রবিবাসরীয় সাহিত্যের দিন প্রতিদিন - সাহিত্যিক সন্দীপ চক্রবর্তীর অন্য ধারার গল্প গাঁথার ধারাবাহিক " তুহু মম "

 

রবিবাসরীয়   ধারাবাহিক 


 আধুনিক বাংলা সাহিত্যের নবীন লেখক সন্দীপ চক্রবর্তী । সন্দীপ লেখেন, নিজের অনুভুতি দিয়ে। সেখানে পাওয়া যাবে নিজেকে খুঁজে। বর্তমানে সন্দীপ একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের অন্যতম ।সন্দীপের  প্রতিটি অক্ষরের মাঝে লুকিয়ে থাকে সমাজের চালচিত্র। আজ থেকে শুরু হচ্ছে এই সমাজের কথকতা। একেবারে নতুন এক আঙ্গিক। একেবারে অন্য রকম আখ্যান গাথা  

                    তুঁহু মম / ৩ 

 

সন্দীপ চক্রবর্তী


কলম্বো
শ্রীলঙ্কা,
অর্জুনদা,
আজ হঠাৎই খুব ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে পৃথিবীটা খব সুন্দর। এই সুন্দর পৃথিবীতে আমাকে অনেকদিন বেঁচে থাকতে হবে। যে গেস্ট হাউসে আছি সেটা ব্রিটিশদের তৈরি। বিরাট-বিরাট জানলা, চওড়া বারান্দা, উঁচু সিলিং। কথা বললে নিজের গলাই এমন গমগম করে যে শুনে চমকে উঠি। আর বারান্দায় দাঁড়ালে তো কথাই নেই। কলম্বো শহরের ঝকঝকে স্কাইলাইন চোখে ঝাঁপিয়ে পড়ে। লকডাউনে রাস্তাঘাট ফাঁকা, কালেভদ্রে একটা-দুটো গাড়ির আওয়াজ পাওয়া যায়, দূরে শিপইয়ার্ডে জাহাজগুলো দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে ঝিমোয়... কিন্তু তাতে কী! আমি বেশ ভালো আছি। আর আমার ভালো লাগা কয়েক কোটি গুণ বাড়িয়ে দিয়েছ তুমি। ইতিহাসের পণ্ডিত এত ভালো বাংলা লিখতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস করতে পারতুম না। আমি জানতুম তুমি শুধু চেয়েই থাকতে পারো, কিছু চাইতে পারো না। জীবন তার যাবতীয় ঐশ্বর্য ছড়িয়ে দেয় তোমার চারপাশে কিন্তু তুমি তা গ্রহণ করতে পারো না।
ঘাট মানছি অর্জুনদা। এতদিন তোমাকে বুঝতে পারিনি। তোমার লেখা পড়ে জানলুম এই পৃথিবীর জনারণ্য থেকে একটি রাজাধিরাজ খুঁজে নিয়ে আমি যদি তার দিকে ড্যাবড্যাব করে থাকি তা হলে তোমারও ঈর্ষা হয়! সত্যি হয় নাকি অর্জুনদা? মানে, সেদিন সেই বৃষ্টি-পাগল রাতে সত্যিই কি তোমার ঈর্ষা হয়েছিল? লেখার ফ্লো এসে যাওয়ায় লিখে ফেলোনি তো? আহা রাগ করো কেন! তোমার সঙ্গে একটু ঠাট্টা-তামাশাও কি করতে পারব না? আচ্ছা বাবা মেনে নিলুম ঈর্ষার কথাটা সত্যি। তোমার সঙ্গে ঝগড়া করে এমন সুন্দর দিনটা আমি মাটি করতে পারব না। কিন্তু অর্জুনদা, তুমি কি জানো না আমার রাজাধিরাজ কে? সেদিনই তো আমি বুঝিয়ে দিয়েছিলাম। তুমি সেদিনের ঘটনার অনেকটাই লিখেছ কিন্তু শেষটা লেখোনি। তখন বৃষ্টিতে চারদিক ঝাপসা হয়ে গেছে। উইন্ডস্কিনে জলের স্রোত। মনে হচ্ছিল ওয়াইপার দুটো আর পারছে না। এবার বুঝি জলের তোড়ে ভেসেই যাবে। রয়ে যাবে শুধু জলের দাগ। লোকে বলে জলের দাগ নাকি নিমেষ ফুরোতেই মুছে যায়। কিন্তু সেদিনের জলের দাগ আমি আজও মুছতে পারিনি। চাইওনি বোধহয়। আমি মনের ডাক্তার। সামনের দিকে তাকিয়ে বাঁচতে ভালোবাসি। বৃষ্টির দিনে বাড়িতে থাকলে আজও আমার ওয়াইপার দুটোর কথা মনে পড়ে। আমি মনে মনে ছবিগুলো সাজাই। তখন আমরা ফিরছি। আমার বড্ড কান্না পাচ্ছে। কখন যে মাথাটা তোমার কাঁধে হেলিয়ে দিয়েছি, জানি না। আর কখনই বা রবীন্দ্রনাথের ভারী সুন্দর একটা গান গুনগুন করতে শুরু করেছি, তাও না।--- 'যেতে দাও যেতে দাও গেল যারা/ তুমি যেয়ো না তুমি যেয়ো না/ আমার বাদলের গান হয়নি সারা।'


এই গানেই তো আমি সব বুঝিয়ে দিয়েছিলুম। কেন বুঝলে না বলো তো? কেন তোমার মনে হল না একটা মেয়ে যখন কোনও পুরুষের সঙ্গে ব্রিজ থেকে বৃষ্টি দেখতে যেতে চায় তখন সেই চাওয়ার মধ্যে লুকিয়ে থাকে রোম্যান্স। মেয়েটি সেই রোম্যান্সকে আঙটির হিরের মতো চোখের সামনে এনে দেখতে চায়। নিবিড় করে অনুভব করতে চায়। আমিও তাই চেয়েছিলুম। ভেবেছিলুম, মন আর মুখের মাঝখানে যে-দেওয়াল তুমি তুলেছ ঝোড়ো হাওয়া আর বৃষ্টির ঝাপটায় তা ভেঙে পড়বে। কিংবা তুমি নিজেই ভেঙে ফেলবে। আমি তো ঠিক লক্ষ্মী মেয়ে-টাইপ নই। কোনওদিন ছিলামও না। ছোটবেলায় মামার বাড়ির গ্রামে বেড়াতে গিয়ে ওখানকার ছেলেদের সঙ্গে ড্যাংগুলি খেলার সময় দু'বার মাথা ফাটিয়েছি। একবার গাছ থেকে পড়ে গিয়ে পাও ভেঙেছিলাম। সেদিন সেকেন্ড হুগলী ব্রিজে সেই ডানপিটে মেয়েটাই তোমার সঙ্গী হয়েছিল। অনেকবার যে না-বলা কথার আভাস সে দেখেছে তোমার চোখে তা-ই শুনতে চেয়েছিল তোমার মুখে। কিন্তু আমার পোড়া কপাল! তুমি বৃষ্টি দেখলে, আমায় দেখলে, বৃষ্টির ঝাপসা পটভূমিতে আমার রাজাধিরাজকে খুঁজলে কিন্তু সেই রাজাধিরাজ যে তুমি নিজেই সে কথাটি বুঝলে না।
হ্যাঁ অর্জুনদা, তুমি। তুমিই। ভালোবাসি তোমায়। তোমার জন্য আমার সর্বস্ব উজার করে দিতে পারি। জানি তুমি হাসছ। চশমার ওপারে বড়ো বড়ো চোখদুটো গা-জ্বালানো দৃষ্টিতে এখন চেয়ে আছে সম্ভবত। থাকুক চেয়ে। আমার যা বলার বলবই। ভালো যখন বেসেছি তখন সে কথা স্বীকার না করলে আমি নিজের কাছেই অপরাধী থেকে যাব। উঁহু সেটি হবে না। তার মানে অবশ্য এই নয় যে তোমাকেও ভালোবাসতে হবে। কোনও জোর নেই অর্জুনদা। তোমার ঈর্ষার ইঙ্গিত পেয়ে আমি আমার গয়নার বাক্স খুলে দেখাচ্ছি। চাইলে ডাকাতি করতে পারো। আবার না-চাইলে তোমার সন্ন্যাসী-সুলভ উদাসীনতায় মুখ ফিরিয়ে চলেও যেতে পারো। আমি কাউকে পিছন থেকে ডাকি না, তোমাকেও ডাকব না। জীবন আমার কাছে যেভাবে আসে আমি সেভাবেই তাকে গ্রহণ করি। কখনও প্রশ্ন করি না, কেন তুমি আমার মনের মতন হলে না? তাই আমার আনন্দ কখনও ফুরোয় না। তুমি যদি আমাকে নাও তা হলে আমি দেবী হয়ে যাব। আর যদি না-নাও তা হলে পরিপূর্ণ মানবী হয়ে উঠব একদিন। কোনওদিকেই আমার কোনও লোকসান নেই।
ভালো থেকো অর্জুনদা। খুব ভালো থেকো।
কুমুদিনী

মন্তব্যসমূহ