নন্দীগ্রামের মহারণে রামায়ণেই ভরসা জোড়াফুল শিবিরের
রাজদর্শী রায়, কলকাতা
'কাউকে ফোন করা অপরাধ নয়।' নন্দীগ্রামের বিজেপি নেতা প্রলয় পালের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর কথাবার্তার ভাইরাল হওয়া ফোনের সত্যতা স্বীকার করে নিলেন খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পাশাপাশি কুড়ি দিন পর মঙ্গলবার শেষবেলার প্রচারে, পায়ে ক্রেপ ব্যান্ডেজ নিয়েই তিনি মঞ্চে উঠে দাঁড়ালেন। মঞ্চে তখন জাতীয় সঙ্গীতের মূর্ছনা।
একেই বলে ভোট বড় বালাই।
ওদিকে তার আগেই দিল্লি থেকে উড়ে নন্দীগ্রামের মাটিতে হাজির দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তিনি হুঙ্কার দিলেন, মমতা দিদিকে হারাতেই হবে। তাহলে নিজে থেকেই বাংলায় হার স্বীকার করে নেবে তৃণমূল কংগ্রেস।
জোড়া ফুল পদ্ম শিবিরের মহারণের মধ্যেই হারানো জমি পুনরুদ্ধারের স্বপ্নে হাজির, সংযুক্ত মোর্চার বড় শরিক সিপিএম। তাদের মরণ- বাঁচন লড়াইয়ে সামিল হতে প্রার্থী মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে বেশ জমিয়ে মিছিল সারলেন দলের প্রবীণ নেতা বিমান বসু।
প্রচারের শেষবেলাতে নন্দীগ্রামের উষ্ণতা যেভাবে বাড়লো, তারদিকে কড়া নজর রেখে চলেছে নির্বাচন কমিশন। কেন্দ্রীয় বাহিনীকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে বৃহস্পতিবার, ভোটের দিন বাহিনীকে টার্গেট করে অশান্তি বাঁধানোর চেষ্টা হলেই গুলি চালাতে।
সবমিলিয়ে মঙ্গলবার যথার্থই ভিয়েতনামের চেহারা নিলো পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রাম।
হাতে আর মাত্র কয়েকঘণ্টা। রাত পোয়ালেই মহারণের সূচনা। শুরু হতে চলেছে চার জেলার তিরিশ বিধানসভা কেন্দ্রের ভাগ্যপরীক্ষার দৌড়। আর তারই প্রস্তুতিতে শেষ ছোঁয়া দিতে মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত দাপিয়ে প্রচারে ইতি টানলেন তিন শিবিরের নির্বাচনী কুশীলবরা।
আক্ষরীক অর্থেই যেন ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। কলকাতার ভবানীপুর থেকে সবার নজর সরে এখন মেদিনীপুরের নন্দীগ্রামে। একুশে বিধানসভা নির্বাচনে নন্দীগ্রাম দখলের লড়াই অন্য কারুর হাতে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারেননি তৃণমূল সুপ্রিমো। এবার সেখানে তিনি নিজেই হাজির মহারণের মোর্চা সামলাতে। নন্দীগ্রাম বিধানসভা প্রার্থী রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিপক্ষ তাঁর প্রাক্তন বিশ্বস্ত সেনাপতি, জোড়াফুল শিবির দলছুট বিজেপির শুভেন্দু অধিকারী। শুভেন্দুকে শক্তি জোগাতে বাঙালির মহাগুরু মিঠুন চক্রবর্তীকে নিয়ে রোড শো করে গেলেন অমিত শাহ।
যে নন্দীগ্রাম ইস্যুতে লালদুর্গে ধ্বস নেমেছিল, সেই নন্দীগ্রাম থেকেই ফের দৌড় শুরু করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে সংযুক্ত মোর্চার প্রধান শরিক সিপিএম। মোর্চার প্রার্থী বর্ধমানের মেয়ে সিপিএমের যুব সংগঠনের রাজ্য সভানেত্রী মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়। নির্বাচনের ফল বেরোলেই বোঝা যাবে সিপিএমের ওই সিদ্ধান্ত ঠিক কতটা সঠিক ছিলো। নাকি এক অসম লড়াইয়ে নেহাতই তরুনী মীনাক্ষীকে নামিয়ে নিজেদের পিঠ বাঁচালেন আলিমুদ্দিনের কর্তারা।
বিজেপির জয় শ্রীরাম হুঙ্কারে তৃণমূলনেত্রীর যতোই আপত্তি থাকুক না কেন, রামের কূটকচালি চালেই শুভেন্দু বধ করার রণকৌশল নিয়েছেন তিনি। সুগ্রীবকে হাত করে বালিহত্যার মতোই, সম্মুখ সমরের আগেই প্রতিপক্ষের শিবিরে ফাটল ধরানোর ছক কষে এগোলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
নন্দীগ্রামে তাঁর পায়ে চোট লাগার ঘটনা চক্রান্ত নাকি নিছকই এক দুর্ঘটনা? তা নিয়ে ব্যাপক জলঘোলার পরেও, ষড়যন্ত্রের তত্ত্বে অনড় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গোটা ঘটনার জন্য ইঙ্গিতে শুভেন্দু অধিকারীকেই খলনায়ক বানিয়েছেন তিনি। এরপরেই মঙ্গলবার জনসভায় তিনি জানিয়ে দিলেন, মুকুল শুভেন্দুর মতো এত খারাপ নয়। শেষবেলার প্রচারে মুকুলকে তোল্লা দিয়ে শুভেন্দুর গায়ে গদ্দারের সিলমোহর দেগে দিলেন তৃণমূল সুপ্রিমো। পাশাপাশি তিনি উসকে দিতে চেয়েছেন পদ্ম শিবিরে প্রার্থী বাছাই নিয়ে অসন্তোষকেও। সায়ন্তন বসু, জয়প্রকাশ মজুমদারের মতো নেতাদের টিকিট না দেওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'সিপিএমের হার্মাদ আর তৃণমূলের গদ্দারদের টিকিট দিয়েছে।'
এরপরেই নন্দীগ্রামের বিজেপি নেতা প্রলয় পালকে ফোন করার গোটা ঘটনাটির মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার কৌশল নেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এব্যাপারে তাঁর মন্তব্য, 'কাউকে ফোন করা অপরাধ নয়। সেই ফোন ভাইরাল করা অপরাধ।' ফোন করার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, 'শুনেছিলাম কেউ কেউ আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়। সেই অনুরোধ রাখতেই প্রলয় পালকে ফোন করেছিলাম।'
ওদিকে নন্দীগ্রামে বসেই 'মমতা দিদি'কে গো- হারা করানোর ডাক দিলেন অমিত শাহ। তাহলে আর গোটা বাংলার কথা ভাবতে হবে না। সেখানে নিজে থেকেই হেরে যাবে জোড়াফুল শিবির। এরপরেই এক ধর্ষণের ঘটনা টেনে শাহ রাজ্যে মহিলা সুরক্ষার প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, 'মুখ্যমন্ত্রী যখন নন্দীগ্রামে, ঠিক তখনই তার পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে এক মহিলা ধর্ষিতা হলেন।' তাঁর অভিযোগ, কিছুদিন আগেই বিজেপি করার জন্য দলের এক কর্মীর বৃদ্ধা মাকে পিটিয়ে খুন করে তৃণমূল কর্মীরা। আরোপ প্রত্যারোপের পাশাপাশি এদিন চমকও ছিলো অমিত শাহর মিছিলে। শুভেন্দুর সঙ্গে মিছিলে ছিলেন মিঠুন চক্রবর্তী। তাঁকে একবার চোখের দেখা দেখতে রীতিমতো শোরগোল পড়ে যায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো মঙ্গলবারের মানুষের এই ঝড় আদৌ ইভিএমে কোনও প্রভাব ফেলবে কি?
নন্দীগ্রামে এবার ঠিক কোন ইস্যুতে ভোট হবে?
উন্নয়ন নিয়ে যে যতোই গলা ফাটান না কেন, এলাকার মানুষের চাপা ক্ষোভের খবর রাখেন সব পক্ষই। যার জন্য দশবছর ক্ষমতায় থাকার পর মুখ্যমন্ত্রীর কথায় ফিরে আসছে বামফ্রন্ট জমানার পুলিসের অত্যাচারের কাহিনী। অধিকারী পরিবারের সরাসরি নাম না নিয়ে, নন্দীগ্রামে পুলিস ঢোকানোর দায় 'বাপবেটা'র দিকে ঠেলে নিশ্চিন্ত হতে চাইছেন তিনি। প্রতিশ্রুতি দিতে হচ্ছে নন্দীগ্রামকে 'মডেল' করে সাজানোর। তবে এরইমধ্যে চোরাস্রোত বইছে জাতপাতের রাজনীতির। কোনও পক্ষের হিসেবে তিরিশ শতাংশ, আবার কারও হিসেবে আরও বেশি সংখ্যক সংখ্যালঘু ভোটার আছেন নন্দীগ্রাম বিধানসভা এলাকায়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই ভোটব্যাঙ্কের ওপর নন্দীগ্রামের ভাগ্য অনেকটাই নির্ভর করছে।
সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কের মূল দাবিদার হিসেবে নিজেকেই এগিয়ে রেখেছে জোড়াফুল শিবির। পাশাপাশি বর্ণহিন্দু ভোটব্যাঙ্ককে তৃণমূলনেত্রী মনে করিয়ে দিয়েছেন, 'আমার গোত্র শাণ্ডিল্য।'। বিজেপির অভিযোগ, সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্ক ঘরে তুলতে তুষ্টিকরণের রাজনীতি করছে জোড়াফুল শিবির। তবে অনেকেই মনে করছেন, এবার ওই ভোটব্যাঙ্কে ভাগ বসাবে সংযুক্ত মোর্চা। এব্যাপারে শরিক হিসেবে মোর্চার সহায় হবে ফুরফুরা শরিফের পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকির ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট। সেক্ষেত্রে দুশ্চিন্তার ভার অনেকটা লাঘব হতে পারে শুভেন্দুর।
কথায় আছে, এক রামে রক্ষা নাই সুগ্রীব দোসর। সিপিএমের লড়াইটাও ঠিক তেমনই। জোড়াফুল, পদ্মফুল দুয়েতেই সাম্প্রদায়িক গন্ধ পায় আব্বাস সিদ্দিকিকে নিয়ে গড়া জোটের বড় শরিক সিপিএম। তৃণমূল বিজেপির তরজায় ফায়দা তোলার চেষ্টা করছে সংযুক্ত মোর্চা। অধিকারী পরিবারের ওপর মমতার অভিযোগের সূত্র ধরেই সিপিএম এক তীরে দুই পাখি মারার কৌশল লুফে নিয়েছে। দলের বক্তব্য, সেদিনের চক্রান্তকারীরাই আজ দুই শিবিরে ভিড়ে খেয়োখেয়ি করছে। এদের কেউ বিশ্বাসযোগ্য না।
মোর্চার লড়াইকে উসকে দিতে রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের রেকর্ডেড বার্তাকে হাতিয়ার করেছে সিপিএম। বার্তায় বলা হয়েছে, মমতা জমানায় রাজ্যের কৃষিব্যবস্থা পিছিয়ে পড়েছে। আবার শিল্পও হয়নি। নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুরে আজ শ্মশানের নীরবতা।
নজর নন্দীগ্রামে আটকে থাকলেও ডেবরা বিধানসভা নির্বাচনও কিন্তু কম আকর্ষনীয় না। সেখানে লড়াই দুই আইপিএসের। একদা মমতা ঘনিষ্ঠ পুলিস অফিসার ভারতী ঘোষ লড়ছেন বিজেপির টিকিটে। তাঁকে চ্যালেঞ্জ জানাতে হাজির তৃণমূলের হুমায়ুন কবীর। সেখানেও ভোটবাজার গরম করতে সদলবলে ছুটে যান অমিত শাহ।
নির্বাচন কমিশনের কড়া সিদ্ধান্তে দুষ্কৃতীরা পিছু হটবে বলেই আশা এলাকার রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক মহলের। তবে অনেকেরই আশঙ্কা, গোটা ঘটনার প্রভাবে পড়বে এলাকার সাধারণ মানুষের ওপরেও। সেক্ষেত্রে কমতে পারে মতদানের হার। কেন্দ্রীয় বাহিনীকে টার্গেট করে হামলা চালানো হলেই, প্রয়োজনে গুলি চালানোর অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্তকে, শাসকদলের কর্মী সমর্থকদের একাংশ বাড়াবাড়ি বলে মনে করছেন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন