বেহালার দিন প্রতিদিন বিশেষ সাংবাদিক কাজল ভট্টাচার্যের কলমে

 বিশেষ কলম 


শব্দহীন লকডাউন 



     কাজল ভট্টাচার্য

ঘাড় ধরে শেখানো একেই বলে।

একা থাকা নিয়ে যত্তসব ধানাই পানাই এক ঘায়েই শেষ। সরকার বাহাদুরের লকডাউন এক মোক্ষম দাওয়াই। 

এক্কেবারে স্টেরয়েড। শরীরটা থরথর করে মুণ্ডুকাটা মুর্গির মতো কেঁপে উঠেছিল বৈকি। তবে কয়েকদিনের মধ্যেই ঝিম মেরে নিস্তেজ। তারপরেই শান্ত। নট নড়ন- চড়ন।

অনেকেই ভোকাল টনিকের কবরেজি ডোজ দিতেন। আমরা সবাই একা। কোথাও স্বামীস্ত্রী একা। আবার কোথাও সঙ্গে সন্তান নিয়ে দম্পতি একা। পাঁচজনের মধ্যে থেকেও একা।

এসব দার্শনিক তত্ত্ব শুনে মনে একটাই প্রশ্ন ঘাই মারতো, কম জলে পাকা মাছের মতো- একা কয় প্রকার?

লকডাউন সেই প্রশ্নের উত্তর দেয়নি। তবে উত্তর খোঁজার রাস্তা দেখিয়ে দিয়েছে। 

শহরের রাজপথে অলিতে গলিতে ঘুরে দেখেছি। শুনশান। সবাই একা। বাগবাজারের ঘাটে গঙ্গা একা। প্রিন্সেপে বেঁধে রাখা নৌকো, সেও একা। বিউগল হাতে ভিক্টোরিয়ার পরী, আরও একা। এই একার রাজত্বে, আমিও একা।

ভার্চুয়াল জগত মাঝরাতেও জমজমাট। 

- কীরে ব্যস্ত নাকি?

সাঁয়ত্রিশ মিনিট হোয়াপে পড়ে থাকে মেসেজ। তারপর বন্ধুর জবাব মেলে- হুম।

কল করলে সূক্ষ্মভাবে এড়িয়ে যাওয়া। আবার রিসিভ করলে মুখে তালা ঝুলিয়ে রাখা। শব্দের এটিএম। দরকারের অতিরিক্ত একটিও শব্দ না। একমাত্র উদার সর্বমঙ্গলা টিভি। বকবক করেই চলে। বন্ধুরা শোনে, বলে না। টিভি বলে, শোনে না। কিন্তু সেখানেও গেঁড়ো। টিভি খুললেই কোভিডে ঘর ভরে যায়। মনে হয় বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মাত্র দুটি জীবিত প্রাণী এক্ষণে মুখোমুখী। এক টিভির ওই সংবাদ পাঠক। দুই, আমি ওই সংবাদ শ্রোতা। তবু মন্দের ভালো।

অষ্টপ্রহর মগজের বাতি নেভানো। চোখ চশমায় ঢাকা। নাক কান মুখ মাস্কে। কথা শুনতে পাই না। কথা বলতে পারি না। শুনতে শুনতেই শেখা, কথা বলা। হারিয়ে যাচ্ছে শোনার অভ্যাস। চলে যাচ্ছে বলার অভ্যাস। শ্যাওলা জমছে শব্দের গায়ে।

কথায় বলে, শব্দব্রহ্ম।

অনুবিদ্ধমিব জ্ঞানং সর্বং শব্দেন ভাসতে। 

যাবতীয় জ্ঞান ধরা থাকে শব্দে। আর এই জ্ঞান শব্দকে জড়িয়ে (অনুবিদ্ধ) ভাসতে থাকে। শব্দের এই সংজ্ঞা দিয়েছিলেন মহাবৈয়াকরণ আচার্য ভর্তৃহরি। ৪৫০ থেকে ৫০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই তাঁর আবির্ভাব ভারতে।

শব্দই শেষ কথা।

শব্দকে ফাঁকি দেওয়া শিবেরও অসাধ্য। জগতের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তু ধরা দেয় ওই শব্দেই। এমনকি বিজ্ঞানও। চেয়ারে উঠে, সিঁড়ি বেয়ে উঠে, এমনকি পঁয়ষট্টিতলা বাড়ির ছাদে উঠেও অনেককিছুই ধরা যায় না। রকেটে চেপে ধরার চেষ্টা করবেন? আজকের প্রযুক্তিবিদরাও তা ভাবেন না। 

যেমন ধরুন দূর আকাশের ওই তারা। মহাকাশ থেকে ওই তারাকে আপনার পড়ার টেবিলে পেড়ে ফেলে ওই শব্দ। মাত্র দু অক্ষরের এক ছোট্ট শব্দের মধ্যে ধরা, এই পৃথিবীর থেকেও কয়েকগুণ বড়ো এক তারা।

ব্রহ্মকে বলা হয়েছে অক্ষর। 'ক্ষর' শব্দের অর্থ অপরিবর্তনশীল। অর্থাত, ব্রহ্মর পরিবর্তন নেই। এমনকি শব্দের অস্তিত্ব খারিজ করতেও ভরসা সেই শব্দের।

আমাদের মুখের ভাষা সেই শব্দ। 

সেই শব্দকে জব্দ করতে লকডাউন- এক অমোঘ শব্দ। লকডাউন শব্দের ঠেলা সামলাতে নাজেহাল আমরা। এরপরেও কি সন্দেহ থাকে, শব্দই ব্রহ্ম? 

লকডাউনে ফ্ল্যাট বন্দিরা ঠিক কটা শব্দ চব্বিশ ঘণ্টায় উচ্চারণ করে? আমার মতো যারা একা তাদের অনেকেই একটাও না। 

যারা খানিকটা ভাগ্যবান, টেক্সট করে মোবাইলে। টুইট হোয়াপ মেসেঞ্জারে সেই বার্তা পৌঁছে যায়, ঘনিষ্ঠজনের কাছে। অফিস নেই। তাই কাজের কথাও নেই। এখন সবার দরজা বন্ধ। বাইরের বাতাস প্রবেশও নিষিদ্ধ।





সেদিন দুপুরের পর আর বিকেল নামলো না। সরাসরি সন্ধ্যা। চারদিক আঁধার করে এলো। আকাশ থেকে নেমে শহরের মাথা ছুঁয়ে ফেললো, ঘন কালো মেঘের দল। নিস্তব্ধ শহর যেন ভয়ে গুটিসুটি। রাজপথে জ্বলে উঠলো আলো। সারসার বন্ধ দোকান। মাঝেমধ্যে হঠাত দু একটা গাড়ির ছুটে যাওয়া। আতঙ্কের সাইরেন বাজিয়ে চলে গেলো অ্যামবুলেন্স। রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে পুলিসের জিপ। অপেক্ষা। গোটা শহর যেন অপেক্ষা করে চলেছে এক দুর্যোগের।

লকডাউনের নিস্তব্ধতা খানখান করে এবার শহরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ঝড়। ভয়ঙ্কর এক আওয়াজ আর তার সঙ্গে শহর তছনছ করার ধাতব শব্দ। নামে বৃষ্টি। মেঘ গর্জায়। বিদ্যুতের ছটা আকাশের বুক ফালাফালা করে ধেয়ে আসে শহরের মিনারে। 

এই এক দোষ বৃষ্টির। পথ বড্ড পিচ্ছিল করে দেয়। সামনে এগোতে চাইলে পেছনে গড়িয়ে দেয়। ষাটের আমি গড়াতে গড়াতে পঞ্চাশ, চল্লিশ হতে হতে শূন্যের দিকে যেতে থাকি। কাউন্ট ডাউন। টলিগঞ্জ পেরিয়ে নাক বরাবর এক্সাইড পার্ক স্ট্রিট ছুঁয়ে পৌঁছে যাই চৌরঙ্গিতে। শুনশান গ্র্যান্ড হোটেলের ফুটপাত। সেই সঙ্গে দোতলার ফ্ল্যাটবন্দি আমি হয়ে যাই 'চৌরঙ্গি'র স্যাটা বোস। 

জানলার পাশে দাঁড়িয়ে আমি। বাইরে যেদিকে তাকাই কিছুই নজরে পড়ে না। মনে হয় গোটা শহর বৃষ্টির আগুনে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। আর সেই সাদা ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ছে আকাশ পর্যন্ত। 

কেমন এক অস্বস্তি সারা শরীর জুড়ে। সেই মুহূর্তে ফের প্রখর হয়ে ওঠে আমার একাকীত্ব। দমবন্ধ হয়ে আসে। চট করে ইনহেলারের দুটো পাফ নিয়ে বন্দি জীবনে ফিরি।

বাতাস চাই বাতাস।

এক ঝটকায় সরিয়ে দিই জানলার কাচের পাল্লা। একবুক অক্সিজেন টেনে নিতে চাই নিকোটিন মাখা ফুসফুসে। বাইরের বৃষ্টির ছাঁটে ভিজতে থাকে শরীর। ফ্ল্যাটের ভেতরেও তখন অঝোরে বৃষ্টি। সেই বৃষ্টির ছাঁটে ভিজে চলে মন। অস্বস্তি কাটাতে গাইতে চেষ্টা করলাম- বড়ো একা লাগে এই আঁধারে!

ভয়ের চোটে কিনা জানি না, গলা থেকে বেরিয়ে এলো এক ফ্যাঁসফেঁসে আওয়াজ। শব্দ না। সেকি? বারবার চেষ্টা করে বুঝতে পারলাম শুধু শহরে না, আমার শরীরে মনে অনুভবে সর্বত্র লকডাউন। শরীরটা থরথর করে কেঁপে উঠলো। নিস্তেজ হওয়ার মুহূর্তে বেশ বুঝতে পারলাম, এযাত্রায় আমার আর স্যাটা বোস হওয়া হলো না।

আবার শব্দ খুঁজে পাবো তো? বৃষ্টি থামলে।

আবার কথা বলতে ইচ্ছে করবে তো? লকডাউন উঠলে।

চিত্র কৃতজ্ঞতাঃ সংগৃহীত 

মন্তব্যসমূহ