বড্ড অসহ্য লাগে এই শ্রাবণ এলেই। অনেকের কাছেই ভীষণ রোমান্টিক।
'এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকে নাতো মন
কাছে যাবো কবে পাবো ওগো তোমার নিমন্ত্রণ...'
সন্ধে নামলেই বারের আলো আঁধারিতে গা ঘেঁষে সুরাপান। তারপরেই বাগবাজারের শুনশান গঙ্গাঘাট। হোক না ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। জমবে ভালো। দুই শরীরের নিমন্ত্রণ। ভোজসভা।
'ওগো তোমার নিমন্ত্রণ!'
শরীর যা শুনতে পায় না তা হলো, নিমন্ত্রণের আড়ালে বেজে চলা বিসর্জনের সুর।
শ্রাবণ। আমার কাছে ভীষণ অপয়া একটা মাস। শ্রাবণের ন'তারিখ। কবি জানতেন সেদিনই শেষ দেখা। আর ফেরা হবে না শান্তিনিকেতনের কাছে। নিমন্ত্রণ চলে এসেছে পরপারের। শরীরের ভার কমাতে কিছুদিন আগেই ছাঁট পড়েছে আমাদের স্টাইলিশ কবি রবীন্দ্রনাথের সাধের চুলদাড়িতে। বেরনোর সময় একটা রোদচশমায় চোখ ঢেকে নিলেন কবি। কেন? বিদায়বেলার মনের আবেগ চোখের কোল বেয়ে ঝরে পড়া লুকাতে।
নিজের পায়ে ভর দিয়ে বেরিয়ে আসতে পারলেন না দীর্ঘদেহী ঋষিপ্রতিম মানুষটা। আধশোয়া অবস্থায় তাঁর বাসভবন থেকে নীচে নামিয়ে আনা হলো। দুধারে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আশ্রমসন্তানরা। চললেন গুরুদেব। পেছনে পড়ে রইলো মহর্ষির স্বপ্নপুরী। ছাতিমতলা। যেখানে প্রাণের আরাম মনের আনন্দ আত্মার শান্তি। সেই শান্তিনিকেতনের জল স্থল বায়ু আকাশ প্রকৃতি, সবার কাছেই বিদায়ের অনুমতি নিয়ে গেলেন কবিগুরু শেষবারের মতো।
বোলপুর স্টেশনে তখন কবির অপেক্ষায় এক বিশেষ ট্রেনের সেলুন কার।
- 'পিছলে বার বিন ইজাজত কে গয়ি থি। ইসবার জানে কা ইজাজত দে দো।'
সেও এক ছোট্ট পাহাড়ি রেল স্টেশন। ঝড়জলের রাত। স্টেশনের ওয়েটিং রুমে বন্দি প্রাক্তনের সঙ্গে প্রাক্তনী। অতীতের গল্পগাছা করতে করতেই রাত পার। সেদিন রাগ অভিমানে কিছু না জানিয়েই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল প্রাক্তনের প্রাক্তনী। কিছুদিন পরেই ডিভোর্স চেয়ে চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছিলো। বিচ্ছেদের পর ফের দেখা সেরাতে রেলস্টেশনের ওয়েটিং রুমে। দুজনেই ধরা পড়ে যায় দুজনের কাছে।
সেরাতেও দুজনে দুজনার কাছে খুঁজে পেয়েছিলো 'প্রাণের আরাম মনের আনন্দ আত্মার শান্তি।' স্মৃতির ডালি তখনও সাজানো। সতেজ। ফুলের তাজা সুবাস সেরাতেও সুগন্ধ ছড়ালো। ভালবাসার ফুল কখনও শুকায় না। মনের গভীরে তা মুখ লুকায়মাত্র।
ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই হাজির প্রাক্তনীর বর্তমান স্বামী। প্রাক্তনীর জীবনের দুই পুরুষ মুখোমুখী। প্রাক্তনের কাছে ফের বিদায় নিলো প্রাক্তনী। এবার বলে কয়ে বিদায়।
- 'আগেরবার না বলেই চলে গেছিলাম। এবার যাওয়ার অনুমতি দাও।'
রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন থেকে নাকি প্রাক্তনী প্রাক্তনের থেকে বিদায় চেয়েছিলো, তা বড়ো কথা নয়। সেই মুহূর্তে মনে হয়েছিলো, না বলেকয়ে যাওয়াটাই ছিলো ভালো। মনের মানুষকে মুখফুটে বিদায় দেওয়া যায় না। শান্তিনিকেতন থেকে কবিগুরুর বিচ্ছেদের সেই ছবিটার সঙ্গে, কোথায় যেন মিলে গেলো 'ইজাজত' সিনেমার শেষদৃশ্যটা। সম্পূর্ণ আলাদা দুটো ছবি। কিন্তু যেন একসুরে বাঁধা। ভালবাসার কাছ থেকে বিদায়।
দেবযানীর কাছে বিদায় চেয়েছিল কচ। সেমুহূর্তে ভেঙে চৌচির হয়ে গিয়েছিল দেবযানীর তিলে তিলে গড়া সাধের দুনিয়াটা। এতদিন কচ তাকে শুধুই ঠকিয়েছে। দেবযানী তবু ধরে রাখতে চায় তার প্রেমকে। শেষ পর্যন্ত নিজের অসহায়তার ওপরেই যেন রেগে উঠলো সে। অভিশাপ দিয়ে বসলো কচকে। যে মৃত সঞ্জীবনী বিদ্যা আয়ত্ত করতে কচ ছলনা করলো, সেই বিদ্যা নিষ্ফল হবে। বিদায়বেলা আসন্ন। এবার স্বর্গে ফিরে যেতে হবে কচকে। শেষ লগ্নে বিদায়বেলার গ্লানি যেন বেদনার স্মৃতি হয়ে না থাকে। তাই কবিগুরু কচকে শান্ত চিত্তে বলালেন-
'আমি বর দিনু দেবী, তুমি সুখী হবে
ভুলে যাবে সর্বগ্লানি বিপুল গৌরবে।'
সুমিত্রাকেও পথের সঙ্গী করতে রাজি হননি ডাক্তার। সেই রাতেও শ্রাবণের অঝোর ধারা। ডাক্তার বিদায় নিলেন সুমিত্রার কাছে। একাই যেতে হয় সেপথে। তাই সুমিত্রার কথায় কান দিলেন না। বৃষ্টির পথ বেয়ে মহাপ্রস্থানের পথে এগিয়ে গেলেন 'সব্যসাচী'র ডাক্তার। অপেক্ষায় রইলো সুমিত্রা। সেখানে আবার বিদায় শেষে পড়ে রইলো এক অনন্ত অপেক্ষা। সব বিদায়ের শেষেই বোধহয় তা থাকে?
ছাতিমতলা হোক অথবা রেল স্টেশনের সেই ছোট্ট ওয়েটিং রুম, অথবা ডাক্তারের জন্য সুমিত্রার, সেই অপেক্ষা কখনও মুখর হয়ে ওঠে না কোথাও। সব বিদায়বেলাই কি শ্রাবণ গগনতলে? আকাশভাঙা বৃষ্টি বেলায়।
সব বিদায়গুলিই বোধহয় একইরকম। এমনকি ফেসবুকের ফ্রেন্ডলিস্ট থেকেও। ইন্টারনেটের ভার্চুয়াল জগতে সে আছে, আমার কাছে নেই। সব কেমন গুলিয়ে একাকার হয়ে যায়। ঠিক যেন ব্ল্যাকবোর্ড থেকে চকের সাদা দাগ মুছে ঝাপসা হয়ে যাওয়ার মতো। তবু কিছু পড়ে রয়। ম্লান হয়ে যায় অতীতের সব গ্লানি। হার মানে তিক্ততা। চারচোখের নজর মিললেই, স্মৃতির কোন সে অতলে তলিয়ে যায় যাবতীয় মান অভিমান। মাথা উঁচু করে ফিরে আসে হারানো প্রেম। সেই স্মৃতিসুধাতেই ভরে ওঠে হৃদয়ের পাত্রখানি। সেই পাত্র উপচে পড়লেই, তাতে চুমুক দিয়ে অমর হয়ে যান সক্রেটিস।
কবিগুরু যাকে স্মৃতিসুধা বলেছেন, আমাদের কাছে অনেক সময়েই তা 'হেমলক'। বিদায়কে মহিমান্বিত করার ক্ষমতা আমাদের নেই। প্রতিটি বিদায়ে রক্তাক্ত হয় আমাদের হৃদয়। তার জ্বালায় নীল হয়ে ওঠে প্রতিটা শরীর। কাতরাতে থাকি যন্ত্রণায়। শ্রাবণের ধারার কী ক্ষমতা যে সেই জ্বালার উপশম করে!
জোড়াসাঁকোর পথে রওনা দিলেন কবি। সেও যেন এক মহাপ্রস্থান। মঞ্চ তৈরি করাই ছিলো। বাইশে শ্রাবণ। দুপুর বারোটা বেজে দশ মিনিট।
কবির নাতবৌ অমিতা ঠাকুরের গলায় কোথায় সেই চির পরিচিত দৃঢ়তা? তাঁর বুজে আসা গলায় তখন ধ্বনিত হচ্ছে কবিগুরুর জীবনের পরম মন্ত্র- 'শান্তম্ শিবম্ অদ্বৈত্যম্!' অগস্ত্যযাত্রার প্রস্তুতি শুরু এবার।
ওই মেঘের রাজ্য পেরিয়ে, আকাশের নীলিমা ভেদ করে কবিগুরুকে পাড়ি দিতে হবে আরও অনেকটা দূরের পথ। যেতে হবে আরও অনেক, অনেক আলোকবর্ষ দূরে। না- ফেরার নগরে। মনখারাপটা ভীষণ চেপে বসে। ভীষণ ভীষণ।
'যেতে পারি কিন্তু কেন যাব?'
ঠিক এমনই কোনও এক বিদায় মুহূর্তে চিরবিচ্ছেদের কথা ভেবেই লিখেছিলেন আমাদের এক বেপরোয়া কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়। প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়ার স্পর্ধা করেছিলেন সম্ভবত বিধাতার দরবারে। উত্তর মেলেনি। কিন্তু যেতে তাঁকেও হয়েছিল। যাওয়ার আগে জীবনের বন্ধ কপাটের সামনে দাঁড়িয়ে বলে গেছিলেন- 'আমার শপথ রেখেছিলাম। তাদের বোলো আমি এসেছিলাম।' 'সব্যসাচী'র ডাক্তারের মতোই, আর একবারও পিছনপানে তাকানো না। বিদায় নিয়েছিলেন বুক ফুলিয়ে ওয়াল্টার ডি লা মেরির সেই অশ্বমেধের ঘোড়ায় সওয়ার টগবগ করে।
তবু কী কনফিডেন্স!
'নতুন নামে ডাকবে মোরে বাঁধবে নতুন বাহু ডোরে
আসব যাব চিরদিনের সেই আমি..'
একেবারে বুকঠুকে জানিয়ে দিয়ে গেছিলেন ঋষিপ্রতিম সেই চরম আধুনিক বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ। এই শক্তি ভালবাসার। পদার্থের এই অবিনাশী তত্ত্ব পদার্থবিজ্ঞানের- শক্তির সৃষ্টি নেই। ধ্বংসও নেই। আছে রূপান্তর। উপনিষদেও সেই একই আস্থা। আত্মা মানেই শক্তি। আত্মা অবিনশ্বর। শোকাতঙ্কে অস্থির অর্জুনকে শ্রীকৃষ্ণের শাশ্বতবাণী-
'অজো নিত্যঃ শ্বাশ্বতোহয়ং পুরানো
ন হন্যমানে শরীরে।'
তবু প্রতিটি আত্মার ছেড়ে যাওয়া শরীরের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে পার্থিব অনেকটা মায়া মমতা স্নেহ আর ভালবাসা। কত অসংখ্য স্মৃতি। প্রেম বিরহের। সুখ দুঃখের। মান অভিমানের।
প্রতিটি যাওয়ার আগে, অবসান হোক সব দ্বন্দ্বের। রাতভর ঝড়বৃষ্টির দাপানোর কথা মনে রাখে না গাছের ওই ছোট্ট সবুজ পাতা। বৃষ্টিশেষে তার বুকে ধরে রাখে একবিন্দু টলটলে মুক্তোকণার মতো জল। ঠিক তেমনই মান অভিমান শেষে মনের গায়ে লেগে থাকুক শুধু একবিন্দু ভালবাসা।
শুদ্ধ নির্মল পবিত্র।
'ভালবেসে সখী নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখো তোমার মনের মন্দিরে।'
প্রতিটি প্রেমিক মনই এক মন্দির। রবীন্দ্রনাথের সেই অমোঘবাণী বিশপের মুখে ফিরে এলো নরম্যান ম্যাকলেনের নাটকে- 'দিস পুয়োর বডি ইজ দ্য টেম্পল অফ লিভিং গড।' জীবন্ত ভগবানের বাস সেই মনের মন্দিরে।
যে শরীরে সেই মনের বাস, তাকেই বা ভুলি কেমনে? তাকে ধরে রাখি গানে, ছবিতে, রংরেখায় মনের ক্যানভাসে। তবু কবি বিষ্ণু দে'র আকূল জিজ্ঞাসা- তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ আর বাইশে শ্রাবণ?
'তবু মনে রেখো!'
শ্রাবণ মানেই যেন বিদায়ের মাস।
বিদায় হে বন্ধু।
বিদায় হে মহাজীবন।
চিত্র সৌজন্যঃ সংগৃহীত
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন