রবিবাসরীয় সাহিত্যের দিন প্রতিদিন - সাহিত্যিক সন্দীপ চক্রবর্তীর অন্য ধারার গল্প গাঁথার ধারাবাহিক " তুহু মম "

 


রবিবাসরীয়   ধারাবাহিক 


 আধুনিক বাংলা সাহিত্যের নবীন লেখক সন্দীপ চক্রবর্তী । সন্দীপ লেখেন, নিজের অনুভুতি দিয়ে। সেখানে পাওয়া যাবে নিজেকে খুঁজে। বর্তমানে সন্দীপ একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের অন্যতম ।সন্দীপের  প্রতিটি অক্ষরের মাঝে লুকিয়ে থাকে সমাজের চালচিত্র। প্রতিদিন থাকছে  এই সমাজের কথকতা। একেবারে নতুন এক আঙ্গিক। একেবারে অন্য রকম আখ্যান গাথা  

                    তুঁহু মম / ৮   


সন্দীপ চক্রবর্তী


সেদিন আমার ছেলেবেলা আরও নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিল কুমুদিনী। শুনেছি, প্রথম মেয়েশরীর দেখার অভিজ্ঞতা খুব সুন্দর হয়। আমার এক সহকর্মী তো প্রায়ই মজা করে বলেন, 'ভার্জিনিটি এমন একটা জিনিস যা বিসর্জন দিয়েই বেশি সুখ।' কিন্তু বিশ্বাস করো আমার ক্ষেত্রে তা হয়নি। ভার্জিনিটি আমি বিসর্জন দিইনি, আমার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। ধর্ষক বলতে আমরা সাধারণত ছেলেদেরই বুঝি। ধর্ষিকা বলে কোনও শব্দ কোনও অভিধানেই নেই। কিন্তু ধর্ষকাম জিনিসটা যে নারীপুরুষ উভয়েরই থাকতে পারে তার প্রমাণ রানুদি। আশ্চর্যের কথা এটাই, কয়েক বছর আগেও রানুদি যার ন্যাপি পালটে দিয়েছে, মা ব্যস্ত থাকলে গান গেয়ে যাকে ঘুম পাড়িয়েছে-- তার সঙ্গে শরীরি খেলা খেলতে ওর একটুও বাধেনি। একবারও ওর মনে হয়নি এতে অজুর ভাবজগৎ তছনছ হয়ে যাবে। ও হয়তো আর কোনওদিনই কোনও মেয়েকে বিশ্বাস করতে পারবে না। হয়েছিলও তো তাই। এই ঘটনার পর অনেক দিন পর্যন্ত আমি মেয়েদের সংসর্গ এড়িয়ে চলেছি। আমার মনে হত সব মেয়ের মধ্যেই একটা করে রানুদি আছে। ওদের প্রত্যেকের বাড়িতে চিলেকোঠা আছে। নিজস্ব অন্ধকার আছে৷ সেই অন্ধকারে জেগে থাকা দুটো লোভী চোখ আছে। ওরা সকলেই আমাকে খুঁজছে। খুঁজে পেলেই চিলেকোঠায় ডেকে নিয়ে যাবে।
যাই হোক, সেদিনের কথা বলি। চিলেকোঠার ঘরে গিয়ে রানুদি সুইচ টিপে আলো জ্বালল। ব্যাপারটা নতুন। কারণ এই ঘরে এতদিন আলো ছিল না। জিজ্ঞাসা করলাম, 'নতুন বালব কবে লাগালে রানুদি?'
'এই তো আজ সকালে।'
'ভালো করেছ। অন্ধকার আমার খুব খারাপ লাগে।'
'আমাকে তোর কেমন লাগে?'
মায়ের মতো সুন্দরী না হলেও রানুদিকে দেখতে খারাপ নয়। ফর্সা রং, চোখমুখ মানানসই, অনেকটা চুল। কিন্তু যাকে ছোটবেলা থেকে মায়ের মতো করে দেখেছি তাকে দেখতে কেমন জানার কৌতূহল আমার কোনওদিনই হয়নি। তাই সেদিন রানুদির প্রশ্ন শুনে রীতিমতো হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। ইতস্তত করে বলেছিলাম, 'ভালোই তো।'
'আমাকে তোর ভালো লাগে! সত্যি বলছিস? আগে বলিসনি কেন? তা, শাড়িতে ভালো লাগে না সালোয়ারে?'
'সব ড্রেসেই ভালো লাগে। কিন্তু এসব কথা তুমি আমায় কেন জিজ্ঞাসা করছ?'
রানুদি আমার কথার জবাব না দিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসল, ' আমাকে যখন তোর এত ভালো লাগে, আদর করতে ইচ্ছে করে না?'
'তোমাকে আদর করব আমি! কেন রানুদি?'
'আমাকে তোর ভালো লাগে বলে আদর করবি। আমার বুকে হাত দিবি। মুখে নিবি। ঠিক এইরকম করে--' বলেই রানুদি এক টানে ব্লাউজ খুলে ফেলল। তারপর বিশাল এক মাংসপিণ্ড আমার মুখে গুঁজে দিয়ে বলল, 'নে খা।'
আমার দম আটকে আসছিল। কান্না পাচ্ছিল। রানুদির নখের আঁচড়ে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছিলাম আমি। কিছুক্ষণ পর আমার প্যান্ট খোলা হয়ে গেল। রানুদি বন্য দৃষ্টিতে আমাকে জরিপ করে ফিসফিস করে বলল, 'চার বছর ধরে আমি অপেক্ষা করছি। কবে তুই বড়ো হবি। তুই বড়ো হলে আমার সব শখ-আহ্লাদ তোকে দিয়ে মেটাব।'
সেই প্রথম আমার আপাদমস্তক কেঁপে ওঠা। মনে হচ্ছিল ভূমিকম্প হচ্ছে। এখনই চিলেকোঠার ঘরটা ভেঙে পড়বে। বিশ্বাস ভেঙে গেলে বোধহয় এরকমই হয়। রানুদি জানত ঠিক কেমন আমার বিশ্বাস। এও জানত মা চলে যাওয়ার পর আমি খুব একা হয়ে গেছি। কতদিন আমাকে সান্ত্বনা দিয়েছে। সাহস দিয়েছে। কিন্তু সেদিন চরম আঘাত করে এক ফুঁয়ে সব আলো নিভিয়ে দিল।
খেলা শেষ হল একসময়। ক্ষোভে অপমানে আমি চিৎকার করে বললাম, 'আমি তোমাকে মায়ের জায়গায় বসিয়েছিলাম রানুদি!'
রানুদি নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, 'জানি তো। সব মেয়েই তো মা রে অজু। আবার সব মেয়েই বিছানায় বেশ্যা। তোর মাও তাই।'
মনে আছে, আমি ছিটকে সরে গিয়ে বলেছিলাম, 'না। আমার মা কক্ষনও তোমার মতো নয়।'
তারপর প্যান্টে কোনওরকমে পা দু'টো গলিয়ে, জামাটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে এসেছিলাম ঘর থেকে। দৌড়তে শুরু করেছিলাম পাগলের মতো। কানে এসেছিল রানুদির গলা, 'কাল আবার আসবি তো?'
আমি বলেছিলাম, 'না। কোনওদিন না।'
দৌড়তে দৌড়তে সোজা জলঙ্গীর ধারে। ওখানে আমার একটা বটগাছ ছিল। সেদিন গাছের নীচে বসে হাউ হাউ করে কেঁদেছিলাম। মায়ের কথা মনে পড়ছিল। মা থাকলে সব বলে হালকা হতে পারতাম। বাবাকে এসব বলা যায় না। বাবাকে আমি একটা প্রশ্নই করতে চেয়েছিলাম, 'আমার মা বিছানায় কেমন ছিল? রানুদির মতো?'-- না, করতে পারিনি। সেই জন্যেই বোধহয় আমার কান্নাও এখনও ফুরোয়নি। সেই জন্যেই বোধহয় আমি আজও মেয়েদের মধ্যে রানুদিকে দেখি। মনে হয় ভান ছাড়া ওদের আর কিছু নেই। কিছু থাকে না।
জানি কুমুদিনী, তুমি এরই মধ্যে হাঁপিয়ে উঠেছ। এসব কথা তোমার ভালো লাগছে না। তুমি রুরুর কথা শুনতে চাও। কিন্তু কী করি বলো! যখনই পিছন ফিরি, পাশাপাশি দুটো ধ্বংসস্তূপ দেখতে পাই। যার একটা রানুদির উপহার, অন্যটা রুরুর। এই দুই ধ্বংসস্তূপই তো আমাকে সময়ের ধ্বংসস্তূপ খোঁজার দিকে ঠেলে দিয়েছিল। আমি যে অনেক বছর পর একদিন পাঁচ হাজার বছরের পুরনো একটা জনপদ আবিষ্কার করব, যেখানে এখনও পরস্পরের হাতে হাত রেখে বসে থাকবে এক প্রেমিক যুগল--সেটা তো সেই বিকেলেই ঠিক হয়ে গিয়েছিল। ধ্বংসস্তূপেই আমাকে মানায়। সে ধ্বংসস্তূপ আমার জীবনের হোক অথবা ইতিহাসের। নয়তো আমি আজ বিদেশের কোনও ইউনিভার্সিটির এসি ক্লাসরুমে বসে ইতিহাস পড়াতাম। সে প্রস্তাবও এসেছিল। কিন্তু আমি পত্রপাঠ বাতিল করে দিয়েছি।
সুতরাং ধৈর্য ধরো। রুরুর কথা যখন বলব তোমার অস্বস্তি আরও বাড়বে। আর এই অস্বস্তিটুকু সহ্য করতে না পারলে তুমি কীকরে বুঝবে ঠিক কোন পরিস্থিতিতে আমি দু'রকম জীবন যাপন করতে শুরু করেছিলাম। জন্ম হয়েছিল এক অন্য অর্জুনের। যে একই সঙ্গে স্মার্ট, কনফিডেন্ট আর তুখোড় উওম্যানাইজার। ঠিক তার প্রেসিডেন্সির সহপাঠীদের মতো। যে অর্জুন তার প্রকৃত রিয়েলিটি থেকে পালাবে বলে অন্য এক কৃত্রিম রিয়েলিটি তৈরি করে নিতে জানে। আর তাকে বিশ্বাসযোগ্যও করে তুলতে পারে। আমার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য যাই বলো এটাই, সেই কৃত্রিম অর্জুন বেশিদিন বাঁচেনি। বিপ্লব তো স্থায়ী হয় না, স্থায়ী হয় বিবর্তন। আবর্জনা ভেবে সময়ই একদিন সরিয়ে দিয়েছিল মুখোশটা। আর তাতেই ভেঙে পড়েছিল আমার দ্বিতীয় খেলাঘর।
(ক্রমশ)

মন্তব্যসমূহ