বেহালার দিন প্রতিদিনে আজকের মুচমুচে আলোচনার বিশেষ কলম সাংবাদিক কাজল ভট্টাচার্যের - ' পরকীয়ার বাজারগরম '
পরকীয়ার বাজারগরম
কাজল ভট্টাচার্য
('আয়ারাম গয়ারাম' রাজনীতিতে পরকীয়া সিদ্ধ হলে, শীর্ষ আদালতের সিলমোহরে প্রেমেও পরকীয়া সিদ্ধ। তবে সেক্ষেত্রে স্বামীকুলের কিছু দায়বদ্ধতা থেকে যায়। কিন্তু রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত জীবনের পরকীয়া নিয়ে মিডিয়া ফেলুদার ভূমিকায় কেন?)
শোভন বৈশাখীকে দিয়ে শুরু। এবার টার্গেট কাঞ্চন শ্রীময়ী। ওদিকে আবার পরকীয়ার ঘোড়দৌড়ে সবাইকে পেছনে ফেলে ঝড়ের গতিতে এগিয়ে চলেছেন নুসরত। এঁদের জৌলুসের কাছে চাপা পড়ে গেছেন সৌমিত্র, শমীকরা। ওদিকে মিডিয়ার তালে বাঙালি উদ্বাহু। তার মনের মতো বিষয় আবিষ্কার করে ফেলেছে সে- ইউরেকা ইউরেকা। আগুনে ঘৃতাহুতি দুই মিডিয়ার- নিউজ আর সোশ্যাল।
মহান বিবেকবান জনগণের ভাবখানা এমন- আপনাদের ভোট করে এমএলএ, এমপি বানিয়ে ছেড়েছি। আর যাঁরা এবার পড়ে রইলেন, আগামিবার তাঁদের কথাও নাহয় ভাবা যাবে। এবার যান, রাজনীতি কপচান। আমাদের উন্নয়ন করে সুনিদ্রার জিম্মা আপনাদের। আর ওসব প্রেম, পরকীয়া, টুরু লভ, সংসার ধর্মে জনগণের মানবাধিকার। এবার থেকে আপনারা ওই সব রসে বঞ্চিত। ভোট করে আমরা আপনাদের জনগণের বাইরে বের করে দিয়েছি।
প্রেম করলেই ফালতু। তারপর যদি সে আবার খুল্লম খুল্লা হয় তো আর কথাই নেই। আর সেই প্রেমিক পুরুষ বা মহিলা রাজনৈতিক জগতের হলে তো সবাই একেবারে রে রে করে তেড়ে আসেন। বাংলা নাটক, সিনেমা, বোকাবাক্সের জনপ্রিয় অভিনেতা কাঞ্চনের পরকীয়া নিয়ে এতদিন কেউ কোনও কথা শুনেছিলেন নাকি? উত্তরপাড়া থেকে বিধায়ক নির্বাচিত হওয়ার পরেই জানা গেলো শ্রীময়ী চট্টরাজের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছেন কাঞ্চন মল্লিক।
বসিরহাট থেকে সাংসদ হওয়ার পরেই সবাই নজর কেড়েছিলেন সেই তরুণী, নুসরত জাহান। তাঁর বক্তব্য পেশের সাবলীল ভঙ্গিমায় বোঝার উপায় ছিলো না যে তিনি সিনেমার পর্দা থেকে নেমে, সরাসরি সংসদ ভবনে হাজির হয়েছিলেন।
সেই নুসরত- নিখিল জুটির পরকীয়ার খবরে মেতেছে মিডিয়া। নুসরতের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে যশ দাশগুপ্তর নাম। ওদিকে নিখিলে জৈনের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে অভিনেত্রী ত্রিধা চৌধুরীর নাম। সেই সঙ্গে জন্মের আগেই রহস্যের আবর্তে নুসরতের হবু সন্তান।
নিজেরই দলের এক নেত্রীর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কের কথা শোনা গিয়েছিলো বসিরহাট দক্ষিণের প্রাক্তন বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যের।
আবার বিষ্ণুপুরের সাংসদ সৌমিত্র খাঁয়ের ঘটনা খানিকটা অন্যরকম। তাঁর বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠেছিল পরকীয়ার। তবে সৌমিত্রর পরকীয়া কোনও মহিলার সঙ্গে নয়, রাজনৈতিক দলের সঙ্গে। রাজনীতির দলবদলের খেসারত দিতে অকাল অবসান হয়েছিল সৌমিত্র খাঁ, সুজাতা মণ্ডলের সুখী দাম্পত্যের।
শোভন চট্টোপাধ্যায়, কাঞ্চন মল্লিক, সৌমিত্র খাঁ, এই রাজনৈতিক ত্রয়ীর মিল এক জায়গাতেই। তিনজনের বিরুদ্ধেই মুখর হয়েছেন তাঁদের ঘরণীরা।
যতগুলি ঘটনার কথা বললাম, সবগুলোই পরকীয়া আর রাজনীতির মিশেলে ঘেঁটে 'ঘ'। কী বলবো এঁকে প্রেম- রাজনীতির 'মিক্সড পরকীয়া?'
প্রেমের আনুগত্য বদল হয়েছে। আবার কোথাও রাজনৈতিক আনুগত্য বদল হয়েছে। প্রেমের আনুগত্য বদল মানে পরকীয়া। শীর্ষ আদালতের সিলমোহর গায়ে লাগিয়ে তা আইনসিদ্ধ।
আর 'আয়ারাম গয়ারাম'দের সৌজন্যে রাজনৈতিক আনুগত্য বদলও রাজনৈতিক সিদ্ধ আগেভাগেই হয়েছে।
রাজনৈতিক শিবির বদল নিয়ে শোরগোল হওয়াটাই কাম্য। কারণ রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িয়ে বাংলা বাঙালির স্বার্থ। কিন্তু প্রেম বা পরকীয়া যাই হোক না কেন, সেসব তো একান্তই ব্যক্তিগত।
আর প্রেমেই বা এতো ছুৎমার্গ কেন? প্রেম কি মানবসভ্যতার জারজ উৎপাদন? নাকি প্রেম অন্ত্যজ, বর্ণ বিচারে নিকৃষ্ট? তাহলে জনতার আদালতের এই বাড়াবাড়ি রকমের উৎসাহ কি সেই আদি রসাত্মক?
শোভন বৈশাখীকে নিয়ে কীই না বলেছেন। এমনকি তাঁদের চেহারা নিয়েও মস্করা করতে ছাড়েননি। আবার এখন সেই মস্করার 'নয়া মশালা' কাঞ্চন শ্রীময়ী। প্রথম জুটি বেশ ওজনদার, দ্বিতীয় জুটি পলকা, ফুরফুরে। দুয়েতেই আপত্তি জনগণের। কেন মশাই? জনগণ মানেই কি সব এক একজন আলেকজান্ডারের মতো সুপুরুষ? কম করে আশি পার্সেন্টই তো পেটরোগা বাঙালি।
আবার শোভন বৈশাখীর ব্যাপারটা যে পরকীয়া তা প্রকারান্তরে মেনেই নিয়েছেন বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বামী মনোজিত মণ্ডল। 'এখন তো পরকীয়াও আইনসিদ্ধ,' সরাসরি জানিয়েছেন তিনি। কিন্তু মনোজিতবাবু মানলে কী হবে, বাঙালি মানবে না।
তবে শোভন, বৈশাখী বরাবরই দাবি করে এসছেন তাঁরা বন্ধু বৈ আরকিছু নয়। হতেই পারেন তাঁরা দ্রৌপদী, শ্রীকৃষ্ণের মতো নির্ভেজাল সখা সখী। তবে যে সমাজে প্রেম করাটা শুরু হয় অমুকদা আর তমুকদার ডাকে, সেখানে সখাসখীর ব্যাপারটা হজম হওয়া শুধু মুশকিলই না, অসম্ভবও। আর সেটা ইতিমধ্যেই প্রমাণিত।
তবে চোখ কপালে তখনই ওঠে যখন রাজনীতির লোকজন শোভন- বৈশাখী হোক বা নুসরত- যশ, কাঞ্চন- শ্রীময়ী, সৌমিত্র- সুজাতাকে নিয়ে মুখ খোলেন।
রাজনীতিতে তো দিব্য একদলের টিকিটে জিতে, অন্য দলে ভিড়ে যাওয়া যায়। সেই 'আয়ারাম গয়ারাম'রা রাজনীতির সিদ্ধ মহাপুরুষ হতে পারলে এঁরাই বা কেন পারবেন না? আপাদমস্তক রাজনীতির এই মানুষরা রাজনীতিরই ওই তত্ত্বকে প্রেমেও যদি অ্যাপ্লাই করে থাকেন, তো কোন মহাভারতটা অশুদ্ধ হলো?
