বেহালার দিন প্রতিদিন এর বিশেষ নিবন্ধ কাজল ভট্টাচার্যের কলমে

 





       কাজল ভট্টাচার্য




চটি এবার অন্য পথে হাঁটবে।

জামা এবার অন্যের গায়ে চড়বে।

চটির সঙ্গে আমার বরাবরের চটাচটি। সেই ছেলেবেলা থেকেই। সাইকেলটা একটু উঁচু ছিলো। সবেমাত্র সিটে চড়ে ফুল প্যাডেল চালাতে শিখেছি। সাইকেলটা একটু ঠেলে গড়াতে শুরু করলেই, একলাফে সিটে। কিন্তু কপাল খারাপ থাকলে যা হয়। আমিও সিটে চড়ার জন্য লাফ মারলাম, ওদিকে চটিও লাফ মারলো। চটির চ্যাংরামি। ডান পায়ের ফিতে ছিঁড়ে, রকেটের গতিতে চটি ছিটকে বেরিয়ে গেলো। ফের সাইকেল থেকে একলাফে নেমে পড়া। চটি সন্ধান। তারপর এক পায়ে ছেঁড়া চটি নিয়ে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে বাড়ি ফেরা।

তখন রাস্তার ভিড়ে কোনও মেয়ে দেখলেই মনে বসন্তবাহার। ধাওয়া করেছি আমার সেই চন্দ্রবদনীকে। যেন মেঘের মধ্যে ভেসে চলেছে সেই মেয়ে। কৃষ্ণপক্ষের একফালি চাঁদ, মেঘের খেলা সকাল দশটার ভরা রোদ্দুরে। এই দেখা যায় তো এই হারায়। ভিড়ের মধ্যে যদি হারিয়ে ফেলি! ক্লান্ত স্টিম এঞ্জিনের মতো ঘাম ঝরাতে ঝরাতে কাউকে ডজ করে, কাউকে ড্রিবল করে এগিয়ে যাই। যতোই বামন হই না কেন, চাঁদ চাই। মনের তেজ বাড়াতে কানে গুনগুন- 'আমরা করবো জয়, নিশ্চয়!' তখন কেই বা জানতো, ওই গান গাইলেই শূন্যের পথ প্রশস্ত। হলোও তাই, ফটাস করে বাঁ পায়ের ফিতে আউট।

সেদিনই ঠিক করেছিলাম, বড় হয়ে অন্যের পায়ে চটি পড়াবো। তারপর সেই চটি পায়ে সুন্দরীর হাত ধরে আকাশবাণী থেকে হেঁটে প্রিন্সেপ ঘাটে পৌঁছাবো। এবারেও খেল দেখালো চটি। কিছুতেই হাঁটি হাঁটি পা পা করে প্রিন্সেপ পর্যন্ত যেতে রাজি না সুন্দরী। নতুন চটি। ফোঁসকা পড়তে পারে। আরও কত কী হতে পারে, সব ঝরঝর করে এক নিঃশ্বাসে শুনিয়ে দিলো। আমিও নাছোড়বান্দা। শেষ পর্যন্ত তুমুল তর্কাতর্কি। জবরদস্ত এক মুখ খিঁচুনি দিয়ে, চটি পায়ে সুন্দরী হাঁটা দিলো বাবুঘাটের দিকে। আর আমি ক্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকলাম সেদিকে। চেঁচিয়ে বললাম, 'বেশ মনে রেখো। এক মাঘে শীত যায় না।' গলা কম যায় না সুন্দরীরও। পেছন ফিরে হাত নেড়ে সুন্দরী বলে গেলো- 'সময়ের হাতে সবকিছু ছেড়ে দাও।'

আমি বললাম- 'চটির পায়ে সবকিছু ছেড়ে দিলাম।'

আর ছিলো এক জামা।

চটির বদলে জামা পেয়েছিলাম। নাকের বদলে নরুন পাওয়ার কেস। সেতো খুব যত্নের জামা। একবার বন্ধুদের সঙ্গে গেলাম শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসবে। গায়ে সেই স্পেশাল জামা। বেশ ফূর্তিফার্তা সবকিছুই হলো। সেই সঙ্গে হলো সর্বনাশ। সুন্দরী আশ্রম কন্যাদের নাচগান দেখেই চলেছি বিভোর হয়ে। সেই ফাঁকে কখন যে আমার সাধের অফ হোয়াইট জামার পেছন দিক রং বদলে ফেলেছে, তার হুঁশ ছিলো না। ভোটের আগে দলবদলুরাও অমন চুপিসারে কাজ সারে না।

সাধের জামার দুরবস্থা থেকে এক আউন্স তরল দুঃখ- টুঃখও হলো না। গেলো মেজাজটা চড়ে। তাও সপ্তমে। ইচ্ছে হলো, গলা ছেড়ে খিস্তি দিই। কিন্ত কাকে? শেষ পর্যন্ত টনসিলে শ্লেষ্মার মতো আটকে থেকে গেলো খিস্তিগুলো। এরপর ইচ্ছে হলো বজরংবলি হয়ে যাই। একটানে দু টুকরো করে ফেলি সুতির সেই জামার বুক চিড়ে। পরমুহূর্তেই সিদ্ধান্ত বদল। ভারতীয় রেলওয়ের মতো- অনিবার্য কারণে এক দুই তিন আট নাম্বারের ডাউন শিয়ালদা বনগাঁ লোকাল, পাঁচ নাম্বারের বদলে সতেরো নাম্বার প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়বে। দু'টুকরো করলে হবে না। জামাটা ছিঁড়ে ফালাফালা করতে পারলে তবেই জুড়াবে গায়ের জ্বালা। প্রাণে ধরে সেটাও করতে পারলাম না।



রংমাখা জামাটা ওভাবেই পড়েছিল। কিছুদিন পর ঘুরতে বেরিয়েছি। মাঠের আল বরাবর চলেছি। হঠাতই নজরে এলো সবুজ মাঠে দাঁড়িয়ে এক কাকতাড়ুয়া। গায়ে ছেঁড়াফাটা এক স্যান্ডো গেঞ্জি। মাথার ওপর ঠা ঠা রোদ। ওই না দেখে, মগজে ঝিলিক মেরে গেলো বুদ্ধি। আমার রামধনুর রংমাখা সাধের জামা চড়িয়ে দিলাম সেই কাকতাড়ুয়ার গায়ে।

- 'আরে করেন কী? করেন কী?' মাঠ ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো এক হাট্টাকাট্টা চেহারার লোক। কাঁধে ডান হাতে ধরা কোদাল। সে অবাক চোখে তাকিয়ে আমার দিকে। ফের সে বলে উঠলো- 'এই গরমে কেউ ওভাবে একটা ফুল শার্ট পরিয়ে দেয়? কাকতাড়ুয়ার গরম লাগবে না?'

মন্তব্যসমূহ