আমাদের খুব কাছের মঙ্গল।তাকে নিয়ে কৌতুহল এর শেষ নেই।এই মঙ্গলের প্রেমেই পাগল তন্বী অ্যালিসা।তাকে আমাদের সঙ্গে পরিচয় করালেন কাজল ভট্টাচার্য

 

মঙ্গলপ্রেমে পাগল সুন্দরী অ্যালিসা




কাজল ভট্টাচার্য,  কলকাতা:

কানু অদর্শনে আকুল রাই বিনোদিনী।
 ঠিক তেমনি মঙ্গল অদর্শনে আকুল অ্যালিসা।

সবে আঠারো পেরোলো অ্যালিসা। সদ্যতরুণী। এক আজগুবি মেয়ে। তাও আবার আমেরিকার। উচ্ছল যৌবনের স্বর্গভূমি।

না, ডেটিংয়ে যাবে না সেই মেয়ে। কাঁপবে না লজ্জা জড়ানো ছন্দেও। রাত জেগে পার্টি করবে না। মলে শপিং করতে যাবে না। সবকিছুতেই 'না'। শুধু একটা ব্যাপারেই 'হ্যাঁ'। সে যাবে লালগ্রহে। ব্যাস ওই একটাই টার্গেট। পৃথিবী থেকে বহুদূরের ওই রহস্যময় লালগ্রহই রয়েছে তার মনজুড়ে। এক কিশোরীর নিষ্কাম প্রেমকাহিনী।

মাল্টিপ্লেক্সের সিনেমাতেও তেমন আগ্রহ নেই। হলিউডে উঁকিঝুঁকি মেরেছে বলেও শোনা যায় না। তবু সে আমেরিকার স্টার। 
অষ্টাদশী অ্যালিসা কার্সন। মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র নাসাতে তাকে সবাই চেনে 'ব্লুবেরি' নামে। বাড়ি লুইসিয়ানার হ্যামন্ডে। কিশোরীর মঙ্গলপ্রেম দেখে তাজ্জব হয়ে গেছিলেন তাবড়-তাবড় মহাকাশবিজ্ঞানীরা।

এই দামাল তরুণী তৈরি হচ্ছে মঙ্গলে পাড়ি জমাতে। জন্ম  ২০০১ সালের ১০ মার্চ। কোনও বয়ফ্রেন্ডের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে না সুন্দরী অ্যালিসা। আর খাবেই বা কী করে? ওসবে তার মানা। অ্যালিসার মনে রং ধরেছে লালগ্রহের।
মেয়ের মনের খবর জানতে পেরে, বাবা বার্ট কার্সনের তো মাথায় হাত। মেয়ে বলেটা কী! পেশায় ফ্রি ল্যান্স ফটোগ্রাফার বার্ট বলেন, "তেমন ভাবে জমিয়ে কোনদিন সংসার করতে পারিনি। মেয়েকে নিজে হাতেই বড়ো করেছি। সিঙ্গল পেরেন্ট। সারা পৃথিবীতে চক্কর মেরে বেড়াতাম ক্যামেরা কাঁধে।" 
মেয়েতো আবার আরও কয়েক কাঠি ওপরে। সে পৃথিবীর গন্ডি টপকে একেবারে বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের টানে ছুটে যেতে চায়।

"আমি তখন বেশ ছোট," বলে অ্যালিসা। "মাথার মধ্যে অনেক কিছুই ঘুরঘুর করতো। কখনও ভাবতাম টিচার হবো, আবার কখনও প্রেসিডেন্ট। তারপর এক সময় ঠিক করলাম, আগে মঙ্গলে যাব। সেখান থেকে ফিরে টিচার বা প্রেসিডেন্ট যাই হোক, কিছু একটা হবো।"
হঠাত মঙ্গলে যাওয়ার কথা মাথায় ভর করলো কিভাবে? 
অ্যালিসার 'ওয়েবসাইট নাসা ব্লুবেরি' জানাচ্ছে,
টিভির কার্টুন নেটওয়ার্ক 'দ্য ব্যাকয়ার্ডিগান্স' সিরিজের 'মিশন টু মার্স' এপিসোড দেখেই চোখ ছানাবড়া হয়ে গেছিল ছোট্ট অ্যালিসার। একদল কচিকাচার মঙ্গলে স্বপ্নের সফর। তখন কতই বা বয়স অ্যালিসার! মেরেকেটে বছর তিন চার। 
সেই কাঁচা, তুলতুলে মনে লাল ছোপ লেগে গেছিল মঙ্গলের। ধীরে ধীরে তা পাকা হতে হতে অ্যালিসা পৌঁছলো আট নয়ে। ততদিনে মঙ্গলের প্রেমে হাবুডুবু সে। স্বপ্নের সফর না, জেদ চেপে গেল মঙ্গলে যেতেই হবে। 



যেই ভাবা সেই কাজ। 
এদিক- সেদিক থেকে ছোট্ট অ্যালিস জোগাড় করে ফেললো, লালগ্রহের গাদাগুচ্ছের সব ভিডিও। এমনকি নিজের ছোট্ট ঘরটাকেই মঙ্গল বানিয়ে ছাড়ল। মঙ্গলের এক বিশাল ম্যাপ ঝোলাল নিজের ঘরের দেওয়ালে। বাবা বার্ট কার্সন বলেন, "অ্যালিসার ঘরের যে দিকেই তাকান, মিশন টু মার্সের পোস্টারে-পোস্টারে ছয়লাপ।" সেই থেকেই মেয়ের কল্পলোকের মঙ্গলবাস।

অগত্যা, মেয়ের স্বপ্নপূরণে এগিয়ে এলেন বাবা। অ্যালিসা তখন সবে সাত। মিস্টার কার্সন মেয়েকে ভর্তি করে দিলেন ইউনাইটেড স্পেস ক্যাম্পে। সেখানেই হয়ে গেল মঙ্গলযাত্রার হাতেখড়ি। কঠিন তপস্যার শুরু। তপস্যায় সিদ্ধিলাভ হলে, মঙ্গলের কোলে পৌঁছে যাবে অ্যালিসা। লালগ্রহে পৃথিবীবাসীর প্রথম অতিথি হবে অ্যালিসা ওরফে 'ব্লুবেরি'। 

উৎসাহে টগবগ সদ্যতরুণী। একটা করে দিন যায়, আর একটু একটু করে এগিয়ে আসে স্বপ্নপূরণের দিন। স্বপ্ন নিয়ে এক ভারী সুন্দর কথা বলেছিলেন আমাদের প্রাক্তন 'মিসাইল ম্যান', রাষ্ট্রপতি ডক্টর এপিজে আবদুল কালাম।
"ঘুমিয়ে যা দেখি সেটা স্বপ্ন না। স্বপ্ন সেটাই যা তোমাকে ঘুমোতে দেয় না।" 
অ্যালিসা যেন অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেছে সে কথা। চোখ বন্ধ করে মঙ্গলযাত্রার স্বপ্ন দেখেনি সে। দেখেছিল ড্যাবডেবে চোখে তাকিয়ে। সেই কোন মেয়েবেলাতেই ছোট্ট অবুঝ অ্যালিসার রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল লালগ্রহ।

মঙ্গলপ্রেম যেন তাড়া করে বেড়াত সেই কিশোরীকে। স্পেস নিয়ে যেখানে যতো অনুষ্ঠান, সব জায়গাতেই ছুটে যেত অ্যালিসা। এরপর সোজা নাসায়। সেখানে পাসপোর্ট প্রোগ্রাম সম্পূর্ণ করা। নাসার মোট চোদ্দটা ভিজিটার্স সেন্টার। প্রতিটা জায়গায় ঘুরে পাসপোর্টে সীলমোহর দাগানো হলে, তবেই ওই প্রোগ্রাম সম্পূর্ণ। মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই সেই চোদ্দটা হার্ডল পেরিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলো অ্যালিসা।
শুধু অধ্যাবসায় না। নিষ্ঠাও না। একমাত্র ভালবাসাই পারে অসাধ্যসাধন করতে।

এরপর শুরু হলো কিশোরীর 'পোলার অরবিটাল সায়ন্স ইন দ্য আপার মেসোস্ফিয়ার', সংক্ষেপে 'পোশাম'- এর অ্যাস্ট্রোনটের শিক্ষানবিশি। সঙ্গে আনুষঙ্গিক অন্যান্য ট্রেনিং। নাসার মানববাহী অথবা মানববিহীন মহাকাশযানের খুঁটিনাটি, মাইক্রো গ্র্যাভিটি সম্পর্কে হাতেকলমে শিখে নেওয়া। ব্যাপারগুলি মোটেই হেলাফেলার না। সব মিলিয়ে প্রায় বছর তিনেক মহাকাশে কাটানো। তার প্রতিটা মুহুর্তে কাজে লাগবে ওই শিক্ষা। 

মঙ্গলযাত্রার স্বপ্নপূরণ করতে গিয়ে, জীবনের চলার ধারাটাই বদলে ফেলতে হয়েছে অ্যালিসার। এমনিতে মিউজিক ভালবাসে সে। টিভি'র কুকিং শো তার প্রিয়। আর ভালবাসে বন্ধুদের সঙ্গে চুটিয়ে আড্ডা। কিন্তু প্রেমে জড়িয়ে পড়তে মানা। মন দেওয়া- নেওয়ায় কড়া নিষেধাজ্ঞা। প্রেম শুধু একজনেরই সঙ্গে। সেই একমুখী প্রেমের নাম- মঙ্গলপ্রেম। ঘরবাঁধা, মা হওয়া, ওসবতো স্বপ্নেরও অতীত।
কেন? কারণ, মঙ্গলযাত্রায় কোনও পিছুটান থাকা চলবে না। প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না মন উতলা হওয়ার। সামান্যতম বিচলতাও ডেকে আনতে পারে সর্বনাশ।
যাত্রার গোটা পর্বটাই বেশ ঝুঁকির। পদে পদে বিপদ। তাই প্রেম- টেম তোলা থাকুক ধরাধামে ফিরে আসা পর্যন্ত।

যাত্রাপথটাও নেহাত কম না। অকল্পনীয়ও বলা যেতে পারে। তবে মহাকাশবিজ্ঞান প্রযুক্তি সেই অসাধ্যকেও সম্ভব করেছে। প্রতি 26 মাস অন্তর পৃথিবীর ডাকে সাড়া দেয় মঙ্গল। চলে আসে বেশ কিছুটা সামনাসামনি। তখন এই দুই গ্রহের মধ্যের দূরত্বটা দাঁড়ায়  পাঁচ কোটি সত্তর লক্ষ কিলোমিটার। পৃথিবী থেকে ওড়ার পর দেড়শো থেকে তিনশো দিন পর্যন্ত লাগতে পারে দূরের ওই লালগ্রহে পৌঁছতে। নিকষ কালো অন্ধকার, আর স্তব্ধতার বুক চিরে উল্কাগতিতে শুধুই এগিয়ে যাওয়া। পেরিয়ে যাওয়া আমাদের চিরচেনা ছায়াপথ। 



কবে ফিরবে অ্যালিসা? আদৌ ফিরতে পারবেন কিনা, তারও কোনও গ্যারান্টি নেই। হতে পারে মঙ্গলের দেহেই বিলীন হয়ে যাবে অ্যালিনা। আবার নির্বিঘ্নে ফিরে আসতে পারে নিজবাসে।

এসব কথায় পাত্তাই দেয় না অ্যালিসা। সে অভিষ্টের দিকে এগিয়ে চলেছে মসৃণ গতিতে। এখন শুধুই নিত্যনতুন ট্রেনিং, ট্রেনিং আর ট্রেনিং। মহাযাত্রার আগে এক ব্যাপক প্রস্তুতি। সামনে শুধুই পাখির চোখ- লালগ্রহ। একনিষ্ঠ প্রেম।

২০১৬ সালেই  হাতে চলে এসছে 'অ্যাডভান্স পোসাম অ্যাকাডেমি'র স্নাতকের শংসাপত্র। অ্যাকাডেমির কনিষ্ঠতম স্নাতক। এই শংসাপত্র হাতে আসা মানেই মহাকাশযাত্রার জন্য জরুরি অ্যাস্ট্রোনট ট্রেনিংয়ের ছাড়পত্র পেয়ে যাওয়া। তবে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল বয়স। কারণ আঠারোর আগে ওই ট্রেনিংয়ের জন্য আবেদন করা যায় না। সময়ের ঘড়িতে সেই বাধাও এবার কাটলো। 

ইন্টারন্যাশনাল স্পেস ইউনিভার্সিটিতে আবেদন করতে আর কোনও বাধা থাকলো না অ্যালিসার। সবকিছু ঠিকঠাক চললে আরও তেরো বছরের অপেক্ষা। তারপর ২০৩৩ সালে পৃথিবীকে বিদায় জানিয়ে মঙ্গলের কাছে ছুটে যাবে অ্যালিসা। কিশোরীর নিষ্কাম প্রেম পাবে পূর্ণতা। ততদিনে অবশ্য অ্যালিসাও বত্রিশের। বছর দু- তিনেক ঘরকন্না করা লালগ্রহে। নানা পরীক্ষা- নিরীক্ষা, গবেষণা। তবে সবচেয়ে গুরুত্ব পাবে মঙ্গলে প্রাণের খোঁজ। বহুদিন ধরেই মানুষের অপার রহস্য ওই সুন্দর লালগ্রহ ঘিরে।

একদিকে মহাকাশযাত্রার প্রস্তুতি, অন্যদিকে হাইস্কুলে অ্যালিসা শিখে নিচ্ছে চারটা ভাষা। ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, চীনা, স্প্যানিশ। কে জানে, মঙ্গলে কারুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে কোন ভাষা কাজে লাগবে।
কথাবার্তাতেও বেশ চৌখস অ্যালিসা। সুযোগ পেলেই সভা- সমিতি অনুষ্ঠানে হাজির হয়। সবাইকে বিশেষ করে টিন এজারদের, উৎসাহ জোগায় মহাকাশযাত্রার। এরজন্য সে তৈরি করে ফেলেছে 'ব্লুবেরি ফাউন্ডেশন'।
"সবসময় নিজের স্বপ্নের পেছনে ছোটো। নইলেই বিপদ। অন্য কেউ ছিনতাই করে নিতে পারে তোমার সাধের স্বপ্ন।" বলে বেড়ায় অ্যালিসা। কোনও ভাবেই কোনও আপোষ নয়। স্বপ্নের পেছনে ছুটতে হবে একবগ্গা ঘোড়ার মতোই। পেছনে তাকানো মানা।
সবকিছু ঠিকঠাক ভাবে চললে অ্যালিসাই হবে মহাকাশে প্রথম টিনএজার। লালগ্রহে মানবজাতির প্রথম প্রতিনিধি। চলছে প্রস্তুতির অন্তিম পর্ব। তারপরেও কিছু অপেক্ষা। শেষ পর্যন্ত পৃথিবী থেকে একদিন মহাকাশে পাড়ি জমাবে অ্যালিসা। পৌঁছে যাবে তার প্রেমের কাছে। প্রেম বলে প্রেম, কিশোরীমনের প্রেম! মঙ্গলও হয়তো আজ অ্যালিসার অপেক্ষায়। 
'মিলন হবে কত দিনে....'

কিন্তু বাবার জন্য মন কাঁদবে না অ্যালিসার? তার কোলেপিঠেই তো মানুষ হওয়া। মিস্টার কার্সন একাই সামলেছেন মেয়েকে। মায়ের প্রশ্রয়, বাবার স্নেহ উজার করে দিয়েছেন। সিঙ্গল পেরেন্ট। 
জীবনের নির্মম সত্যটা সম্ভবত জেনে ফেলেছে অ্যালিসা। পিছুটান থাকলে সাড়া দেওয়া যায় না স্বপ্নের হাতছানিতে।

মন্তব্যসমূহ