টোটেল আছে তো?'
সকাল সকাল মোবাইলে কল করে জানতে চাইলো আপনার প্রাক্তনী। বর্তমানে বান্ধবী। সহ্য করার মতো বুকের পাটা আছে তো?
'মুখে যাই বলো বস, ভেতরটা জ্বলেপুড়ে একদম খাক হয়ে যাবে,' বলছেন ফ্র্যাঙ্কি কোলা। একদিন তিনিও তোমার মতোই মুরগি হয়েছিলেন। নিঃসঙ্গতার শিকার হয়ে ভেঙে পড়েছিলেন। ঠিক যেমনভাবে সেদিন ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হয়ে ভেঙে পড়েছিলেন কৃষ্ণতনয় শাম্ব। তবে তাঁরা কেউ দমে যাননি। এরপরেই শুরু করেছিলেন রোগমুক্তির সন্ধান। বইয়ের পাতায় ডুবে যান ফ্র্যাঙ্কি। বিষয়, 'উওমেন অ্যান্ড ডেটিং'। প্রেমিকাদের বিষ ঝেরে প্রেমিকদের বাঁচিয়েই ছাড়বেন। শাম্বর মতোই ফ্র্যাঙ্কিও উত্তরণের পথে এগিয়ে যান। অবশেষে রোগমুক্তির নিদান দিতে ঠিক এক দশক আগে, ২০১১ সালে খুলে বসেন নিজের ওয়েবসাইট- 'চ্যাম্পিয়ন্স অফ মেন'।
'টুরু লভ'- এর বিচিত্র গতি জানতে বিদেশের গবেষকরা '২০০৪ এনবিসি. কম পোল' নামে এক অনলাইন সমীক্ষা চালান। দেখা যায়, একশোজনের মধ্যে আটচল্লিশজন প্রাক্তন প্রেমিক- প্রেমিকা বন্ধু হয়েও বেশ আছে। এদের মধ্যে আবার বেশ কয়েকজন প্রাক্তন স্বামী- স্ত্রী। অন্যদের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ থাকলেও বিয়ের পিঁড়ি পর্যন্ত পৌঁছয়নি।
ওই সমীক্ষাতেই আবার শোনা গেছিল উল্টো সুর। একশোজনের মধ্যে অন্য আঠারোজন প্রাক্তন, প্রাক্তনী স্বীকার করেছিল, ব্রেক আপের পর তাঁরা দূরে সরে যেতে চায়নি। একে অন্যকে ভালোও বাসতো। তাই বন্ধু হয়ে একজন, অন্যজনের পাশে থাকতে চেয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত তা টেকেনি।
ঠিক কোন পরিস্থিতিতে দুজনে পরস্পরের থেকে সরে এসেছিল? তার ওপরেই নির্ভর করছে দুই প্রাক্তন, প্রাক্তনীর মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক টিকবে কিনা। কারণ যাই হোক না কেন, দুজনেই যদি নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলে সম্পর্কের পরিধিতে লক্ষণ রেখা টানে, তাহলে বিচ্ছেদের পরেও দুজনে বন্ধু হয়ে টিকে থাকার একটা চেষ্টা চালানো যায় বৈকি।
গবেষকদের মত, এই ঘটনায় মাপা হয়ে যায় প্রেমের গভীরতাও। শরীর ছাড়িয়ে ভালবাসা মন পর্যন্ত পৌঁছলেই, বিচ্ছেদে সম্পর্কের নাম পাল্টাতেই পারে, কিন্তু সম্পর্ক অটুট থাকে। দুজনের দূরত্বও বাড়তে পারে, তবু হারিয়ে যায় না। কিন্তু যেখানে সম্পর্কের বাঁধনটাই ছিল শিথিল, সেখানে বিপরীত ছবি। সম্পর্কের ইতি যেখানে চেঁচামেচি রাগারাগির মধ্যে দিয়ে, সেখানে ফের সৌহার্দ্যের সম্পর্ক অসম্ভব।
'দুজনেই দুজনকে বেশ পছন্দ করতাম,' বলে এক প্রাক্তনী। 'আমাদের মেলামেশা বাড়লো। ঘনিষ্ঠও হলাম। ভালবাসার রং ধরলো শরীরেও। সে অনেক স্বপ্ন। কিন্তু কয়েক মাস পেরোতে না পেরোতেই ঠোকাঠুকি শুরু। ও আমার ঘাড়ে দোষ চাপাতো, আমি ওর।' এপর্যন্ত বলে একটু থামলো সেই তরুণী। বেশ চোখে পড়ার মতো টানটান চেহারা। একটু দম নিয়ে ফের বলতে শুরু করলো।
'বুঝতে পারলাম, আমাদের ঘর বাঁধা হবে না। একদিন অফিস থেকে ফিরতে একটু দেরি করে ফেলেছিলাম। সে নিয়ে তুমুল অশান্তি হলো আমাদের। সেটাই ছিলো আমাদের শেষরাত।' পরদিন সকালেই স্বপ্নের সংসার ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল সেই তরুণী। ধরে নেওয়া যাক, তার নাম প্রিয়ম্বদা।
'জানেন তো, প্রথমে ছিলো ভয়ঙ্কর রাগ। যত দিন গেছে, রাগ কমেছে। শেষ পর্যন্ত, সেই রাগের গোটাটাই বদলে গেল ঘৃণায়।'
তারপর কেটে গেছে বেশ কিছুটা সময়। প্রিয়ম্বদাও তখন অনেকটাই স্বাভাবিক। সে স্বীকার করে- এখন বুঝি, সম্পর্কটা আদতে তৈরিই হয়নি। নইলে অত তুচ্ছ কারণে সম্পর্কটা ভাঙতো না।
কিছু ভালো স্মৃতি থাকলেও, খারাপের তীব্রতাই বেশি। এরপর প্রাক্তনের সঙ্গে ফের কোনও সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার কথা ভাবতেই পারেনি প্রাক্তনী। তবে ঘৃণার অতীত মুছে না ফেলতে পারলেও কিন্তু বিপদ। জীবন একসময় দুঃসহ হয়ে দাঁড়ায়। সতর্কবাণী গবেষকদের।
তবে সবাই প্রিয়ম্বদা হয় না। শকুন্তলারাও আছে। রাজা দুষ্মন্ত প্রেয়সীকে চিনতেই পারলেন না। চেনেন তাঁর দেওয়া সেই রাজঅঙ্গুরীয়কে। এদিকে সেই আংটি তখন শকুন্তলার আঙুল থেকে গড়িয়ে মাছের পেটে। তবু ধৈর্যের বাঁধ ভাঙ্গে না শকুন্তলার। রাজা দুষ্মন্তকে তার পেতেই হবে।
'প্রথমত আমি তোমাকে চাই....
শেষ পর্যন্ত আমি তোমাকে চাই।'
রাজা দুষ্মন্তর মুখে অমন গান শুনতে সহস্র আলোকবর্ষ অপেক্ষা করে থাকতে পারে শকুন্তলারা। বুরি ছোঁয়ার মতো ছুঁয়ে থাকতে পারে সেই 'বিস্মৃত প্রেম'কে। চোখ জুড়ে রামধনুর স্বপ্ন। আশা থাকে, প্রত্যাশাও থাকে। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে থাকে এক অনন্ত প্রতীক্ষা। শকুন্তলারা যেন ভালবেসেই সুখী।
কিন্তু প্রিয়ম্বদারা অন্য ধাঁচের। তারা আগাপাশতলা চিনে, জেনে নিতে চায় মনের মানুষকে। সরাসরি ঢুকে পড়তে চায় সেই মানুষের জীবনে। রোজনামচার প্রতিটা খুঁটিনাটি থেকে ভাবনাচিন্তাতেও। এই সর্বগ্রাসী কামনা, বাসনা থেকেই বিবাদের সূত্রপাত। মত সমীক্ষকদের।
মোদ্দা কথা, সব প্রেমিকাই শকুন্তলা হয় না। আবার সব প্রেমিকও রাজা দুষ্মন্ত হয় না। প্রিয়ম্বদারাও থাকে, বিশেষ করে আজকের দিনে।
কিছু অবুঝ মনের আশা, সে ফিরবেই। বাস্তব বলে উল্টোটা। যে যায় সে যায়।
বাস্তববাদী হওয়া ছাড়া গতি কী? প্রাক্তনী যখন কোনও এক প্রিয়ম্বদা, হা হুতাশ করে আখেরে লাভ হবে না। আশাতেই মরে চাষা।
'সোজা পথে পা বাড়াও বস,' বলেন ফ্র্যাঙ্কি। ফের যদি সকাল সকাল প্রাক্তনীর ফোনকল আসে, বুক ঠুকে জানিয়ে দাও- থাকতে হলে প্রেমিক হয়েই থাকবো। নয়তো অয়নের সঙ্গেই থাকো। খবরদার, আমাকে বিরক্ত করবে না।' আর মুরোদে না কুলোলে প্রাক্তনীর বউভাতে নেমন্তন্নের কল পেতে অপেক্ষা করো।
প্রাক্তনীর ভূত স্বেচ্ছায় কাঁধে বয়ে বেরিয়েছে প্রতি একশোজনের মধ্যে একাত্তরজন। কিছুতেই অতীতকে পেছনে ফেলে তারা বর্তমানের খোলা হাওয়ায় নিঃশ্বাস নিতে পারেনি। পারেনি গটমট করে ভবিষ্যতের রাস্তায় এগিয়ে যেতে। স্তব্ধ জীবন। শুরু হতে পারেনি প্রেমের আরেক নতুন অধ্যায়। 'ইয়োর ট্যাঙ্গো. কম পোল'- এর সমীক্ষায় বুকে হাত দিয়ে এই নির্মম কথাও স্বীকার করে নিয়েছে সাতান্নজন প্রাক্তন প্রেমিক।
জীবন যেন থেমে গিয়েছে কোনও এক বাঁকের মাথায় এসে। যেখান থেকে শুধু পেছনে তাকানো যায়। দৃষ্টি সামনে সরে না। দরকারটা কি বস, ওই প্রাক্তনীর সঙ্গে ফের সই পাতিয়ে? পারবে, নতুন এই সম্পর্ক ধরে রাখতে? সে কিন্তু আরও দুরূহ।
চোখের সামনে যখন দেখবে প্রাক্তন বা প্রাক্তনী তার নতুন সঙ্গীর হাতে হাত ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এক বোতলে দুটো স্ট্র দিয়ে কোল্ড ড্রিঙ্কস শেয়ার করছে। সেই স্পেস দিতে পারবে তো?
বন্ধু যখন, অতীতের কথা তো উঠবেই। প্রেমে হাবুডুবু খাওয়ার সময় যে কথাগুলি চেপে গেছিলে, সেগুলি এবার হুড়মুড় করে বাঁধভাঙা স্রোতের মতো বেরিয়ে আসবেই। প্রকাশ হবে, না বলা মনের কথা। মন হালকা হবে। তবে বিপদ বাড়বে।
ওই পুরনো কথা নিয়েই শুরু হয়ে যেতে পারে তর্কবিতর্ক- তু তু ম্যায় ম্যায়। তখন?
তোমার অতীত আজ আরেকজনের বর্তমান। মেনে নিয়ে স্বাভাবিক থাকতে পারবে তো? 'তোমার সঙ্গে আছি!' বলার সময় তার পিঠে হাত রাখলে, প্রাক্তনী এক ঝটকায় তোমার হাত সরিয়ে দিতেই পারে। তখন মন গুমড়ে উঠবে নাতো?
এসব সইতে পারলেই, প্রাক্তনীর সঙ্গে বন্ধুর সম্পর্ক টিকে যেতে পারে। আর এর উল্টোটা হলে, সম্পর্কের স্বাদ আরও একবার বদলাবে। ফের তেতো হয়ে যাবে তুমি। তবে এই তেতো হয়ে যাওয়া অন্যদিকেও ইঙ্গিত করে, বলছেন গবেষকরা। সম্পর্কের তলে তলে তখনও প্রেম বিরাজমান।
কিন্তু প্রেমের এই তলানিটুকুও বাঁচবে না যদি তোমার প্রাক্তনী একবার ঘুনাক্ষরেও টের পায়, বিচ্ছেদের পরেও প্রাক্তন তার প্রেমে পাগল। সে তখন তোমাকে এড়িয়ে চলবে। কল করলে মোবাইল ধরবে না। তোমার ফেসবুক স্টেটাসে লাইক, কমেন্ট কোনটাই করবে না।সরাসরি বয়কটের রাস্তা নেবে।
যতক্ষণ প্রেম ততক্ষণই আমরা। সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার পরমুহূর্তেই আমরা ভেঙে দুই মৌলিক পদার্থ- আমি, তুমি।
তাই আগেভাগেই প্রাক্তনকে সাবধান করেছে ফ্র্যাঙ্কি। প্রেমিক থেকে যে মুহূর্তে তোমার জায়গা হলো বন্ধুবান্ধবের দলে, কেটে পড়ো। একবারের জন্যও ফিরে তাকানো মানা। কোনওরকম যোগাযোগ রাখা চলবে না। এমনকি বার্থ ডে উইশ করাও চলবে না। পাঁচিল তুলে দাও নিজের চারধারে। এরপরেও যদি মোবাইল কল আসে, সাফ কথায় জানিয়ে দাও- অনেক হয়েছে। থাকতে হলে প্রেমিকা হয়েই থাকো। তবে কোনরকম চাপাচাপি না, ঝুলাঝুলিও না। তোমার অপেক্ষায় তখন অন্য কোনও সুন্দরী অপেক্ষা করছে। তার হাত চেপে ধরো শক্ত করে।
প্রেমিকার মন আকাশের মতো। উদার অপার। সেখানে কতজনের ঠাই হবে, ভেবে মাথা খারাপ করার দরকার নেই। ঘন ঘন আকাশের রং বদলায়। প্রেমিক হয়ে যায় বন্ধু। আবার বন্ধু হয়ে যায় প্রেমিক।
পারলে নিজেকে মানিয়ে নাও। নইলে ভোগে যাও।
- হু কেয়ার্স?
তবে যাই করো, প্রাক্তনীকে বান্ধবী করার ঝুঁকি নিয়ো না।
চিত্র কৃতজ্ঞতাঃ সংগৃহীত
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন