আধুনিক বাংলা সাহিত্যের নবীন লেখক সন্দীপ চক্রবর্তী । সন্দীপ লেখেন, নিজের অনুভুতি দিয়ে। সেখানে পাওয়া যাবে নিজেকে খুঁজে। বর্তমানে সন্দীপ একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের অন্যতম ।সন্দীপের নতুন উপন্যাস ধুলো# ৪ । একেবারে এক নতুন চিন্তা ধারার প্রতিফলন। আজ প্রথম পর্ব । আগামীদিনে সঙ্গে থাকবেন।
ধুলো # ৪
রাজবাড়ির ভাঙা বারান্দা অন্ধকারে ডুবে যায় বটে কিন্তু অতীত ডোবে না। সে তার নিজস্ব আলো জ্বেলে ঠিকই ভেসে থাকে। অনুশোচনায় দগ্ধ হৃদয় বারবার সেই আলোর সামনে নতজানু হয়।
রমেনবাবু নিজেকে প্রশ্ন করেন, 'আজ আমি এই রাজবাড়ির মতো ধুলো হয়ে গেছি কিন্তু সেদিনও কি তাই ছিলাম?'
না, সেদিন তিনি অন্যরকম ছিলেন। বিপরীতও বলা যায়। তার জেদ ছিল। অহংকার ছিল। বংশগৌরব ছিল। কিন্তু সাহস ছিল না। সেই মারাত্মক অসংগতি ঢেকে রাখার জন্য তিনি গ্রামের মেঠো রাস্তায় ধুলো উড়িয়ে ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়াতেন। রাইফেল কাঁধে নিয়ে শিকারে যেতেন। জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত করে দিয়েছিল সরকার। সংস্কারের অভাবে রাজবাড়িও একটু একটু করে ভেঙে পড়ছিল। তবুও তিনি বাইরের ঠাট বজায় রেখেছিলেন।
প্রায় অচল হতে বসা সংসারটাকে একার হাতে আগলে রেখেছিলেন অন্নপূর্ণা। না, অলস কর্মবিমুখ স্বামীর পূর্বপুরুষের রেখে যাওয়া সম্পত্তি ভেঙে মাছের মুড়ো খাওয়ার প্রতিবাদ তিনি কখনও করেননি। তার স্ত্রী-ধর্মে স্বামী দেবতা। দেবতার অপরাধ উপেক্ষণীয়। স্বাভাবিক ভাবেই শোভেনের লেখাপড়ার জন্য তাকে অনেকবার গয়নার বাক্সে হাত দিতে হয়েছে। শোভেন প্রতিবাদ করলে বলতেন, 'এত গয়না আমার কী হবে ভানু! ওই সাতনরি হার আর কঙ্কন চারটে থাকলেই হল। ওগুলো দিয়ে আমি তোর বউয়ের মুখ দেখব।'
শোভেন কিছু বলত না। অন্নপূর্ণা বউয়ের প্রসঙ্গ তুললেই সে মনে মনে একটা মুখের ছবি আঁকত। কৃষ্ণকলি এক তরুণীর মুখ। আয়ত চোখ। কোমর ছাপানো চুল। শরীরের গড়ন খাজুরাহোর যক্ষিণীর মতো। নাম রূপমতি। সাঁওতাল পল্লীর মেয়ে রূপমতী। তার অঙ্গে অঙ্গে ঝরনার উচ্ছ্বাস। হাসিতে মহুয়ার নেশা। চুলে করৌঞ্জ ফুলের বুনো গন্ধ। রূপমতীকে ছাড়া অন্য কাউকে বউ করার কথা ভাবতে পারত না শোভেন। অন্নপূর্ণার কথায় সে তার অনাগত সুখের কল্পনায় বুঁদ হয়ে থাকত।
পঁচিশ বছর আগেকার কথা। সোনালদির পশ্চিম দিকে তখন দুর্ভেদ্য জঙ্গল। এ দিককার লোকে বলে শালোপাড়ার জঙ্গল। শালগাছের প্রাচুর্যের কারণে এরকম নাম হয়ে থাকতে পারে। রমেনবাবু শালোপাড়ার জঙ্গলে যেতেন পাখি শিকার করতে। সঙ্গে অ্যাসিসট্যান্ট নন্দ। গাছের ডালে বসা পাখি গুলি খেয়ে মাটিতে পড়লেই রমেনবাবু বলতেন, 'নিরীহ পাখি মারতে আর ভালো লাগে না। বাঘ-ভালুক না মারলে আর কীসের শিকারি!'
নন্দ মনে মনে হাসত। মুখে কিছু বলত না।
রমেনবাবুর মৃগয়াক্ষেত্র ছিল লোনাপানির খাল পর্যন্ত। খাল পেরিয়ে ওপারে যাওয়ার সাধ্য রমেনবাবুর ছিল না। ওপারে সাঁওতালদের গ্রাম। গ্রামের নাম খালের নামে। লোনাপানি। খালপাড়ে দাঁড়িয়ে রমেনবাবু বলতেন, 'আর ওদিকে নয় নন্দ। এবার ফিরে চল।'
এই সীমালঙ্ঘন না করার পিছনে একটা ইতিহাস আছে। সাঁওতালরা সাধারণত শান্তশিষ্ট প্রকৃতির হয়। লোনাপানির সাঁওতালেরাও তাই ছিল। নির্বিরোধী, শান্তিপ্রিয় আর প্রভুভক্ত। শাসকের সঙ্গে কোনওদিন তারা বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। দায়ে-দরকারে জীবনপণ করে রক্ষা করেছে জমিদারকে। সেই সময় জমিদারদের নিজস্ব লেঠেল বাহিনী থাকত। দুর্বিনীত প্রজাকে মেরে-ধরে বাগে আনাই ছিল তাদের কাজ। অনেক সময় আশেপাশের অন্য জমিদারদের বাড়িতে ডাকাতির কাজেও ব্যবহার করা হত লেঠেলদের। তবে সোনালদির লেঠেলদের প্রজাপীড়ন ছাড়া আর কোনও কাজ ছিল না।
প্রতাপচন্দ্রের আমলে কাজের পরিধি বাড়ল। প্রতাপচন্দ্র ছিলেন যেমন অত্যাচারী তেমনই লম্পট। বিশটা গ্রাম নিয়ে তার জমিদারি। নিজের জমিদারিতে কোনও সুন্দরী যুবতীর সন্ধান পেলে তার আর রক্ষে ছিল না। লেঠেলরা গিয়ে তাকে তুলে নিয়ে আসত। মেয়েটির বাবা মা ভাই-- যেই বাধা দিক তার গঙ্গাযাত্রা ছিল অবধারিত। তারপর বাবুর শখ মিটে গেলে মেয়েটিরও ঠাঁই হত লোনাপানির জলে। প্রজাকে মানুষ ভাবার শিক্ষা প্রতাপচন্দ্রের ছিল না। বরং তাদের কীটপতঙ্গের মতো অকিঞ্চিৎকর ভেবে তিনি বেশ আমোদ অনুভব করতেন।
সাঁওতাল মেয়েদের ওপর প্রতাপচন্দ্রের নজর প্রথমেই কেন পড়েনি সে কথা বলা মুশকিল। তবে প্রথমে না পড়লেও এক সময় পড়ল৷ আর একবার পড়ার পর পড়তেই থাকল৷ আনপড় জংলি সাঁওতালদের অনুনয় বিনয় প্রার্থনায় কান দেবার লোক প্রতাপচন্দ্র নন। তিনি জমিদার। প্রজার সঙ্গে তার খাদ্য-খাদক সম্পর্ক। তিনি ভেবেছিলেন এইভাবেই চলবে। কিন্তু চলল না। কখন সাঁওতালদের চাপা ক্ষোভ বিদ্রোহে রূপান্তরিত হয়েছে, আর কখনই বা কেষ্টঠাকুরের মতো বাঁশি বাজিয়ে ফেরা সাঁওতাল যুবক সনাতন টুডু সেই বিদ্রোহের নায়কে পরিণত হয়েছে-- প্রতাপচন্দ্র তার কোনও খবরই রাখতেন না। খবর পেলেন তখন, যখন তার অষ্টমবর্ষীয় পুত্র বিলাসচন্দ্র অপহৃত হল। এবং যখন খাস দরবারে এসে সনাতন তার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, 'বিলাসবাবু আমাদের কাছে আছ্যে বটেক। যদি তুই আমাদের কুনো মেইয়্যাছ্যালের ক্ষতি করিস তা হলে আমরা উয়ারে কেট্টে ভাসায়ে দুবো।'
প্রতাপচন্দ্র একমাত্র সন্তানের কথা বিচলিত হয়ে পড়লেন। নিরীহ সাঁওতালেরা যে এমন কাণ্ড ঘটাতে পারে তিনি কখনও স্বপ্নেও ভাবেননি। বিলাসকে অক্ষত অবস্থায় ফিরিয়ে আনাই তখন তার প্রধান দায়িত্ব। তিনি প্রতিশ্রুতি দিলেন সাঁওতাল মেয়েদের কোনও ক্ষতি হবে না। কিন্তু সনাতন টুডু এবং তার দলবল মুখের কথায় বিশ্বাস করতে রাজি হল না। তাদের সাফ কথা, অন্তত দু'বছর বিলাস লোনাপানিতে জামিন হিসেবে থাকবে। এর মধ্যে প্রতাপচন্দ্র যদি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ না করেন তা হলেই সাঁওতালরা বিলাসকে মুক্তি দেওয়ার কথা ভাববে।
দরবারের সবাইকে হতভম্ব করে দিয়ে সনাতন টুডু বিদায় নিল।
(ক্রমশ)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন