বেহালার দিন প্রতিদিনে এক অন্য অনুভুতির বিশেষ কলম সাংবাদিক কাজল ভট্টাচার্যের - ' খোঁচার মার '

 বিশেষ কলম


খোঁচার মার



     কাজল ভট্টাচার্য


খোঁচার দাম সাতটাকা।
সকাল সকাল খোঁচা খেলেন? লেখাটা ঘেঁটে 'ঘ'। ওদিকে লেখাটা পাঠাবার জন্য তাড়া খাচ্ছেন। চাপে পড়ে গেলেন তো?

খোঁচারও রকমফের আছে।
কিছু খোঁচা সরাসরি।
- 'না বুঝে উল্টোপাল্টা বকিস না তো।'
এ হলো 'মুখর খোঁচা' বা বাক্যবাণ। মতে না মিললেই খেতে হয়। তবে ওই খোঁচার ধার কম। তাই গায়ের জ্বালাটাও সেরকম টেকসই হয় না। খোঁচা প্রজাতির মারাত্মক হলো 'মৌন খোঁচা'।

হোয়াপে টুং করে মেসেজ ঢুকলো।
- 'কিরে, ডিনার করলি? এগারোটা বাজলো তো।'
খুশিতে ডগমগ আপনি। একজন ঠিক আপনার খোঁজ নেয়। ব্যস্তসমস্ত আপনি পত্রপাঠ জবাব দিলেন।
- 'আজ ভালোই খেয়েছি রে। রুটি পনির অমলেট।'

পড়ে রইলো আপনার জবাবী মেসেজ। মিনিট পাঁচেক গেলো। প্রশ্নকর্তা অনলাইন। আপনিও ফেসবুকে ঘোরাঘুরি করে, পনেরো কুড়ি মিনিট পরে ফের দেখলেন। তখনও আপনার মেসেজ গড়াগড়ি খাচ্ছে।
আধঘণ্টা খানেক পেরনোর পর বুঝতে পারলেন, প্রশ্নটা নেহাত প্রশ্নই ছিলো। আপনার ডিনার করা হলো কিনা জানতে দুনিয়ায় কারুর কোনও মাথাব্যথা ছিলো না। তা নাই বা থাকুক, ওসব গায়ের আঁচড় এক ফুঁয়েই উড়ে যায়। কিন্তু মানুষটা যদি কাছের হয়?
যে মানুষের বাস মনের যতো গভীরে, তার খোঁচাও তত তীব্র। তার নখের সামান্যতম আঁচড়েও গভীর ক্ষত মনের কোটরে।
তাহলে বাপু অমন জিজ্ঞেস করা কেন?
ওটাই হলো 'মৌন খোঁচা'। চোরাগোপ্তা কিলের মতো। চুপচাপ হজম করতে হয়।

বেশ।
প্রথমেই দেখুন ফ্লাস্কে চা আছে কিনা?
থাকলে এক কাপ মেরে দিন। তরল আগুনের ছ্যাঁকায় খানিকটা হলেও সজুত হবে সেই জব্বর খোঁচা। সেই সঙ্গে শুরু হয়ে যাবে হজমের প্রক্রিয়া।
এবার একটা সিগারেট ধরান। কমপক্ষে সাতটাকা ফুঁকেই উড়িয়ে দিন। আরেকটু বেশি দামের ব্র্যান্ড হলে আরও ভালো। তবে ঘনঘন ফুঁকতে হলে তার উপায় নেই। লকডাউনের বাজার। সাধারণের পকেট তো কমবেশি গড়ের মাঠ।
'হর ফিক্র কো ধুঁয়ে মে উড়াতা চলা গয়া।'
ষাট দশকের বিখ্যাত সেই গান। সিগারেটের মৌতাত করতে করতে চলেছেন দেবানন্দ। গরমাগরম চায়ের ছ্যাঁকা আর সিগারেটের ধোঁয়ার চাপে খোঁচার যন্ত্রণার, অন্তত সাময়িক উপশম হবে।

ফুঁকে টাকা ওড়ানোর মজাই আলাদা।
এবার একটা বাদশাহি মেজাজ এসছে তো? আরে মশাই মেজাজটাই সব। গুরুর লিপে মান্নার সেই ঝড় তোলা গান- 'মেজাজটাই তো আসল রাজা, আমি রাজা নই।' সেই মেজাজই এবার হড়হড় করে শব্দ উগরে দেবে। আপনি জাস্ট সাজিয়ে নিন। ব্যাস আপনার কপি ফিনিশড।



ভুল করে ফেলি অন্য জায়গায়।
মেজাজটাকে রাজা না ভেবে, নিজেকেই রাজা ভেবে বসি। একটু আধটু প্রশ্রয় পেলেই শাজাহান হয়ে যাই।
'আজ হতে তুমি হৃদয়ের রাজা
তোমারেই আমি করিব গো পূজা।'
সেই রাজারানির যুগ কবেই শেষ। ভুলে যাই, যুগটা বেলা বোসের। তারপরেও 'গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল'! আর সেখানেই শুরু তড়পানোর।
যে অল্পেই তড়পায়, তাকে তড়পানোতেই মানুষ মজা পায়।

তাই নিজের রাজা হওয়া চলবে না।
মেজাজকে রাজার আসনে বসাতে হবে। বাদশাহি মেজাজ অনেকটা সেই রাজহংসের মতো। পাখায় পাক লাগে না। সেই মেজাজেও খোঁচার দাগ লাগে না। ইগনোর আর ইগনোর। বেগড়বাই কিছু দেখলেই ইগনোর। জীবনে সবকিছুকে অতো পাত্তা দিলে চলে নাকি?
রাজা বাদশার মেজাজের একটাই অনুভূতি- মেজাজ। সাতরঙি মেজাজ। ঘুড়ির মতো। শুধুই উড়তে জানে। একবার এআকাশে আরেকবার ওআকাশে। রাজার মতো তার মেজাজের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় নেই। তাই অনুভূতিও ভোঁতা।

বাস্তবের দুনিয়ায় নিক্তির মাপে খানিক আবেগ অনুভূতি থাকলেও, ম্যানেজ করা যেতে পারে। কিন্তু তা এক আধ মিলিগ্রাম বেশি হলেই সব্বনাশ। পান থেকে চুন খসলেই খোঁচা। বারেবারে খোঁচা। প্রথমে যদিও বা দু চারটা হজম করতে পারেন, পরে বদহজম হবে। ঢেঁকুর উঠবে। গলাজ্বালা করবে। বিচ্ছিরি টকটক স্বাদ। মন কেমন কেমন। প্রাণ আইঢাই। তখনই ধোঁয়া দিয়ে সেই খোঁচাকে সরাসরি পাচন যন্ত্রে পাঠানো।
সেখানেও বিপদ। ধোঁয়ার ঠেলাতে শ্বাসকষ্ট হতে পারে। তখন সুরাপান। অ্যালকোহলে গলা জ্বালা করতে পারে। কিন্তু গলার জ্বালা থেকে বুকের জ্বালা অনেকবেশি মারাত্মক। যন্ত্রণার।
খোঁচার বিষের জ্বালা শান্ত করতে জোড়া বিষের দাওয়াই। নিকোটিনের বিষ, অ্যালকোহলের বিষ। সবমিলিয়ে, বিষে বিষক্ষয়ের পাগলামো।

এই খোঁচা অবহেলার।
তবে শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা অনেকসময় বুমেরাং হয়ে দাঁড়ায়। যে অবহেলা করে সেই শিখিয়ে দেয় অবহেলার কায়দাবাজিগুলো। একটা সময় আসে যখন সারাশরীর মনে অবহেলার দগদগে ঘা নিয়ে, মানুষটার পিঠ দেওয়ালে ঠেকে যায়। আর ঠিক তারপরেই এতদিন অবহেলার শিকার হওয়া মানুষটা ঘুরে দাঁড়ায়।
তখনই চাপা আগুন জ্বলে ওঠে মনে। সেই আগুনের জ্বালায় তুচ্ছ হয়ে যায় এতদিনের খোঁচার জ্বালা, যন্ত্রণা। খোঁচার তীব্রতা। ততদিনে সেল্ফ ইমিউনিটি তৈরি করে ফেলে শরীর। খোঁচাবান্ধব হয়ে যায় মন। তখন আর ওসব ধোঁয়া টোঁয়া বা অ্যালকোহলের দরকার পড়ে না।

খোঁচার পুরনো ক্ষতও একসময় শুকিয়ে আসে। সময়ের মলম ম্যাজিক দেখায়। ক্ষতের গায়ে নতুন চামড়া গজায়। তখন একটু চুলকুনি হয় বটে। পরে চামড়ায় ঢাকা পড়লে সেটুকুও উধাও হয়ে যায়।
শেষ পর্যন্ত শরীর মনের ফোলডারে ডিলিট মারা হয়ে যায়। ওয়েস্ট বক্সের বিনে আবেগে জমা পড়ে সেই সাতপুরনো খোঁচার যন্ত্রণা। হঠাতই কোনও একদিন শতকাজের মাঝে তাল কেটে যায়। ফের মন ভারী হয়ে ওঠে কোনও এক সন্ধ্যায়, নিরালা অবেলায়। বুকের বাঁদিক ঘেঁষে চিনচিন করে ওঠে। মনে পড়ে যায় সেই খোঁচার কথা।

পলিমাটির বুক পায়ের ছাপ ধরে রাখে। সেই মাটি দিয়েই ভাস্কর তাঁর মানসমূর্তি গড়েন। বালিমাটির বুকে সেই ধারণ ক্ষমতা নেই। ছাপ পড়লেও বসন্তের পাতার মতো তা সহজেই ঝরে পড়ে।
পলিমাটির উর্বর বুক নিষ্ফলা হয়ে যায় নিকোটিনের চরা পড়ে। কেউ ধোঁয়া দিয়ে মনকে ঘুম পাড়িয়ে রাখে, কেউ সুরা দিয়ে। আচ্ছন্ন হয় আবেগ। ঘুমে ঢলে পড়ে শরীরের প্রতিটি ইন্দ্রিয় প্রত্যন্দ্রিয়, শিরা উপশিরা। অবশ হয়ে আসে সমস্ত সত্তা।

খোঁচার দাম সাতটাকা।
বড্ড সস্তা। খেয়াল রাখুন আপনি বেশি দাম দিয়ে ফেলছেন নাতো! সাতটাকার বিষে খোঁচার চিকিৎসা করতে যে প্রতিষেধক কিনছেন, তার সাইড এফেক্টের মূল্য চোকানোর দায় আপনারই।
শেষ পর্যন্ত আবার না গাইতে হয়- 'আমি জেনেশুনে বিষ করেছি পান।'
সস্তার তিন অবস্থা। খোঁচার ঘা সারাতে, শেষে ক্যানসারের ঘা না হয়।

চিত্র কৃতজ্ঞতাঃ সংগৃহীত 



মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন