প্রয়াত কবি শঙ্খ ঘোষ

 শ্রদ্ধায় স্মরণ 


।। স্তব্ধ বাংলার শঙ্খ ।।




 কাজল ভট্টাচার্য, কলকাতা,  ২১ এপ্রিল

স্তব্ধ বাংলার শঙ্খনাদ। এবার শুধুই লাল নীল সবুজের খিস্তিখেউর। মোদির সোনার বাংলা আর মমতার জয় বাংলা।


এক কবির মৃত্যু।
প্রয়াত শঙ্খ ঘোষ।
অস্থির বাংলা বাঙালিকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে গেলো এক অনন্ত প্রশ্নের মুখোমুখী।
বঙ্গ কুরুক্ষেত্রের মেয়াদ আর কতদিন?
বাংলার শঙ্খ স্তব্ধ। রীতি অনুযায়ী, যুদ্ধের সূচনা হয় শঙ্খধ্বনিতে, বেলাশেষে সমাপ্তিও ওই শঙ্খধ্বনিতে।


চাপ ঘরে বাইরে। 
কোভিডের দ্বিতীয় তরঙ্গ উঠতে না উঠতেই হাসপাতালে ঠাই নাই ঠাই নাই। ছোট এ তরী। 
- কেন?
উন্নয়নের ঢেউয়ে তো বাংলাভাসি হয়েছিল। বছর তিনেক আগে, সেদিনও সেই উন্নয়নের ঢেউ ঠাহর করে উঠতে পারেননি কবি শঙ্খ ঘোষ। মেরুদণ্ডহীন বাঙালির হয়ে কবিতায় সেকথাই সরাসরি বলেছিলেন।
- 'রাস্তা জুড়ে খড়্গ হাতে
দাঁড়িয়ে আছে উন্নয়ন...'


কবির ঔদ্ধত্যের জবাবও মিলেছিল।
'এ কোন নতুন কবি উঠে এসছেন? যে আমার উন্নয়ন নিয়ে কথা বলছেন?'
সপাটে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন শাসকদলের দাপুটে নেতা অনুব্রত মণ্ডল।
'শঙ্খ নামের অপমান করেছেন উনি।' তারপরেই তাঁর সেই সদম্ভ উক্তি- 'এখনও বলছি, রাস্তায় উন্নয়ন দাঁড়িয়ে আছে।'


ঢোঁক গিলেছিল তথাকথিত বঙ্গ বুদ্ধিজীবী সমাজ। ব্যাপারটা না পেরেছিল গিলতে, না পেরেছিল ওগড়াতে। কারণ অনুব্রতবাবুর সঙ্গে এই সমাজের তফাত একটাই, অনুব্রত মণ্ডল এতদিন কবি বলতে রবীন্দ্রনাথ নজরুলের নামই শুনেছিলেন। শঙ্খ ঘোষের নাম শোনেননি। তাই তিনি সরল মনেই জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কে এই নতুন কবি? বিদ্বজ্জনেরা অনুব্রতবাবুর সেই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন কিনা জানি না। তবে একথা হলপ করে বলাই যায়, বাংলার বিদ্বজ্জনেরা আগেই শঙ্খ ঘোষ নামের এক কবির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন।


তবে ধন্যবাদ অনুব্রতবাবুকে, একটানে বাংলার তথাকথিত সারস্বত সমাজের মুখোশ টেনে ছিঁড়ে ফেলে দেওয়ার জন্য। এরজন্যও বুকের পাটা লাগে। আর বীরভূমের অনুব্রত মণ্ডলের মত মানুষরাই এই বীরত্ব দেখাতে পারেন।
আর পারতেন বাংলার কবিরা। যেমনটা পেরেছিলেন শঙ্খ ঘোষের অগ্রজ আর এক কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। শাসকের সামনে শিশুর মতো নির্লিপ্ততায় বলতে পারতেন- 'রাজা, তোর কাপড় কোথায়?' 


কী বলেন বাংলা বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে সর্বক্ষণ গলার নলি ফুলিয়ে চিৎকার করে চলা, স্বঘোষিত বাংলার অভিভাবক সংগঠনের কর্তাব্যক্তিরা?


কবি মারা যান না। 
মারা গেলেন শঙ্খ ঘোষ নামের শরীরটা। ওই শরীরটার যে এমনকিছু বিশেষত্ব ছিলো না, তা অনেকদিন আগেই খোলামনে, কথার জাল না বুনে, সরাসরি তাঁর পরিচিত ভঙ্গিমায় বুঝিয়ে দিয়েছিলেন অনুব্রত মণ্ডল। 
বলেছিলেন, 'কবির নাম শঙ্খ রাখা ঠিক হয়নি।'


নীরব ছিলেন কবি। সবার সবকথা শুনলে চলে না কবির। আবার অনেকসময় তিনি অপেক্ষা করে থাকেন ঠিক সময়ে ঠিক জবাবটি দেওয়ার জন্য। দিলেনও তাই।


শরীরটাকে খুবলে খেয়েছিল কোভিড। তাই কবির শরীর আপাতত অস্পৃশ্য। তাকে ফুলমালা চন্দন দিয়ে সাজানোর সুযোগ দিলেন না কবি। এমন চরম আত্মাভিমানের মালিক একমাত্র 'অবিক্রিত' কবি শিল্পীরাই হন। রাজনেতারা সেকথা ভাবতেও পারেন না। আপোষ আর সমঝোতার রাজনীতি করতে করতে বেঁকে যায় তাঁদের শিরদাঁড়া।
ঠিক যেমনটা দশা হয় রাজকৃপা লোভী বিদ্বজ্জনের।


কবির ফেলে যাওয়া নিস্পন্দ শরীরের শুদ্ধিকরণে পৌরোহিত্য করবেন স্বয়ং অগ্নিদেব। নতুন শরীরের আশ্রয়ে ফিরে আসুন কবি। ফিরে আসুন জীবনানন্দের হাত ধরে বাংলার 'ধানসিঁড়িটির তীরে'।
আমরা ততদিন তাঁর বন্দনায় বিশ্বকবির ছন্দে গাই- তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে।

মন্তব্যসমূহ