রবিবাসরীয় দিন প্রতিদিন এর বিশেষ নিবন্ধ - সাংবাদিক কাজল ভট্টাচার্যের কলমে

 

রোদ্দুর জোছনা 



       কাজল ভট্টাচার্য

এবার থেকে তুই থাকবি চাঁদ হয়ে। ধরা থাকবি প্রতিরাতের চাঁদের আলোয়। জোছনাতে।

আমি হবো সূর্য। রোদ্দুর হয়ে রোজ ফিরে আসবো গিরিরাজের চূড়াতে।

একই আকাশ একই বাতাস একই দুনিয়াতে বাস আমাদের। তবে লক্ষ যোজন আলোকবর্ষ দূরে। মধ্যে অসীম মহাশূন্য। তুই থাকলে আমি নেই। আমি থাকলে তুই নেই। আর যখন থাকবো, যে যার আকাশে।

দূরত্বই সুখের চাবিকাঠি। এমনটাই ধারনা অধুনা সভ্য সমাজের। আমরাও সেই ধারনার শরিক। সুখের রাস্তা খুঁজে নিয়েছি দূরে দূরে থেকে।

তবু যদি কালেভদ্রে দেখা হয়ে যায় আমার শেষবেলায়, দুচোখ ভরে দেখবো তোকে। রাঙিয়ে তুলবো তোকে আমার আলোতেই। সেই স্মৃতির মায়াবী আলো গায়ে মেখে জাগবি সারারাত।

ফেসবুকের পাতায় কমেন্টস পড়বে- দারুণ লাগছে তোমায়। কালটিভেট করতে হবে।

অনুরাগীর সংখ্যা তোর নেহাত মন্দ নয়। পোস্ট পড়লেই ঝাঁকে ঝাঁকে কমেন্টস। তারমধ্যেই কোনও একটাতে লেখা থাকবে আমার নাম। তুই হয়ত থ্যাঙ্ক ইউ লিখে একটা হার্ট সাইন দিবি। তখন আমিও সাবধানী হবো। আগের মতো লাইক করতে ভুল হবে না। আমিও লভ সাইন দেবো। আসলে যতদিন সামনাসামনি ততদিনই ভুল। দূরে গেলেই সাবধানী। সৌজন্যে গাফিলতি চলবে না। পূবাকাশে তুই হাসলে, পশ্চিমাকাশে রাঙা আমি।

দিন আসে দিন যায়। কখনও নিজে জ্বলে, কখনও অন্যকে জ্বালায়। এক উদভ্রান্ত বেপরোয়া অশ্বমেধের ঘোড়া, দিবাকর। অবশেষে ক্লান্ত বিধ্বস্ত, ধরা পড়ে সন্ধ্যারানির কাছে। 

কোনও এক অস্তবেলায় চাঁদের সঙ্গে দেখা হয় সূর্যের। দীর্ঘ বিরহের পর। চাঁদ পূবে, সূয্যি পশ্চিমাকাশে। দূর থেকেই একে অন্যকে দেখে, দুচোখ ভরে। চারচোখের মধুচন্দ্রিমা। ঘোর লাগে শরীরে। স্তিমিত হয়ে আসে সূর্যের তেজ। চাঁদের বুকে লেপটে রোদ্দুর, তখন শান্ত। মায়াবী চাঁদের আলো।

তুই বলেছিলি, 'বেশি মায়া ভালো না।' সেকথা মনে পড়তেই, ঝুপ করে ডুব মারি। সাতসাগর তেরোনদী সাঁতরে, দিকচক্রবাল পেরিয়ে চলে যাই অন্য এক দেশে। অর্ধেক আকাশ নারীর, ঝড় তোলে প্রমীলা বাহিনীর আন্দোলন। এ আকাশ তোমার, ও আকাশ আমার। সভ্য দুনিয়া সীমানা টানে সীমাহীন আকাশেও। আকাশ ভাগাভাগি হয় না। তাই অর্ধেক আকাশ না, গোটা আকাশটাই দিয়ে যাই তোকে। ভালবাসলে, মায়ার বাঁধনে বেঁধে থাকলে, গোটাটাই দিতে হয়। 

চাঁদের মুখেও তখন মলিন ছাপ। 

'তোমার হলো শুরু আমার হলো সারা।' গৃহস্থের ঘরে কেউ সুর ধরে। শঙ্খধ্বনি। তুলসীতলা আলো করে প্রদীপ।

কিশোরী চাঁদের মলিন মুখ দেখে, মহাশূন্য থেকে খসে পড়ে তারা। একটি দুটি করে, তাকে ঘিরে ধরে চাঁদনির রূপমুগ্ধরা। বয়ঃসন্ধির চাঁদের মায়াবী শরীরটা মুড়ে দেয় চুমকি বসানো ওড়নায়। চাঁদের গায়ে গা লাগিয়ে সোহাগ করে যায় পেঁজা তুলোর মতো মেঘ। যেন ভিড়ের সুযোগে অফিস টাইমের মেট্রোতে কোনও পুরুষের, আলগোছে তন্বীর শরীর ছুঁয়ে যাওয়া। 


হাতে তির নিয়ে হাজির হয় কালপুরুষ। ঠিক যেন রূপকথার অরণ্যদেব, সঙ্গী ডেভিল। আবার অন্তরীক্ষের সলমান খানও বলতে পারেন। ধরাতলেও যা মহাশূন্যেও তা। নিজের বীরত্ব দেখিয়ে চন্দ্রবদনীর মনহরণ করা পুরুষের আদিম স্বভাব। অন্ধকার আকাশের ছায়াপথে নীল যমুনার রহস্যের হাতছানি। খেলা জমে যায় আকাশে। নৈসর্গিক প্রেম। সব দেখে সেই কবেই কবি সাবধান করেছিলেন- 'ও চাঁদ সামলে রাখো জোছনাকে।'

শান্ত দীঘির বুকে ভাসে চাঁদ। তখন সে মধ্যযৌবনা। যৌবনের ছটায় উৎসব চরাচরে। মাঝরাতে মাঠের তালগাছগুলির মধ্যেও যেন হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। সবাই চায়, জোছনার পথ বেয়ে অন্তত একবার চাঁদকে ছুঁতে। 

মধ্যরাতের ফেসবুক পোস্টে ভাসে উজ্জ্বল জোছনার বলয়ঘেরা চাঁদ। সেই ছবির নীচে কেউ লেখে- ইউ আর গ্রেট। আবার উত্তীয়র মতো কোনও প্রেমিক শপথ করে, তোমার জন্য সবকিছু করতে পারি। প্রেমিকের জেদ এমনটাই হয়। নৈহাটির গঙ্গার নিরালা ঘাটে বসে কেউ গেয়ে ওঠে- চাঁদ কেন আসে না আমার ঘরে। 

পৃথিবীর উল্টোদিকে বসে সব দেখে সূর্য। দেখে আর জ্বলে। রোদ্দুর হওয়াটাই নিয়তি। পৃথিবীতে আর একজনই রোদ্দুর হতে চেয়েছিল। অমলকান্তি। রোদ্দুর তার কাছে ছিলো আনন্দ। ছাপাঘরের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে রোদ্দুরেই মুক্তি পেতে চেয়েছিল সে। 

আবার কাঁধে এক চিলতে রোদের ছোঁয়া নিয়েই জগতের আনন্দযজ্ঞে মেতে উঠেছিলেন জন ডেঁভার। আমেরিকার মানবদরদী সেই শিল্পী। 

'সানসাইন অন মাই শোলডার

মেকস মি হ্যাপি!'

একমুঠো রোদ্দুর তাঁর চোখে ঢেলে দিতো দুচোখ ছাঁপানো আনন্দাশ্রু। কান্নাহাসির দোলদোলানো ওই চকচকে রোদ্দুরেই। 

রোদ্দুরের সঙ্গে কোনদিন দেখা হয়না চাঁদের আলোর। তবে যেটা কেউ জানে না, রোদ্দুরকে বুকে ধরেই চাঁদের রাতযাপন। রোদ্দুরও তখন জোছনা।

মাঝরাতের জলসা শেষ হলেই একা চাঁদ। ভেসে যায়। আপনমনে। বিষন্ন। বিদায়বেলা আসন্ন। এগিয়ে আসে সূর্য। ছুঁতে পারে না। এমনই নিয়তির বিধান। লজ্জায় মুখ ঢাকার জন্য দরকার একটু অন্ধকার। প্রহরশেষ রাতের সেই অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে এগিয়ে আসতে থাকে সূর্য। সরতে থাকে চাঁদ।

(  চিত্র ঃ সংগৃহীত )

মন্তব্যসমূহ