রবিবাসরীয় সাহিত্যের দিন প্রতিদিন - সন্দীপ চক্রবর্তীর ধারাবাহিক উপন্যাস / ধুলো

 


ধারাবাহিক উপন্যাস 


 আধুনিক বাংলা সাহিত্যের নবীন লেখক সন্দীপ চক্রবর্তী । সন্দীপ লেখেন, নিজের অনুভুতি দিয়ে। সেখানে পাওয়া যাবে নিজেকে খুঁজে। বর্তমানে সন্দীপ একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের অন্যতম ।সন্দীপের নতুন উপন্যাস   ধুলো# ৭ । একেবারে এক নতুন চিন্তা ধারার প্রতিফলন।  আগামীদিনে   সঙ্গে থাকবেন।


                            ধুলো # ৭






সন্দীপ চক্রবর্তী
শশধর পণ্ডিতের দেওয়া একমাস সময়ের অর্ধেক কেটে গেল। এখনও শোভেনের দেখা নেই। রমেনবাবু দিন-দিন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছেন। উঠতে-বসতে নন্দকে গালাগাল দেন। নন্দ বিশেষ সাড়াশব্দ করে না। মুখ বুজে কাজ করে যায়। আগেও সে বেশি কথা বলত না, সেদিন মন্দির থেকে ঘুরে আসার পর থেকে আরও চুপচাপ হয়ে গেছে৷ ফাঁক পেলেই ভবিষ্যতের ভাবনায় তলিয়ে যায়৷ তারক ঠাকুর তাকে মায়ের কাজ করার কথা বলেছেন কিন্তু কী কাজ বলেননি। মন্দিরে কত কাজই তো থাকে। বাজারহাট, রান্নাবান্না, বাসনপত্তর মাজাধোওয়া--- ভাবতে ভাবতে নন্দর মন ঘুরে যায় ভিখুর দিকে। আর ঠিক তখনই ধুলোয় ভরে যাওয়া তার মনের আনাচেকানাচে মাথা তোলে দু'একটি কচি চারা। সবুজ পাতারা হাওয়ায় দোল খায়৷ ফুল ফোটে। নন্দ মুখ ফিরিয়ে নিতে চায় কিন্তু পারে না। স্পষ্ট শুনতে পায় ভিখুর গলা, 'আমার সঙ্গে পুতুল খেলবে নন্দদা?' আধবুড়ো নন্দ ফিসফিস করে বলে, 'খেলব।'
শ্রাবণ মাস পড়তেই নন্দর নির্নিমেষ প্রশান্তিতে বাধা পড়ল৷ টানা চারদিন উথালপাথাল বৃষ্টি। সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া। কত মাটির বাড়ি যে ভেঙে পড়ল আর কত টিনের চাল যে উড়ে গেল তার ঠিক নেই। রাজবাড়ির অবস্থাও খুব খারাপ। নোনা ধরা দেওয়ালে জলের দাগ। জানলার পাল্লার ফাঁকফোকরে বৃষ্টির ছাট। রমেনবাবুর ঘরে দু'দণ্ড দাঁড়ালে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়।
বিপদ আঁচ করে নন্দ কম্বল বের করল। গলা পর্যন্ত কম্বলে ঢেকে রমেনবাবু বললেন, 'এটা ভালো করেছিস। বড্ড শীত করছিল।'
নন্দ কিছু না বলে চলে যাচ্ছিল, রমেনবাবু ডাকলেন, 'নন্দ। তুইও কি আমার মতো চতুর্দিকে ধুলো দেখছিস?'
দীর্ঘদিনের অভ্যেসবশত নন্দ ডাক্তারি শুরু করতে যাচ্ছিল, শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিল। রামতারক তাকে ডাক্তারি করতে বারণ করেছেন৷ মা ভবতারিণীর নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করতে বলেছেন। সে তাই করবে। রমেনবাবুর মাথায় হাত বুলিয়ে নন্দ বলল, 'কোথাও তো ধুলো নেই বাবু। ওসব আপনার মনের ভুল। ঘুমিয়ে পড়ুন দেখবেন সব ঠিক হয়ে গেছে।'
রমেনবাবু ঘুমিয়ে পড়লেন। কিন্তু নন্দর চোখে ঘুম এল না। মাথায় দুশ্চিন্তার পাহাড়। রমেনবাবু অসুখে পড়বেনই। তখন সে কী করবে? চুপচাপ হাত গুটিয়ে বসে থাকবে? সহ্য করতে পারবে মানুষটার কষ্ট? বিদ্রোহ করে উঠল নন্দর মন, 'তা হয় না। আমি পারব না ঠাকুর। একটা বাপ-মা মরা অনাথ ছেলেকে ওই মানুষটা আশ্রয় দিয়েছিল। মা বলত, শোভেন আমার বড়ো আর তুই ছোট। মায়ের জন্য কিছু করতে পারিনি কিন্তু ওই বুড়ো লোকটা যদি আমার ক'টা মিছে কথা শুনে চাঙ্গা হয় তাতে দোষ কী ঠাকুর!'
দোষগুণের বিচার হল না। নন্দও অনুভব করল তার বিদ্রোহী মন কখন যেন শান্ত হয়ে গেছে। বিশ্বাসের সেই জোর নেই। উৎসাহ নেই। মন যেন বলতে চায়, 'মিছে কথা বলে কাজ নেই৷ তারক ঠাকুরের কথাই ঠিক। বাবুর আয়ু আছে বলেই এখনও টিঁকে আছেন। তোমার ডাক্তারিতে বাবু সেরে যায়, এসব তোমার অহংকার।' নন্দ জোর করে বলতে চাইল, 'একটা মানুষ যদি সুস্থ হয়ে ওঠে তো অহংকারই সই।' কিন্তু বলা হল না। চোখের সামনে ভিখুর সুন্দর মুখটা দেখে নন্দর কথা আটকে গেল।
নন্দর অনুমান মিথ্যে নয়। পরের দিনই রমেনবাবু অসুখে পড়লেন। প্রবল কাশি আর হাঁপের টান। এই দুই শত্রুর সঙ্গে নন্দর পরিচয় আছে৷ কিন্তু এবার রমেনবাবু জ্বরও বাধিয়ে বসলেন। গায়ে হাত দিলে হাত পুড়ে যায় এমন জ্বর।
অবনী ডাক্তার দায়সারা ভাবে রুগি দেখে বলল, 'ওষুধে আর রাজাবাবুর কাজ হবে না। যা করার তোকেই করতে হবে।'
'তা হয় না ডাক্তারবাবু। আপনি যদি না পারেন আমাকে তা হলে সদরে বড়ো ডাক্তারবাবুর কাছে যেতে হবে।'
গেঁয়ো অশিক্ষিত একটা চাকরের কাছে অবনী ডাক্তার এই জবাব আশা করেনি। তার চেয়েও বড়ো কথা রমেনবাবুর নাম ব্যবহার করে সে বিস্তর রোজগার করেছে। এখন যদি সদরের ডাক্তার এসে গুড় খেয়ে বেরিয়ে যায় ভিন গাঁয়ের লোক আর তাকে মানবে না। সম্ভাব্য লোকসানের কথা চিন্তা করে অবনী ডাক্তার হেসে বলল, 'আহা আমি পারব না সে কথা আবার কখন বললুম!
রমেনবাবুর জ্ঞান নেই। কথা আছে না নেই ঠিক বোঝা যায় না৷ অবনী ডাক্তার নতুন প্রেসক্রিপশন লিখল। যাবার সময় বলে গেল, 'ওষুধগুলো এখনই এনে খাওয়াতে শুরু কর। আর কাত্তিকের ওষুধের দোকানে আমি বলে দিচ্ছি৷ একটু পরে গিয়ে একটা অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে আসবি। দুগগা দুগগা।'
সিলিন্ডার এল৷ নন্দ এসব জানে৷ হাওয়ার কল খুলে যত্ন করে রমেনবাবুর নাকে লাগিয়ে দিল নলদুটো৷ তারপর বুকে কান ঠেকালো--- হ্যাঁ, ধুকপুক করে চলছে বটে হৃদয়টা। একটু আগেও রমেনবাবু খাবি খাচ্ছিলেন। বিদঘুটে ঘড়ঘড় শব্দটা শুনতে শুনতে নন্দ ভাবছিল মানুষ তার শরীরে জল ধরে রাখতে পারে, খাবার ধরে রাখতে পারে কিন্তু হাওয়া কেন পারে না। এখন আর সেই ঘড়ঘড় শব্দটা নেই। ঘরের ভেতর কোনও শব্দই নেই। বাইরে শুধু ঝড়ের সোঁ সোঁ শব্দ।
(আগামী সপ্তাহে সমাপ্য)

মন্তব্যসমূহ