বেহালার দিন প্রতিদিন বিশেষ সাংবাদিক কাজল ভট্টাচার্যের কলমে

বিশেষ নিবন্ধ  



যখন বৃষ্টি নামলো 


      কাজল ভট্টাচার্য


সেই বৃষ্টি নেমেছিল শক্তি কবির বুকে। জল ছপছপ পায়ে একা উঠান পেরিয়ে দে ছুট। না, সেখানে কেউ অপেক্ষা করে ছিলো না। কোনদিনই কেউ কারও অপেক্ষায় থাকে না। বাতায়নে কেউ তাকিয়ে থাকে না। তা থাকে কবির বুকের খোলা জানালায়। অভিমানী কবির গলায় উঠে আসে বিরহের সুর- 'ভুলিয়ো স্মৃতি মম, নিশীথ স্বপন সম।'

আমিও তখন মেঘের কাছাকাছি। দশতলার ফ্ল্যাটে। বাতায়নের শূন্য দৃষ্টি প্রসারিত দূর থেকে দূরে। ধূসর তমসায় ঢাকা দিগ্বিদিক। কল্পলোকে আবছা হয়ে আসা কোনও মুখ উদ্ভাসিত বিদ্যুতের ঝলকানিতে। কবির কল্পনায় সেই মুখ তখন শিউলিতলে। আজানুকেশ ভিজিয়ে নিতে ব্যস্ত আকাশমেঘ ছেঁচা জলে। কবি তাকে খুঁজে পায়নি। আমি তাকে খুঁজেছিলাম ফেসবুকের ভিড়ে। ভার্চুয়াল জনারণ্যে সে তখন ব্যস্ত প্রেমিকের কমেন্টে মিলনের আহ্বানে সাড়া দিতে।

তিমিরনিবিড় রাতের সেই বৃষ্টিতে রবিকবি 'তখন মগন গহন ঘুমের ঘোরে'। এদিকে শতসহস্র চোখ জেগে। সব চোখ আটকে মোবাইলের পর্দায়। সেখানে তখন মধ্যরাতের ভিড়। জমজমাট রোমাঞ্চ। সবাই বয়ে এনেছে একশরীর উত্তেজনা। নিঃশব্দে তা ঝরে পড়ছে মোবাইলের পর্দায়। কেউ তাতে ভিজছে। কেউ লোভীর মতো চেটে নিচ্ছে। মন্বন্তরের ক্ষিধে শরীর জুড়ে। একশরীরে না মিটলে একাধিক শরীরে গমন প্রস্থান।

সেই বাঁধভাঙা সর্বগ্রাসী যৌনতার ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে বাতাসের ইথার তরঙ্গে। ফুলে ফেঁপে ওঠে সাগর। ভরা কোটালের উত্তেজনায় জনপদে ঝাঁপিয়ে পড়ে শান্তসলিলা নদী। উজার হয়ে যায় কত শত সভ্যতার জনপদ। যদিও বড় পূণ্য পবিত্র এ রাত। জৈষ্ঠ্যের শুক্ল পক্ষের বুদ্ধ পূর্ণিমা। আজ রাতেই সেজে উঠেছিল কপিলাবস্তুর রাজপ্রাসাদ। আবির্ভাব রাজকুমার সিদ্ধার্থের। সিদ্ধিলাভ মহানির্বাণও বুদ্ধ পূর্ণিমার রাতেই। সেই রাতই আজ ভয়ঙ্করী।

সাপের ছোবলের মতো আকাশকে অনবরত আঘাত করে চলেছে বিদ্যুতের ঝলকানি। ঢালছে বিষ। সেই বিষ ঝরে পড়ছে মাঠে ময়দানে উপত্যকায় সর্বত্র। ইয়স, ভরা কোটালের যুগল তাণ্ডবে 'গেলো গেলো' রব। আতঙ্কের নিশি। আকাশ যেন ভেঙে পড়েছে। মত্ত হাওয়ার ছন্দে স্বপ্নদোসরের সন্ধান পেলো কবির স্বপ্নস্বরূপ। সেই স্বপ্ন দেহাতীত। দেহের সীমা পেরিয়ে তা একাকার নিশীথরাতের 'কুঞ্জবিথীর সিক্ত যূথীর গন্ধে'। সাধারণের নাক সেই গন্ধকে চিনতে পারে না। পবিত্র সেই গন্ধের সন্ধান পায় একমাত্র কস্তুরী মৃগ।



ঝাপসা হয়ে আসে দু'চোখের দৃষ্টি। মেঘ জমে অন্তরে। একুল ওকুল দুকুল ভাসিয়ে নামে দুরন্ত বৃষ্টি। এবার অদৃশ্যলোক থেকে ছুটে আসে কবির সেই আজানুকেশী। শিউলিতলায় দাঁড়িয়ে গায়ে মেখে নেয় সেই অঝোর ধারাপাত। নিবিড় রাতের সেই স্বর্গীয় দৃশ্য দুচোখ ভরে দেখে কবির বৃষ্টিস্নাত অন্তর। বিপর্যয়ের মধুযামিনীতে দেখা হয় দুজনার।

মন ছুঁয়ে দেহের সীমানা ডিঙিয়ে কবির হাত ধরে তার স্বপ্নস্বরূপিনী। মেঘের পাখনা জুড়ে ঝোড়ো হাওয়ায় বিদ্যুতের পথ বেয়ে যুগল মিলায় অনন্তে।



(কৃতজ্ঞতা: শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের পদ্য 'যখন বৃষ্টি নামলো'/ রবীন্দ্রসঙ্গীত 'আমি তখন ছিলেম মগন গহন ঘুমের ঘোরে'/ নজরুলগীতি 'শাওন রাতে যদি)

চিত্রঃ সংগৃহীত

মন্তব্যসমূহ