প্রথম পর্যায়ের ভোট গ্রহণ শেষ , স্বস্তিতে নেই রাজ্যের যুযুধমান রাজনৈতিক দলগুলি -কাজল ভট্টাচার্যের বিশেষ কলম

 


            ঘুম ছুটেছে তিন প্রতিদ্বন্দ্বী শিবিরের 



কাজল ভট্টাচার্য, কলকাতা, মার্চ ২৮


সারাবছর নিয়ম মেনে ঠিকঠাক পড়াশোনা করলে, পরীক্ষার আগে রাতের ঘুম নষ্ট করতে হয় না। শৈশবে শেখানো এই আপ্তবাক্যটি, রাজনৈতিক ধুরন্ধররা হয় ভুলে গেছেন, নয়তো কাজে ফাঁকি মেরেছেন। আর তাই ভোট পরীক্ষার দিনক্ষণ জানার আগে থেকেই দাপাদাপি করে মরা।
তবে নির্বাচন কমিশনের কড়া মনোভাব আর কেন্দ্রীয় বাহিনীর সতর্ক নজরদারিতে, ঘটনা দাপাদাপিতেই আটকে রাখা গেছিলো। তা শেষ পর্যন্ত খুনোখুনিতে গড়ায়নি। ছাপ্পা ভোট, ইভিএমে কারচুপির মতো বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনার অভিযোগ পাওয়া গেলেও, পাঁচবছর আগের নির্বাচনের সেই ভয়াবহ ছবির সাক্ষী হয়নি বাংলা। শনিবার মোটামুটি শান্তিতেই মতদান হলো পশ্চিমবঙ্গের একুশে নির্বাচনের আটদফার প্রথম পর্ব।

মোট পাঁচটি জেলার তিরিশটি বিধানসভা কেন্দ্রের ভাগ্যপরীক্ষা হয়ে গেল শনিবার। হামলার মুখে পড়েন সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী সুশান্ত ঘোষ। অভিযোগের আঙুল তৃণমূলের দিকে। একই ঘটনার সাক্ষী হন সৌমেন্দু অধিকারী। তাঁর গাড়ি ভাঙচুরের জন্যও কাঠগড়ায় তৃণমূল কংগ্রেস। ওদিকে ইভিএমে কারচুপির অভিযোগে বিক্ষোভ দেখান জোড়াফুল শিবিরের কর্মী সমর্থকরা। সবমিলিয়ে 'খেলা হয়েছে' ঠিকই, কিন্তু নির্বাচনের কমিশনের কড়া ভূমিকায় খেলা সেভাবে জমে উঠতে পারেনি। অভিযোগে উঠেছে, কিছু জায়গায় অকারণেই লাঠি চালিয়েছে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানরা। কমিশনকে আরও কড়া হতে হবে দাবি সব পক্ষেরই।

প্রথম দফার ভোটে মূল বিরোধী শিবিরের সিলমোহর আপাতত পদ্ম শিবিরের গায়েই দেগেছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। লড়াই সরাসরি বিজেপি, তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে। এরইমধ্যে নিজের জায়গা করে নিতে চাইছে সংযুক্ত মোর্চা।

এখনও সাতদফা লড়াই বাকী। শাসকদল সমেত অন্য দুই বিরোধী শিবিরের দাবি তারাই ক্ষমতায় আসতে চলেছে। তবে কোন পক্ষেরই এই দাবির মধ্যে ঠিক কতটা আত্মবিশ্বাস আছে, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশের জায়গা আছে বৈকি। জোড়া ফুল শিবিরের বহিরাগত ইস্যুতে ঠিক কতটা কার্যসিদ্ধি হবে বলা মুশকিল। ওদিকে পদ্ম শিবিরের সোনার বাংলার স্বপ্নেও বাংলা ঠিক কতখানি ভরসা রাখতে পারবে, তা বলার সময় আসেনি।
চির পরিচিত দুই বিরোধী শিবির কংগ্রেস, বামফ্রন্টের হাত ধরাধরির মধ্যেই ঢুকে পড়েছে ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট। তবে তিন প্রতিপক্ষই যেভাবে দাঁতে দাঁত চেপে মরণপণ লড়াইয়ে নেমে পড়েছে তাতে পরিষ্কার, লড়াইয়ের ফল কী হবে সে ব্যাপারে তাদের নিজেদেরই যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তাই একুশের নির্বাচনী কুরুক্ষেত্রে গোটা ব্যাপারটাই দাঁড়িয়েছে- বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যাগ্র মেদিনী।

লড়াইয়ের তীব্রতা দেখে রাজনৈতিক মহলের ধারনা জয়ের মালার মূল দাবিদার জোড়াফুল বা পদ্ম শিবির। তবে এবার তেড়েফুড়ে লড়াইয়ের ময়দানে নেমে পড়েছে তিন শরিকের সংযুক্ত মোর্চা। আগামিদিনে এই মোর্চার ভবিষ্যতটাই বা কী? এব্যাপারে পর্যবেক্ষকদের ধারনা, তৃণমূল বিজেপির পাঞ্জা কষাকষিতে যদি কোনপক্ষই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পায়, তাহলেই গুরুত্ব বাড়বে মোর্চার। সে ক্ষেত্রে সরকার গড়তে নির্ণায়ক ভূমিকা নিতে পারে মোর্চা।




তবে প্রথম দফার ভোটে পরিষ্কার, বাংলা আছে বাংলাতেই। কমিশনের কড়া তত্ত্বাবধান আর কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের সদাসতর্ক পাহারাদারীতে কোনও দলের কর্মী, সমর্থকরাই লাগামছাড়া বেপরোয়া হওয়ার স্পর্ধা দেখায়নি। তারই সুফল হিসেবে প্রথম দফায় সন্ধ্যা ছ'টা পাঁচ মিনিট পর্যন্ত ভোট পড়েছে ৭৯.৭৯ শতাংশ। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি স্বতঃস্ফূর্ততা দেখিয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুর। সেখানে মতদানের হার ৮২.৪২ শতাংশ। আর সর্বনিম্ন পুরুলিয়াতে, মোট ৭৭.১৩।

ভোটের ঢের আগে নিজের রিপোর্ট কার্ড নিজেই তৈরি করে ফেলেছিল তৃণমূল। নিজেদের তৈরি করা রিপোর্ট কার্ডে তাদের নিজেদের ভরসা থাকলে, জোড়া ফুল শিবির নিশ্চিন্তে দিবানিদ্রায় যেতে পারে। অন্যদিকে নিজেদের বিশ্বস্ততা প্রমাণে উঠেপড়ে লেগেছে বিজেপি, সংযুক্ত মোর্চা। তৃণমূল দলছুটদের দিয়ে নির্বাচনী কুরুক্ষেত্র জেতার রণকৌশল মানুষের কাছে ঠিক কতটা গ্রহণযোগ্য হলো, তা মোটেই সন্দেহের উর্ধ্বে নয়। মোর্চার দুই শরিক বামফ্রন্ট আর কংগ্রেসের অতীত বাংলার মানুষ জানে। যে শিক্ষা, কর্মসংস্থান নিয়ে মোর্চা বাজার গরম করার চেষ্টা চালাচ্ছে, বামফ্রন্টের চৌত্রিশ বছরের জমানায় মানুষের অভিজ্ঞতা ঠিক উল্টোটাই। গত বিধানসভা নির্বাচনেও বাংলা প্রত্যাখান করেছিল রাজ্যের বামপন্থীদের।

আপাতত তিন প্রতিদ্বন্দ্বীই নিজেদের ঢাক নিজেরাই পিটিয়ে চলেছে। ওদিকে আটদফা নির্বাচন শেষ হলেই দলগুলির হাতে তাদের রিপোর্ট কার্ড ধরাবে বাংলার মানুষ। তারপরেই বোঝা যাবে কে পাস কে ফেল। আর সেই চিন্তাই চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছে তিন প্রতিদ্বন্দ্বী শিবিরের।

মন্তব্যসমূহ