ওদিকে কাঞ্চন শ্রীময়ীরাও কিন্তু বারেবারে বলে চলেছেন, তাঁদের মধ্যে কোনও রোমান্স চলছে না। এমনকি তারা সখাসখীও না। জাস্ট সহকর্মী বা পরিচিত।
কিন্তু তারচেয়েও বড়ো কথা এঁদের ব্যক্তি জীবনকে রাজনীতির সঙ্গেই বা জড়িয়ে ফেলবেন কেন? প্রেম করতে গিয়ে যদি কেউ বিধানসভা বা সংসদের অধিবেশন মিস করেন, তখন নাহয় যা বলার বলবেন।
পুরুষ রাজনীতিবিদদের সঙ্গে মহিলাদের নাম জড়িয়ে আদি রসাত্মক খেলাটা কিন্তু আজকের নয়। এ এক আদি ঘরানা বঙ্গ রাজনীতির।
'বাংলার কুলনারী হও সাবধান
বাংলার মসনদে নলিনী বিধান।'
নিজের জমজমাট প্র্যাকটিস ছেড়ে চিকিৎসক বিধানচন্দ্র রায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর হাওড়া, কলকাতার দেওয়ালে কুৎসা প্রচার চলেছিল।
পরবর্তীতে মুখরোচক গল্প শোনা গিয়েছিলো জ্যোতি বসু, ইন্দিরা গাঁধিকে নিয়েও।
তবে এই পরকীয়ার কিসসা যে শুধু বাংলাতেই হয়, মোটেই তা নয়। দিল্লির দেওয়ালে কান পাতলে একসময় শোনা যেত নেহরু, এডুইনা মাউন্টব্যাটেনের প্রেমকাহিনী। এমনকি আজও নরেন্দ্র মোদির দাম্পত্য জীবন নিয়ে মানুষ আজগুবি সব মন্তব্য করে বসেন।
বাঙালির প্রেম বলতে ট্র্যাজেডি। মিলন নয় বিচ্ছেদ। কংগ্রেস থেকে যুক্তফ্রন্ট, বামফ্রন্ট হয়ে আজ তৃণমূল কংগ্রেস। এভাবেই বাংলার রাজনৈতিক পালাবদল হয়েছে গত তিয়াত্তর বছরেরও বেশি সময় ধরে। বঙ্গ রাজনীতির হাওয়ামোরগের মুখ খুব যে ঘন ঘন ঘুরেছে এমনটা নয়। তবে রাজনীতি বনাম প্রেম ভালবাসা, পরকীয়া নিয়ে বাঙালির কনসেপসন একেবারে একই জায়গায় থমকে দাঁড়িয়ে।
প্রমথেশ- যমুনা বড়ুয়া, উত্তম- সুচিত্রা থেকে তাপস- দেবশ্রী পর্যন্ত সেলুলয়েডে বাঙালির প্রেম মোটামুটি শান্তশিষ্ট, 'কামগন্ধ নাহি তায়' মার্কা। এরপর প্রসেনজিত ঋতুপর্ণা, দেব শ্রাবন্তী, জিত কোয়েল জুটি বেশ খানিকটা খোলামেলা হলো। তাতে বাঙালি সাময়িক রসাসিক্ত হলেও, ভাবজগতে তেমন কিছু বদল এলো না।
ওদিকে আবার বাঙালির সবকিছুতেই রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু সেই রবীন্দ্রনাথের 'শেষের কবিতা'র আধুনিক ঝকঝকে প্রেমও বাঙালি হজম করতে পারেনি। বরং কবিগুরুর 'নষ্টনীড়' বাঙালির কাছে প্রিয়। সহজবোধ্য।
শরৎচন্দ্র নিজে যেমনই উদ্দাম, বেপরোয়া রোমান্সে জীবন কাটান না কেন, বাঙালির দুর্বল পিলের খবর তিনি রাখতেন। আর তাই তিনি উদ্দাম প্রেমের গল্প না শুনিয়ে, শুনিয়েছিলেন দেবদাস পার্বতীর বিচ্ছেদের গল্প।
- 'ওই বইটা একেবারে মাতাল হইয়া বোতল খাইয়া লেখা,' বন্ধু প্রমথনাথ ভট্টাচার্যকে লিখেছিলেন শরৎচন্দ্র।
সেই গল্পই বাঙালির মনে কাঁকড়াবিছের মতো এমন ধরার ধরলো যে সেই নির্বাক যুগ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত টলিউডে সম্ভবত মোট সাতবার রিমেক হয়েছে দেবদাসের।
শোভন বৈশাখীর নির্ভেজাল বন্ধুত্বকে বাঙালি কখনোই সাদাচোখে দেখতে পারেনি। বরং ওই দুজনের মধ্যে দেবদাস পার্বতীর ছায়া দেখতে পেয়েছিল। তবুও ওই দুজনকে নিয়ে চায়ের কাপে তুফান কেন?
কারণ শোভন বৈশাখীর বেপরোয়া অ্যাপ্রোচ। তাঁদের সখ্যতা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করেননি। বাঙালির আইডল দেবদাসবাবু কখনোই শোভনবাবুর মতো বৈশাখীকে পাশে নিয়ে ঘোরার স্পর্ধা দেখাতে পারেননি। পার্বতী দেবীও বৈশাখী দেবীর মতো ঘর সংসারকে 'ধুত্তেরি' বলে ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারেননি। আর এখানেই জোর ধাক্কা খেয়েছে বাঙালি।
ওদিকে আবার সাংসদ নুসরত, বিধায়ক কাঞ্চনকে নিয়েও হাওয়া বেজায় গরম। সবমিলিয়ে পরকীয়া রাজনীতির হা ডু ডু খেলা এখন বেশ জমজমাট।
ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে কিন্তু প্রেমের সঙ্গে রাজনীতির কণামাত্র বিরোধ নেই। কুরুক্ষেত্রের নায়ক শ্রীকৃষ্ণ যেমন চুটিয়ে রগরগে প্রেম, পরকীয়া সবই করেছেন, ঠিক তেমনই রাজনীতিতে পাশার দানও চেলেছেন। তাঁর শ্রীমুখের হাসি শান দেওয়া ছুড়ির ফলার মতো বিদীর্ণ করেছে শতরমনীর বক্ষ।
প্রেমের শিরোমণি নদের নিমাই। গবেষকরা বলছেন, ওই প্রেমের ঢেউয়েই সূচনা হয়েছিল বাংলার প্রথম জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের। প্রেম, রাজনীতি মিলেমিশে একাকার। সেই ঐতিহ্যও শস্যশ্যামলা এই বাংলা, বাঙালির।
ফিরে আসুক বঙ্গপ্রেমের আদি ঐতিহ্য। যে প্রেম সবাইকে আপন করে নেয়। সেই প্রেম মিশে যাক বঙ্গ রাজনীতিতে। মিটে যাক প্রেম, পরকীয়ার বিতর্কের সাগরে হাবুডুবু খাওয়া রাজনীতিবিদদের যাবতীয় সমস্যা। প্রেমতরঙ্গে ভেসে যাক রাজনীতির আকচা আকচি। চুলোয় যাক অপ্রেম। অতঃপর হাসি ফুটুক রাজনীতিবিদদের গোমড়ামুখে। প্রেমে পরিপূর্ণ নেতা, মন্ত্রীদের হৃদয়ের ছোঁয়ায় বাংলা হয়ে উঠুক সোনার বাংলা।
চিত্রঃ সংগৃহীত
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন